১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আশা ও হতাশার মাঝে আফগানিস্তান

আশা ও হতাশার মাঝে আফগানিস্তান
আশা ও হতাশার মাঝে আফগানিস্তান - ছবি : সংগ্রহ

আফগানিস্তানের জটিল ইতিহাসে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত নিরসনে কখনো বর্তমান সময়ের মতো এ ধরনের উত্তেজনাপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা যায়নি। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসের নিয়তি নির্দিষ্ট এক সন্ধ্যায় সোভিয়েত সৈন্যরা আগ্রাসন চালিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নিলে দেশটি তাদের কব্জায় চলে যায়। পরে একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়েছিল। তেমনি এখন যুক্তরাষ্ট্রও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সক্রিয়ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের ভাবনা চীন, রাশিয়া এবং ইরানকেও আকৃষ্ট করেছে। চলমান ঘটনা পরিক্রমায় আন্তঃআফগান নিষ্পত্তির পথ খুঁজে বের করতে পাকিস্তানের অবস্থান কেন্দ্রবিন্দুতে। এতে সতর্ক আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে যে, ২০১৯ সাল হতে পারে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত বা সর্বশেষ বছর।

কিন্তু পাকিস্তান, আফগানিস্তান অথবা যুক্তরাষ্ট্র- কোনো একটি দেশও সরকারি পর্যায় থেকে ক্রমবর্ধমান বেপরোয়া কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ফল আসবে বলে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছে না। দেখা যাচ্ছে, সবার মধ্যে হতাশা বাসা বেঁধেছে।

ওয়াশিংটনের চাপে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকারের সাথে ফলপ্রসূ সংলাপের জন্য আফগান তালেবান নেতাদেরকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার ব্যাপারে পাকিস্তান সফল হলে সেটা হবে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক সততার সোনালি শিশু। কিন্তু ইসলামাবাদ ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহাতীতভাবে বারবার আগ্রাসীভাবে পাকিস্তানের নিন্দা করবে এবং আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী করবে পাকিস্তানকে।

আফগান তালেবান, কাবুল এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সংলাপে পাকিস্তানের প্রচেষ্টায় তিনটি ফ্যাক্টরের কারণে একটি ইতিবাচক ফলাফল আসবে বলে কিছুটা আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক নেতারা ঐক্যবদ্ধ এবং এই লক্ষ্যে তারা একত্রে কাজ করছেন। দ্বিতীয়ত, ইসলামাবাদ নিজেদের সর্বোত্তম স্বার্থে একটি অর্থপূর্ণ আলোচনার ব্যাপারে তালেবান নেতাদের ভালোভাবে বোঝাতে পারবে বলে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিকতর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তালেবানরা আগের অবস্থানে অনমনীয় থাকলে পাকিস্তানের আতিথেয়তা হারানোর ঝুঁকি থাকবে বলেও তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তালেবানরা আলোচনার ব্যাপারে তাদের কঠোর লাইন অনুসরণ করে অস্বীকৃতি জানালে অথবা কেবল তাদের নিজেদের শর্তানুযায়ী আলোচনায় বসতে সম্মত হলে, একইভাবে আফগান তালেবানরা সৌদি আরব, আরব আমিরাত (ইউএই) এবং কাতারের সব ধরনের কূটনৈতিক সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে।

তৃতীয়ত, আফগান তালেবান এবং কাবুল উপলব্ধি করতে পেরেছে, তারা একে অপরকে অব্যাহত ও সামরিকভাবে আঘাত করে যাচ্ছে- কিন্তু কোনো পক্ষই বিজয় অর্জন করতে পারছে না। এ ধরনের একটি অচলাবস্থা বস্তুগত এবং জীবনহানির দিক দিয়ে উভয়পক্ষের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ক্ষতিকর। যেকোনোভাবে আফগান তালেবানরা দেশে সম্পূর্ণভাবে জয়লাভ করলে তা রাশিয়া, চীন, ইরান, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যএশিয়ার দেশগুলো এবং ভারতের কাছে কখনো তা গ্রহণযোগ্য হবে না।

আবুধাবিতে প্রথম দফা আলোচনার পর তালেবানরা ভয়ঙ্কর খেলা খেললেও তাদের উভয় সঙ্কট হলো আফগান তালেবানদের বিভিন্ন গ্রুপ আলোচনায় আগ্রহী নয় সমানভাবে। তাই তাদের নেতারা বন্দিমুক্তি এবং আফগান সরকারের সাথে সরাসরি আলোচনা নয়, সহআলোচনায় বসার ব্যাপারে বিভিন্ন শর্তারোপ করছেন।

অপর দিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও কাবুল কেউ মার্কিন সৈন্যদের সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার এবং সঙ্কট সমাধানের পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি দিতে আগ্রহী নয়। কাবুলের ক্ষেত্রে গত দশকে পালন করা কিছু উদার রাজনৈতিক ও সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলার আশা করা গেলেও তালেবানের ক্ষেত্রে এসব আশা করা বাতুলতা মাত্র। কারণ তারা এগুলোকে অবজ্ঞা করে থাকে। আফগান সঙ্কট নিরসনের ব্যাপারে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে একই ধরনের স্বার্থ রয়েছে। তাই তারা কূটনৈতিকভাবে বাঁকা অবস্থানে থাকা ভারতকে শান্তি আলোচনা থেকে সম্পূর্ণ বাইরে রেখেছে। জানুয়ারির মাঝামাঝি ভারত ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে সংলাপ আয়োজনের জন্য নয়াদিল্লি চেষ্টা চালালেও পাকিস্তান সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় ভারতের কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই।

ভারত হয়তো তার কূটনৈতিক ক্ষমতা বা প্রভাব ব্যবহার করে সংলাপ প্রক্রিয়ার সময় কঠিন ভূমিকা পালন করে পাকিস্তানের উদ্যোগে পরিচালিত আফগান শান্তি উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিতে পারে। এর বাইরে ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে ভারতের পক্ষে বিকল্প কোনো ক্ষতি করার উদ্যোগ নেয়া কঠিন।

তালেবান আর যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তাসংক্রান্ত এবং রাজনীতির ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে কিছু সাফল্য অর্জন না করা পর্যন্ত সেখানে হয়তো কাবুলের অংশগ্রহণ থাকবে না। এই সময়ে পাকিস্তান এবং বন্ধুভাবাপন্ন আরব রাষ্ট্রগুলোকে তাদের সব কূটনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে আফগান তালেবানদের বোঝাতে হবে যে, সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান চাওয়া ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি আর কোনো অধিক উত্তম বিকল্প নেই। কিন্তু গত কয়েক মাসের ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে- এটি একটি ধীর ও স্বল্পমেয়াদি শান্তিপ্রক্রিয়া।
লেখক : পাকিস্তানভিত্তিক রাজনীতি বিশ্লেষক
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement