২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিরোধী দলের রাজনীতি

বিরোধী দলের রাজনীতি - ছবি : সংগৃহীত

মনে হয়, বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই উদ্বিগ্ন। তিনি সংসদ নির্বাচনে দলটির বিপর্যয়ে ক্রমাগত পরামর্শ প্রদান ও মূল্যায়ন করে যাচ্ছেন। গত ১০ জানুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবস’ উপলক্ষে আহূত সভায় তিনি বলেন, বিএনপি উপযুক্ত প্রার্থীকে মনোনয়ন না দিয়ে কেবল অর্থের বিনিময়ে অনেক অখ্যাত ও স্বল্পপরিচিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়ায় দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি হয়। সিট যখন অকশনে (নিলাম) দেয়া হয়, তখন নির্বাচনে জেতে কিভাবে?’ কেবল যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়ায় বিএনপি সব হারানোর উদাহরণ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ধামরাইয়ে আতাউর রহমান খানের ছেলে জিয়াউর রহমানকে ধরেই নিয়েছিলাম, নির্বাচিত হবেন। মনোনয়ন পেলে তো জিতবেন। কিন্তু তাকে না দিয়ে যে বেশি টাকা দিলো তাকে মনোনয়ন দেয়া হলো।

নারায়ণগঞ্জে তৈমূর আলম খন্দকারকে মনোনয়ন দেয়া হলো না, চট্টগ্রামে মোর্শেদ খানকে না দিয়ে যে বেশি টাকা দিলো তাকেই মনোনয়ন দিলো (প্রথম আলো, দৈনিক নয়া দিগন্ত; ১১ জানুয়ারি)। এসব শুনে মনে হয়, টাকার লেনদেন যেন তার সাক্ষাতে ঘটেছে। অনেকে ব্যঙ্গ করে বলছেন : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে দলটি এখন মূল্যায়নের জন্য ‘ভালো একজন হিতৈষী’ পেয়ে গেছে। গত ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনে অশ্রুতপূর্ব ও বিরল ‘ভোট ডাকাতির’ মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে প্রহসন অনুষ্ঠিত হলো। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ‘প্রযোজনায়’ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক’টি কেন্দ্রে বিরোধী দল বা ঐক্যফ্রন্টের এজেন্ট ছিল- তা কিন্তু হলফ করে বলা যাবে না। প্রিজাইডিং অফিসারদের কাছ থেকে ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে ব্যালট বাক্স আগের রাতে পরিপূর্ণ করে যে নাটক মঞ্চস্থ করা হলো তা জাতি ক্ষোভের সাথে স্মরণে রাখবে। তাদের কথা হলো- এতই যখন প্রহসন ঘটবে, তাহলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘নির্বাচন নাটক’ মঞ্চস্থ না করে আইন পাস করে বিদায়ী এ সংসদকেই ব্রুট মেজরিটির জোরে পাঁচ বছরের জন্য কি রাখা যেত না? বেঁচে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে কয়েক শ’ ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপন করে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান করা যেত। ক্ষতি হলো জাতির। নৈতিকতার এহেন পচনে আড়াই কোটি নতুন তরুণ ভোটারের কাছে নির্বাচনটি অনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্বাক্ষর হয়ে থাকল। যতই ব্যয় সঙ্কোচের দোহাই দিয়ে মন্ত্রীদের নিয়ে বাসে করে বঙ্গবন্ধু মাজার জিয়ারতে যাওয়া হোক না কেন- যুব মানসে সৃষ্ট এ ক্ষত পূরণ হতে কত বছর লাগবে, তা ভবিষ্যৎই জানে।

ময়লাপানিতে যেমন পরিচ্ছন্ন হওয়া যায় না, তেমনি মন্ত্রীদের বাসযাত্রা বা কিংবা বিএনপির প্রতি মায়াকান্নায় সে অভাব পূর্ণ হবে না। বিশ্বসম্প্রদায়ের মোড়ল বলে কথিত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি কিংবা জাতিসঙ্ঘ এখনো এ নির্বাচনের ফলাফলকে অভিনন্দিত করেনি। ফলে উদ্বেগ কিন্তু রয়েই গেছে। এতে সৃষ্ট গুমোট পরিবেশ ক্ষমতাসীনদেরকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না; সেটি কিন্তু তাদের চোখমুখের উদ্বেগেই পরিস্ফুটিত হচ্ছে। যতই নির্বাচন কমিশন ‘পিঠা উৎসব’ কিংবা ডিএমপি প্রতিটি থানায় বিরল ভোজের আয়োজন করুক না কেন- স্তম্ভিত জাতি কিন্তু এখনো সুস্থ হতে পারছে না।

সব দলের সাথে অনুষ্ঠিত, প্রধানমন্ত্রীর মতবিনিময় সভায় ‘আমার ওপর আস্থা রাখুন, সুষ্ঠু নির্বাচন দেবো’ কিংবা ‘কাল থেকে একটিও গায়েবি মামলা হবে না’ উক্তিগুলোর বাস্তবায়ন জাতি দেখেনি। ঘটেছে উল্টোটি। বিরোধী দলের প্রায় প্রত্যেক প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক-নির্বাচনী এজেন্টদের মামলা, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের যে মহোৎসব হলোÑ তাতে ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসির নতুন গীত গ্রামবাংলায় গাইতে হচ্ছে। ধানের শীষে ভোট দেয়ায় নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কুলবধূর গণধর্ষণের ঘটনা জাতি উদ্বেগের সাথে প্রত্যক্ষ করেছে- প্রধানমন্ত্রী কিন্তু একবারও এর নিন্দাবাণী উচ্চারণ করেননি। এ বধূ নৌকা প্রতীকের সমর্থক হলে তিনি হয়তো এটা বহুবার বলতেন। মনে হয়, এমন প্রহসনের নির্বাচনে তারাও খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছেন না। উন্নয়নের মধুর বাণী ছড়িয়ে দিয়ে অপকর্মের কুৎসিত রূপ যেমন ঢাকা যাবে না, তেমনি ঐতিহ্যবাহী এ দলটির অধুনা কাণ্ডারিদের এসব কর্মকাণ্ডে জাতির বিবেকবান অংশ, খেটে খাওয়া মানুষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে কী ব্যাখ্যা দেবেন- তা কি তারা একবারও ভেবে দেখেছেন?

বিপুল ভোটে(?) নির্বাচিত হয়ে তাদের উল্লাস কতটুকু গ্রহণযোগ্য হচ্ছে- চোখ বুজে তা একবার মূল্যায়ন করলে অবশ্যই তারা আরেকবার লজ্জায় কুঞ্চিত ও ঘর্মাক্ত হবেন। দেশের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আশুনির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে- দেশের প্রতিটি বিরোধী দলের আজ এ দাবি। আশা করি, সরকার বিবেকের দংশনে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটি সবার জন্য কল্যাণকর হবে। ঐক্যফ্রন্ট প্রধান ড. কামাল হোসেন সে দাবিই করেছেন। কল্যাণের স্বার্থে সরকার আশুসংলাপের উদ্যোগ নেবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এ সংসদ আইন সংশোধন করে অবিলম্বে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক আসামির রায়ের অবজারভেশনে জামায়াতকে ‘যুদ্ধাপরাধী দল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল; তাতেই উৎসাহিত হয়ে আইনমন্ত্রী এ মন্তব্য করেছেন। আওয়ামী লীগ যখন কোনো রাজনৈতিক জটিলতায় পড়ে তখনই জনমতকে কাছে টানতে ‘জামায়াত কার্ড’ ব্যবহার করেছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মহাবিতর্কিত নির্বাচনে বিশ্বজনমত এবং নিজ দেশেই সমালোচনার সম্মুখীন- তখন ‘উন্নয়ন’ স্লোগান নিয়ে নির্বাচিত এ সরকার জামায়াত ইস্যুটি সামনে আনার প্রয়াস পেয়েছে। অনেকে বলছেন, জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়ার এটি একটি পুরনো প্রবণতা। গায়েবি বাস পোড়ানোর জন্য যেমন গায়েবি মামলা হয়, কেউ প্রশ্ন তোলে না আদালতে; তেমন কোনো প্রয়াস শুরু হবে কি না, রাজনৈতিক বোদ্ধারা সেটি বলতে পারেন। জামায়াতে ইসলামী দেশের বৃহত্তম ইসলামী দল বিধায় তাদের ওপর ’৭১-এর পুরো দায়ভার চাপানো হচ্ছে বলে মনে করা হয়। যেকোনো দলেরই রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত থাকতে পারে, সেটি ভুল প্রমাণিত হলে জাতির সামনে ‘ভুল স্বীকার’ করা অপরাধ নয়।

বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে আইন ও সংবিধান মোতাবেক রাজনীতি করার মাধ্যমে ‘একাত্তর-পূর্ববর্তী রাজনীতির ভুল স্বীকার’ই প্রমাণিত হয়- তবুও মৌখিক স্বীকারোক্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ও বাম দলগুলোর প্রত্যক্ষ বিরোধিতা এবং অন্য দলগুলোকে মোকাবেলায় জামায়াতকে হিমশিম খেতে হয়। তদুপরি, সহমর্মী হিসেবে জামায়াত অন্যান্য ইসলামী দলকে কাছে পায়নি। একটি দলের শীর্ষ চার নেতার ফাঁসি ও এক নেতার কারাভ্যন্তরে মৃত্যুতেও দলটি নির্জীব হয়ে যায়নি। এটিই বিস্ময়! এরশাদ জেল খাটবেন না বলে আওয়ামী লীগের সন্তুষ্টি ঘটাতে কী না করছেন; কিন্তু জামায়াতের আপসহীনতায় দলটিকে অনেক ‘কাফফারা’ দিতে হচ্ছে। রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। সেটি চিন্তা করে পদক্ষেপ নিলে বোধহয় ভালো হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে আমরা আওয়ামী লীগ ও জামায়াতকে এক টেবিলে আলোচনায় দেখেছি। জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে প্রেসিডেন্ট পদে আওয়ামী প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে দোয়া চাইতে বাসভবনে যেতে দেখেছি। অতএব, ভবিষ্যৎ রাজনীতির অবস্থা কী হবে, কেউ জানে না।

হেফাজতের সাথে আওয়ামী লীগের বিপরীত মেরুর অবস্থান অল্প সময়ের ব্যবধানে দূর হয়ে গেলে জাতি বিস্মিত হয়েছিল। স্থান-কাল-পাত্রভেদে রাজনীতির অবস্থান ভিন্ন হয়। চারদলীয় জোটের এক সময়ের শরিক দল জাতীয় পার্টি এখন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দল সংসদ সদস্যের শপথ পড়েছে। রাজনীতির ঘোলা পানিতে কে কখন কোথায় যায়, সেটিই আজ দেখার বিষয়। কোনো দলকে অবৈধ ঘোষণা করলে তার বিপুলসংখ্যক সমর্থক ও কর্মী দলটিকে ভুলে যাবেন- সে কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। পোলারাইজেশনের যুগে যেকোনোভাবেই তারা অন্যভাবে হলেও সক্রিয় হবেন, অন্যান্য দেশ তার উদাহরণ। প্রতিটি দলকেই সুষ্ঠুভাবে মত প্রকাশের সুযোগ করে দেয়া গণতন্ত্রের দাবি। ভল্টেয়ারের ঐতিহাসিক মন্তব্য এখানে স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারি; কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য আমি জীবনও দিতে পারি।’ পরমতসহিষ্ণুতার মহান বাণী ক্ষমতাসীনদের পাথেয় হোক- এ কামনাই করছে গণতন্ত্রমনা জনগণ।


আরো সংবাদ



premium cement