১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সামাজিক ব্যবসায় : শীর্ষ সম্মেলনের অভিজ্ঞতা

সামাজিক ব্যবসায় : শীর্ষ সম্মেলনের অভিজ্ঞতা
সামাজিক ব্যবসায় : শীর্ষ সম্মেলনের অভিজ্ঞতা - ছবি : সংগ্রহ

এবার জার্মানিতে সোস্যাল বিজনেস সামিট অনুষ্ঠানে স্বাগত জানান জার্মান ক্রিয়েটিভ ল্যাবের অ্যালামনাই লেওনহার্ড নিমা। নিউ সিভিলাইজেশন সম্পর্কে বক্তব্য দেন গুন্নার কিলিয়ান, জার্মান গভর্নমেন্ট সম্পর্কে বলেছেন পার্লামেন্টারি স্টেট সেক্রেটারি অব দ্য ফেডারেল মিনিস্টার ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ড. মারিয়া ফ্যালেচ বেথ, দ্য কনসালটেশন দ্য হান্ড্রেড ইয়ারস জার্নি থ্রু স্পেস সম্পর্কে বললেন, ‘নাসা’র প্রাক্তন মহাকাশচারী রন গেরান। ২০২০ অলিম্পিকের প্রধান নির্বাহী তোশিরো মুতোরও বক্তব্য রাখেন।

প্লাস্টিক অ্যান্ড সার্কুলার ইকোনমি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন ডেইব হ্যাক্কেনস, সলিডারিটি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন এক্সপার্ট প্যানেল প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস (মডারেটর), প্যারালাল সিজন ও এক্সপেরিয়েন্স জার্নি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন ইউনূস সোস্যাল বিজনেসের সিইও কেরিন হিথসচেক। ফিউচার ইমপ্লাস সেভেন সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন গ্রামীণ শক্তির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সোহেল আহমেদ, বিল্ডিং অ্যা নিউ সিভিলাইজেশন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন হেন্স রিটজ (মডারেটর), সোস্যাল বিজনেস অ্যান্ড কো-অপারেটিভস সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন গ্রামীণ নিটওয়্যারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর কাজী মঞ্জুরুল ইসলাম, মোবিলিটি ইনোভেশন ফর লার্জ সিটিজ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন মি-রা থাই, রিফিউজি অ্যাকশন ট্যাংক সম্পর্কে বলেছেন, এঞ্জিয়া অ্যান্ড ফ্রিদ্রিচ কিসিঞ্জার, হাউ টু কো-ক্রিয়েট ইন দ্য ফুড সেক্টর বিষয়ে বলেন জেন বার্নু, সোস্যাল বিজনেস সলিউশন ফর প্লাস্টিক সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন রোউশান মিরান্ডা, ডিজিটাল ডিসরাপশান ফর সোস্যাল ইমপ্যাক্ট সম্পর্কে বলেছেন, সিউন ডববিন, বিল্ডিং কমিউনিটিজ অব চেঞ্জমেকার উইদিন ইউর অর্গানাইজেশন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন মেইক্সেন্স এবং আরো অনেকে।

আমরা দেখেছি, ওলফসভবার্গ কারখানায় অটোস্ট্যাড এলাকাটি বিশাল। ছয় মাইল দৈর্ঘ্য, ছয় মাইল প্রস্থ। বিকেলে চা বিরতির এক ফাঁকে, পাশের পোতাশ্রয়ে ক্রুইজে এক ঘণ্টা ভ্রমণের সুযোগ হারালাম না। ১০-১৫ জন বাংলাদেশী সঙ্গী পেয়ে গেলাম। নদীর স্বচ্ছ পানির ওপর ডাহুক-ডাহুকী। আরো কত রকমের পাখি। এদের কলগুঞ্জন পুরো এলাকা মুখরিত করে রেখেছে। আমাদের দেশে শিল্প এলাকা মানে দূষিত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিন্তু জার্মানিতে আমাদের সম্পূর্ণ বিপরীত, অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মস্থলে কোনো ধরনের শব্দদূষণ নেই, নেই কোলাহল। আছে ওয়াকওয়ে, গার্ডেন, লেক; গাড়ির টাওয়ার বলতে বিশাল শোরুমের মতো প্রায় ২০ তলাবিশিষ্ট স্টিল স্ট্রাকচার এবং গ্লাসফিটিং; নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত গাড়ি সাজানো; বাহির থেকে স্বচ্ছ ফাইবার গ্লাস দিয়ে দেখা যায়। এটি অন্য রকম সৌন্দর্যের বিষয় মনে হয়, যেন গাড়িগুলো শূন্যে ভাসছে। সুউচ্চ গাড়ির টাওয়ার এক নান্দনিক পরিবেশ। অটোস্ট্যাড টাউন সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত। বড় ভবনগুলো করপোরেট ফোরাম, হোটেল রিজ-কার্লটন, ওলফসবার্গ এবং কার টাওয়ারগুলোর সাথে গ্রাহক কেন্দ্র এবং পার্ক এবং লেগুন আড়াআড়িভাবে গঠন করা হয়েছে। ওখানে আরো রয়েছে ফার্স্ট এইড, রেস্টুরেন্ট, পোশাক দোকান এবং কার শোরুমের মধ্যে রয়েছে ভিডব্লিউ কমার্শিয়াল কার, পোর্শে প্রভৃতি।

ক্রুজের ক্যাপ্টেন এলাকাটির ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারা বিবরণী ও আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। মাঝে মধ্যে চোখে পড়েছে পাইন গাছের জঙ্গল। শীতকালে দেশে সব গাছের পাতা প্রায় ঝরে গেছে। কিন্তু পাইন গাছগুলো দারুণভাবে শীতের সাথে সংগ্রাম করে পত্ররাজি সাজিয়ে রেখেছে। ওই দেশ স্কেটিংয়ের দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। ছেলেমেয়েরা এক ধরনের জুতা পায়ে একটি লাঠি দিয়ে নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে। এটি শীতপ্রধান দেশে খুবই জনপ্রিয় খেলা। আমাদের ক্রুজটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। প্যান্ট, লম্বা গাউন, কোট-টাই মাঝে মধ্যে গরমের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাইরে তাপমাত্রা ছয়-সাত ডিগ্রির মতো। ঘোষক হিটলার, মুসোলিনি ও জার্মানির অনেক ইতিহাস বলতে থাকেন। তিনি বললেন, জার্মানিতে যুদ্ধ-সঙ্ঘাতে বহু রক্ত ঝরেছে। এখন জার্মানরা শান্তি চায়। প্রতিবেশীদের সাথে চায় সদ্ভাব।
পুরো এলাকা ঘুরে এলাম। নদীর এপাড়-ওপাড়ে অনেকগুলো ব্রিজ। ওপাড়ে রেলের মেইন স্টেশন। ভক্সওয়াগন কোম্পানির কারখানাকে ঘিরে শহরটি গড়ে উঠেছে। নৌভ্রমণ শেষ করে প্যানেল ডিসকাশনে ফিরে এলাম।

সমাপনী অনুষ্ঠানে নোবেলজয়ী প্রফেসর ইউনূস সারা বিশ্বের পরিবর্তন ও উন্নয়ন নিয়ে আবেগপূর্ণ বক্তব্য রাখলেন। সামাজিক ব্যবসায় কিভাবে অ্যাথলেটদের ক্ষমতা কাজে লাগাতে এবং সমাজের নেতা হিসেবে কিভাবে তাদেরকে রূপান্তরিত করতে পারে তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীজুড়ে মানুষকে সংগঠিত করতে পারো। তোমরা পরিবর্তনের অগ্রদূত, অগ্রপথিক। নিজেদের এলাকা, সমাজসহ গোটা বিশ্বকে বদলে দিতে পারো।’ তার ভাষণের পরেই ‘ইউনূস স্পোর্টস হাব’-এর আয়োজনে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তরুণদের দ্বারা পরিচালিত এবং অনুদাননির্ভর সামাজিক প্রকল্পগুলোকে কিভাবে সামাজিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হলো। ‘ইয়ং চেঞ্জ মেকার্স কর্মসূচি’র মাধ্যমে কিভাবে তরুণদের ক্ষমতাকে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে ইউনূসের পরিকল্পনা এবং ‘প্যারিস ২০২৪’ একত্রে কাজ করে যাচ্ছে। সামাজিক ব্যবসায় কিভাবে সমাজে স্থায়ী ও ইতিবাচক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে তিনি তা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, কল্যাণমুখী অর্থনীতি বিশ্বকে অস্থিতিশীলতা থেকে রক্ষা করতে পারে।

জার্মানির উলফসবার্গে দুই দিনব্যাপী সামাজিক ব্যবসার বিশ্ব সম্মেলন শেষ হয়েছে। এর আগে একই স্থানে ইয়ং চ্যালেঞ্জারস মিটিং এবং সোস্যাল বিজনেস কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম সোস্যাল বিজনেস সেন্টারের একটি প্রতিনিধিদলসহ এই সম্মেলনে ৫০টিরও বেশি দেশের সাত শতাধিক প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বিল্ডিং অ্যা নিউ সিভিলাইজেশন। সম্মেলনে বিশ্বের নানা দেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা কোম্পানির মালিক ও প্রধান নির্বাহীরা অংশ নিয়েছেন।

একটি নতুন বিশ্ব গড়ার জন্য পৃথিবীর অর্থনীতিকে সবার আগে ঠিক করে সুসমবণ্টন নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে এবার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সোস্যাল বিজনেস সেন্টার, ইউনূস সেন্টার এবং সামাজিক ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সামাজিক ব্যবসার কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষ দিকে মনিকা ইউনূসের নেতৃত্বাধীন শিল্পীগোষ্ঠী সোস্যাল বিজনেসের থিম সঙ্গীত পরিবেশন করে। সামাজিক ব্যবসার ওপর পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়। জার্মানির বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভক্সওয়াগনের সদর দফতরে অনুষ্ঠিত নবম সোস্যাল বিজনেস সামিটের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলে হোটেলের দিকে রওনা হলাম। পরদিন সকালে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা।
(জার্মানিতে আয়োজিত সামাজিক ব্যবসায় সম্মেলন থেকে ফিরে)
লেখক : আইনজীবী, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী


আরো সংবাদ



premium cement