২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিদ্যালয় এবং ছাড়পত্র

বিদ্যালয় এবং ছাড়পত্র
বিদ্যালয় এবং ছাড়পত্র - ছবি : সংগ্রহ

সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করা নিয়ে অভিভাবকদের খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে হয়। শিশু সন্তানকে কাঙ্ক্ষিত বিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য যতই ভর্তি পরীক্ষা বা লটারির ব্যবস্থা থাকুক না কেন, ফাঁক-ফোকর দিয়েও অনেকে নামজাদা বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে আগ্রহী। বিদ্যালয় যদি হয় ‘বিখ্যাত’ আর শিক্ষার্থীর বাসা যদি ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, মিরপুর বা উত্তরার মতো দূরত্বে হয়, তাহলেও অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে পড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করেন।

বাসা থেকে বেশি দূরত্বে অফিস করতে গিয়ে চাকরিজীবীদেরই নানাভাবে সময়ক্ষেপণ ও কষ্ট পেতে হয়। সেখানে শিশু-কিশোরদের যে কী ধরনের শারীরিক ও মানসিক চাপ হয় তা কেউ বুঝেও যেন বুঝতে চান না। যানজট এবং জনসংখ্যার আধিক্যের এ দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখার ক্ষেত্রে নির্দেশ থাকা প্রয়োজন যে, শহরের বা গ্রামের একজন শিক্ষার্থী কত দূর পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে পড়তে যেতে পারবে। অর্থাৎ নিজ এলাকা বা থানায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকা সাপেক্ষে একজন কিশোর চাপিয়ে দেয়া কষ্ট ব্যতিরেকে কোন সীমানা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া আসায় সে স্বস্তি অনুভব করবে। এ বিষয়ে নীতিমালা থাকলে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে অহেতুক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাল্টানো কিংবা সন্তানের ওপর যাত্রাপথের ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতাগুলো চাপিয়ে দেয়ার অবসান ঘটতে পারে।

বিদ্যালয়ে প্রবেশের পর শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বইয়ের বিরাট বোঝা। তা ছাড়া ক্লাস টেস্ট ও ক্লাস ওয়ার্কের নামে তাদের অনেক খাতা বহন করতে হচ্ছে। বাড়ির কাজের জন্য বিষয়ভিত্তিক আলাদা খাতা প্রয়োজন; কিন্তু বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষে বসে বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষা দেয়ার জন্য ভিন্ন খাতার প্রচলন করায় ছাত্রছাত্রীদের ভারী ব্যাগ বহন করতে হচ্ছে। অথচ বিষয়ভিত্তিক ক্লাসের কাজের জন্য একটি বা দুটো খাতা এবং ক্লাস টেস্টের জন্য কয়েক পৃষ্ঠা কাগজ দিয়ে বাসা থেকে খাতা বানিয়ে নিয়ে গেলে ছাত্রছাত্রীরা ভারী ব্যাগ বহন করা থেকে মুক্তি পায়। অনেক স্কুলে গাইড বই নিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক হওয়ায় ব্যাগের ওজন বেড়ে যায় অনেক। শিক্ষার্থীদের যেন অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগ বহন করতে বাধ্য করা না হয়, সে বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশ থাকার পরও তা মান্য করা হচ্ছে না। জানা যায়, ইদানীং ঘাড় ও পিঠের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অল্পবয়স্ক শিক্ষার্থীরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছে।

বিদ্যালয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের ঘাড়ে ওজন চাপিয়ে দিচ্ছে; অথচ তাদের আনন্দে বা শরীর ভালো রাখার জন্য ন্যূনতম খেলাধুলার সুযোগ দিতেও নারাজ। মাঠবিহীন বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বেশির ভাগ বিদ্যালয়ের কাছাকাছি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের এক বা একাধিক মাঠ আমরা দেখতে পাই। অথচ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অস্তিত্ব নেই অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচিতে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনীহার কারণে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক কোনো খেলাধুলা ক্লাসেরও ব্যবস্থা থাকে না। ইনডোর গেমের ব্যবস্থা করা যায় অনায়াসেই। মাঠবিহীন বিদ্যালয়গুলো যদি প্রতিদিন পাঠ শুরুর প্রাক্কালে শ্রেণিকক্ষে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত এবং জাতীয়সঙ্গীত গাওয়ার সাথে হাত, পা, ঘাড় ও মাথার কিছু ব্যায়াম করায়, তাহলেও আমাদের শিশু-কিশোর সন্তানেরা ঘাড় ও পিঠের অবাঞ্ছিত ব্যথা থেকে মুক্তি পায়। বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা নিয়মিত হয় না। ইন্টারনেট বা টিভি চ্যানেলের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

অভিভাবক অনেক আশা নিয়ে সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। অভিভাবকের কর্মস্থলের পরিবর্তন ঘটলে বিদ্যালয় পরিবর্তন করার জন্য ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। আবার কোনো শিক্ষার্থীর খারাপ ফলাফল বা মন্দ কাজের জন্য বিদ্যালয় থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সেই শিক্ষার্থীর আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং সমাজও জেনে যায় যে, খারাপ ফল বা কর্মকাণ্ডের জন্য সে বিদ্যালয় বদল করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে সেই শিক্ষার্থী ও তার পরিবার হীনম্মন্যতায় ভোগে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থী নিজে। একজন শিক্ষার্থীকে বেত দিয়ে মারলে সে যত না মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়ে বহু গুণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যদি বিদ্যালয় তাকে ছাড়পত্র দেয়। এতে অনেকের লেখাপড়াও শেষ হয়ে যেতে পারে। এতে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার সংখ্যাও যায় বেড়ে।

প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থীর অন্যায় আচরণের কারণে বা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে বিদ্যালয় থেকে ছাড়পত্র দেয়ার কল্যাণকর দিক আছে বলে মনে হয় না। শিশুদের অন্যায়ের সব দায়ভার তার বা অভিভাবকের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ যখন পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা অন্যায় কাজের শাস্তিস্বরূপ ছাড়পত্র পাওয়ার উপযোগী যদি হয়, তখন অভিভাবকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মুচলেকা নেয়া যেতে পারে সতর্ক করে দেয়ার জন্য। এতে শিক্ষার্থী অনুতপ্ত হলে তার মধ্যে দায়িত্ববোধ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। প্রয়োজনে তাকে উত্তীর্ণ না করা অথবা প্রতি বছর মুচলেকা একবার করে নবায়ন করা যায়। ফলে শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবকের মনে শিক্ষার্থীর সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার মতো তাগাদা সৃষ্টি হতে পারে। এক একটি বিদ্যালয় ও পরিবার দুষ্টু-অবাধ্য শিক্ষার্থীর সংশোধনাগার হতে পারে, যা ছাড়পত্র দেয়ার মাধ্যমে সম্ভব হয় না।

একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়কেই আপন জায়গা মনে করে। শিক্ষকদের উচিত, শিক্ষার্থীকে আপন করে নেয়া। লেখাপড়ায় খারাপ ফল বা অন্যায় আচরণ করলে বিদ্যালয়কে আবশ্যিকভাবে সংশোধনী পাঠের ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে শিক্ষার্থী মানসিকভাবে নিজের ভুল-ত্রুটি বা অন্যায় সংশোধন করার চেষ্টা চালাবে। কোনো বিদ্যালয় কেবল বহু এ প্লাস পেলেই সফল হয় না। শিক্ষার্থীদের আত্মিক চাহিদা পূরণে শিক্ষক কতটা সজাগ, সেটাও ভালো বিদ্যালয় বা শিক্ষক হওয়ার মাপকাঠি। বিদ্যালয়গুলো যে থানা শিক্ষা অফিসের আওতাধীন, সেখানে যদি প্রতি তিন মাস অন্তর সহপাঠ্য ক্রমিক কার্যক্রমের একটি প্রতিবেদন বিদ্যালয়গুলো পাঠাতে বাধ্য থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেয়ার বিষয়গুলো আবশ্যিকভাবে চালু হতে পারে। একটি বিদ্যালয় যদি সর্বাবস্থায় শিক্ষার্থীবান্ধব হয়, তখনই শিক্ষাদানপদ্ধতি আরো বেশি সুফল বয়ে আনতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করবে আনন্দচিত্তে।


আরো সংবাদ



premium cement