২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পাগলের স্বপ্ন

-

শীতের এক সন্ধ্যা। আমি একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদের ড্রয়িংরুমে বসে তার গরম কথা শুনছিলাম। এ আলোচনা আমার কাছে উনুনের উত্তাপের চেয়ে কম ছিল না। কেননা ওই রাজনীতিবিদের সম্পর্ক বিরোধী দলের সাথে নয়, সরকারি দলের সাথে ছিল। সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ যখন তারই সরকারের অযোগ্যতার কাহিনী শোনান, তখন তার শব্দের উত্তাপ বেশ আনন্দ দেয়। তবে ওই সন্ধ্যায় আমার এক ডিনারের দাওয়াত ছিল। বারবার তার কাছ থেকে ওঠার অনুমতি চাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে এমন কোনো-না-কোনো কাহিনী শুনতে বাধ্য করছিলেন, যেখানে কখনো ইমরান খান আবার কখনো উসমান বুজদারের এক মারাত্মক অনভিজ্ঞ ও অনুপযুক্ত সরকার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। তাদের শাসনকালের সূচনা পরিণামের সংবাদ প্রদান করে।

আসিফ জারদারির সরকারেও শামিল ছিলেন সিনিয়র রাজনীতিবিদ আবার নওয়াজ শরিফের সরকারেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার কথায় এ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে যে, ইমরান খান সেই কাজই করছেন, যা জারদারি ও নওয়াজ করতেন এবং অবশেষে ইমরান খানের ব্যাপারে তাই ঘটবে, যা জারদারি ও নওয়াজ শরিফের বেলায় ঘটছে। আমি বারবার আমার সুহৃদের খেদমতে আরজ করছিলাম, ‘আপনি আপনার সরকারকে ছয় মাস তো সময় দেবেন। ছয় মাসের পর আমরা আপনাদের হিসাব নেব।’ তখন সঙ্কুচিত হয়ে ইমরান খানের গুরুত্বপূর্ণ জোটভুক্ত এ সদস্য আমাকে বললেন, শুকরিয়া আদায় করো; জারদারি ও নওয়াজ শরিফ একে অপরকে ধরে এখনো কান্নাকাটি করছে। যেদিন তাদের সমস্যা মিটে যাবে- সেদিন আমাদের সরকার ছিঁড়ে যাওয়া তসবি দানার মতো বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।

আমার বহুদিনের পুরনো সম্পর্কের এ মানুষটির কাছে অনুরোধ করলাম, ‘আপনি এ কথাগুলো প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কর্ণগোচর করুন।’ দুই দিন পর ইমরান খানের সাথে তার সাক্ষাৎও হয়েছে, তবে জানি না তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার মনের কথা বলেছেন কি না। তার সবচেয়ে বেশি অভিযোগ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের সরকারি বিষয়ে হস্তক্ষেপ সম্পর্কে। এতে তালিকার শীর্ষে আছেন জাহাঙ্গীর তারিন। সুপ্রিম কোর্ট তারিনকে দুর্নীতির কারণে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। তার এমন প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে আসা উচিত নয়, যিনি দিনরাত দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভাষণ প্রদান করে থাকেন। তবে সরকারের সব ভুল ও অযোগ্যতার দায় জাহাঙ্গীর তারিনের ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না।

জাহাঙ্গীর তারিন কি এফআইএ’কে আসগর খান মামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন? এফআইএ ইমরান খানের অধীন। আর খান সাহেব যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন আমাদের বলতেন, পিপলস পার্টি ও মুসলিম লিগের (এন) নেতা দুর্নীতিবাজ। আর এ দুর্নীতিবাজ লোক ‘আসগর খান মামলা’য় সুপ্রিম কোর্টের ফয়সালা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। এ কাজ তো শুধু আমি করতে পারব। খান সাহেব প্রধানমন্ত্রী হলে তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এফআইএ বলছে, ‘আসগর খান মামলায় আদালতের ফয়সালার ওপর কাজ করা সম্ভব নয়। কেননা সাক্ষী বিদ্যমান নেই।’ পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে আনীত সংবিধানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার মামলাও কিছুটা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন। এ মামলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো আগ্রহ নেই।

তা ছাড়া মোশাররফ সাহেবের উকিল ফারুক নাসিম আইনমন্ত্রী হয়েছেন। তাহলে এ মামলা কিভাবে আগে বাড়বে? এ বিষয়ে পিপলস পার্টির সরকার নীরবতা অবলম্বন করেছিল। আর মুসলিম লীগ (এন) বিদ্রোহের মামলা দায়েরের পর মোশাররফকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়। এসব কিছু এক গোপন সমঝোতার ফল। যেখানে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ও আর্মি চিফ জেনারেল রাহিল শরিফ সম্পৃক্ত ছিলেন। এ কথা বলা স্পষ্ট ভুল- সুপ্রিম কোর্ট মোশাররফকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেছেন। তবে সুপ্রিম কোর্ট চাইলে মোশাররফকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে আসার নির্দেশ দিতে পারেন। মোশাররফ আমাদের রাজনীতিতে একটি এনআরও (National Riconciliation Ordinance বা জাতীয় সমঝোতা প্রজ্ঞাপন)-এর কারণে বদনাম কুড়িয়েছেন।

যেখানে তিনি আর্মি চিফ হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন। এটা প্রকাশ্য সমঝোতা ছিল কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে গোপন সমঝোতার ইতিহাস অনেক পুরনো। আমি হোসেন সোহরাওয়ার্দীর বেশ ভক্ত। তবে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, তিনিও পাকিস্তান গঠনের পর কয়েকটি এনআরও করেছেন। প্রথম এনআরও ছিল তৎকালীন প্রধান দলের (রিপাবলিকান পার্টি) সাথে জোট গঠন। দ্বিতীয় এনআরও ছিল ১৯৫৪ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ পাকিস্তানের আইন প্রণয়নকারী অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিতে চাচ্ছিলেন। তখন তিনি আমাদের এক প্রবীণ সাংবাদিক জেড এ সুলেরিকে সোহরাওয়ার্দীর কাছে প্রেরণ করেন। সোহরাওয়ার্দী অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেয়ার দাবি করে বসেন যা পাকিস্তান টাইমসে প্রকাশ হয় এবং অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেয়া হলো। অ্যাসেম্বলির স্পিকার মৌলভি তমিজ উদ্দীন খান সিন্ধু হাইকোর্টে আবেদন করেন এবং সেখানে গোলাম মুহাম্মদের বিরুদ্ধে ফয়সালা আসে। তবে সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস মুহাম্মদ মুনির ‘জরুরি অবস্থা’র দর্শন সৃষ্টি করে গোলাম মুহাম্মদের পদক্ষেপ বৈধ বলে আখ্যায়িত করেন। (আরো বিস্তারিত জানতে কানওয়ার ইনতিজার মুহাম্মদ খান অ্যাডভোকেটের ‘ঈমান ফুরুশ জাজুঁ কি দাস্তান’ পড়ুন)।

পূর্ব পাকিস্তানে অপারেশনের পর হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে অপারেশনের শুধু সামরিক কারণ নয় বরং রাজনৈতিক কারণগুলো বিবেচনা করেছে। ওই কমিশন জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল আবদুল হামিদ খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল গুল হাসান, জেনারেল গোলাম উমর ও জেনারেল মিঠার বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে ট্রায়ালের সুপারিশ করেছিল। কমিশনের রিপোর্টে আকলিম আখতার রানী ওরফে জেনারেল রানীসহ কয়েকজন নারীর উল্লেখ ছিল, জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে যাদের ছিল সম্পর্ক। ভুট্টো সরকার ইয়াহিয়া ও রানীকে নজরবন্দী তো করেছিলেন কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা চালাননি। এস এম জাফর তাদের উভয়ের উকিল ছিলেন। তিনি তার ‘মেরে মাশহুর মুকাদ্দাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জেনারেল’ রানীর বিরুদ্ধে তারবেলা ড্যামের ঠিকাদারি প্রদান, সরকারি জাহাজ ব্যবহার ও সৌদি আরবে ব্যবসার মতো অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে সংবিধানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ ছিল। তবে এসব অভিযোগে মামলা চালানো হয়নি। জাফর যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জেনারেল রানীর নজরবন্দী হওয়াকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করলেন, তখন সরকার তাদের নজরবন্দীর পরিসমাপ্তি ঘটান। এটা কি এনআরও ছিল না? তবে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ওই এনআরও-এর ফলে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়।

যারাই এনআরও দিয়েছেন এবং নিয়েছেন, তাদের ফায়দা হয়েছে কম, ক্ষতি হয়েছে বেশি। নওয়াজ শরিফ মোশাররফের সাথে এনআরও করেন এবং সৌদি আরব চলে যান। আজ নওয়াজ শরিফ আবার কারাগারে। আসিফ আলী জারদারিও মোশাররফের সাথে এনআরও-কে বহাল রাখেন এবং আজ তিনি আবারো দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতারের আশঙ্কায় রয়েছেন। ইমরান খান সব সময় এনআরও-এর বিরোধিতা করেছেন। তবে আসগর খান মামলায় জানা নেই তিনি কার সাথে এনআরও করছেন। মোশাররফের বিরুদ্ধে সংবিধানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার মামলার ক্ষেত্রে ইমরান খানের পলিসি জারদারি ও নওয়াজ শরিফের পলিসির চেয়ে ভিন্ন নয়। এ পলিসি দিয়ে ইমরান খান তার সরকারকে নিরাপদ মনে করবেন। তবে তিনি পাকিস্তানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। আইনের শাসনের অর্থ, আইন সবার জন্য সমান হতে হবে। নওয়াজ শরিফ দুর্নীতির অভিযোগ স্বীকার করেননি তবে তিনি আদালত কর্তৃক দণ্ড পেয়েছেন।

আসাদ দুররানি আইএসআইয়ের প্রধান হিসেবে রাজনীতিবিদদের মধ্যে অর্থ বণ্টনের কথা স্বীকার করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেছেন। তবে তাকে কোনো দণ্ড প্রদান করা হয়নি। মোশাররফকে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান ভঙ্গকারী রূপে আখ্যায়িত করেছেন, তিনিও কোনো দণ্ড ভোগ করেননি। ইমরান খানের রাজনৈতিক অস্তিত্বের গ্যারান্টি আইনের শাসনে রয়েছে, গোপন এনআরও-তে নয়। যদি আমার কথাগুলোকে পাগলের স্বপ্ন মনে হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় তা উপেক্ষা করুন। তবে এরপরও আপনার সাথে সেটাই ঘটবে যা জারদারি ও নওয়াজ শরিফের সাথে ঘটছে।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ৩ জানুয়ারি ২০১৯ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement
‘পেশাগত স্বার্থে সাংবাদিকদের ঐক্যবব্ধ হতে হবে’ গাজাবাসীর প্রধান কথা- ‘আমাদের খাবার চাই’ অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সকল