২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘কী ধনে হইয়া ধনী, মণিরে মান না মণি’

‘কী ধনে হইয়া ধনী, মণিরে মান না মণি’ - ছবি : সংগৃহীত

রবিঠাকুরের একটি কবিতার চরণ শিরোনামটি। পঞ্চাশের দশকে স্কুলজীবনে পড়া এ কবিতাটির নাম মনে নেই (আশা করি কোনো পাঠক তা উদ্ধার করতে পারবেন)। পরের লাইনটি ‘তাহারই খানিক মাগি আমি নত শিরে’। এটি কোনো রাজনৈতিক কবিতা নয়। আমাদের দেশের রাজনীতিকদের আচার-আচরণের কথা ভেবে এ চরণ মনে পড়ল। কারণ তারা চড়া গলায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনের কথা বলে থাকেন।

দেশ শাসনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোই গণতন্ত্রের মর্মবাণী আর দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্য মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা। এটা তারা জানেন বলেই জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী তাদের জন্য কিছু প্রতিশ্র“তি দিয়ে থাকেন। এটা নির্বাচনী মেনিফেস্টো নামে পরিচিত। এ ছাড়া তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেও জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চান। এ সবের উদ্দেশ্য জনগণের মন জয় করা, যাতে নির্বাচনে তারা তাদের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় যেতে পারেন। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে ক্ষমতায় যাওয়া চাই। তাই জনগণের ভোটের এত গুরুত্ব এবং জনগণই নির্বাচনে মুখ্য খেলোয়াড়। এ সত্য উপেক্ষা করা যায় না।

আমাদের দেশে জনগণ কী চায়? দেশটি ৯২ শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত এবং ১৭ কোটি লোকের ও ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দরিদ্র আবাসভূমি। এ দেশের লোকজন দারিদ্র্য ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি থেকে মুক্তি চায়। তবে এ দারিদ্র্য ও দুর্নীতি থেকে মুক্তির প্রক্রিয়ায় যেন মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার এবং প্রধানত মুসলমান হিসেবে তাদের ঈমান খর্ব না হয় সেটাও চায়। মুসলমানেরা বিশ্বাস করে ‘সমস্ত জীবনবিধানের উপর বিজয়ী করার জন্য আল্লাহ্ হিদায়াত ও সত্য জীবনবিধান দিয়ে তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন, মুশরিকরা তা অপছন্দ করুক না কেন’ (সূরা আত তাওবা: আয়াত ৩৩)। আর পার্থিব কল্যাণের প্রশ্নে মুসলমানেরা বিশ্বাস করে ‘মানুষের মধ্যে যারা বলে : হে আমাদের রব! এ দুনিয়ায়ই আমাদের দাও।

তাদের জন্য পরকালে কোনো অংশ নেই। আর তাদের মধ্যে যারা বলে : হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ায়ও কল্যাণ দাও এবং আখিরাতেও কল্যাণ দাও, আর রক্ষা করো আমাদের দোজখের আজাব থেকে, তাদের জন্যই রয়েছে তারা যা অর্জন করেছে তার প্রাপ্য অংশ’ (সূরা আল বাকারা : আয়াত ২০০-২০২)। তাদের এ আশা আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে রাসূল সা:-এর প্রতি আল কুরআনের সতর্কবাণী হচ্ছে ‘ইহুদি, নাসারা এবং পৌত্তলিকরা কখনো আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাত অনুসরণ করবেন। বলুন আল্লাহ্র হিদায়াতই প্রকৃত হিদায়াত’ (সূরা আল বাকারা : ১২০)। এ প্রত্যয় নিয়ে দেশে মানবকল্যাণে তারাই এগোতে পারবেন যারা দেশের জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসবেন। আর নির্বাচন কারচুপির মতো দুর্নীতির জরায়ু থেকে যে সরকারের উৎপত্তি, তা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা রক্ষা এবং দুর্নীতি দমনইবা করবে কিভাবে?

বস্তুত স্বাধীনতার পর সেই ১৯৭৩ সাল থেকে আমরা কম-বেশি দেখে আসছি, এ দেশের বাস্তবতা হলো- রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রার্থী রাজনীতিকেরা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ম্যান্ডেটের তোয়াক্কা না করে দম্ভভরে ইচ্ছেমতো একটি সাজানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসীন হন বা থাকেন। তদুপরি ক্ষেত্র বিশেষে বিজাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলেন, এ জন্য আমরা জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছি। তাদের ক্রিয়াকর্ম জনগণের আশা আকাক্সক্ষার পরিপন্থী; যদিও তারা মুসলিমপ্রধান এই দেশে জনগণের মন ভুলাতে ইসলাম ধর্মের কথা বলতে ভোলেন না। বলা হয়েছে ‘মানুষের মাঝে এমন লোকও আছে, পার্থিব জীবন সম্বন্ধে যার কথাবার্তা তোমাকে খুবই উৎফুল্ল করবে। তার মনে যা কিছু আছে, সে সম্বন্ধে সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। প্রকৃতপক্ষে সে ভীষণ বিতণ্ডাকারী। সে যখন ক্ষমতার আসনে বসতে পারে, তখন সে সেখানে অশান্তি সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তুর বংশ নিপাতের চেষ্টা করে। আল্লাহ বিশৃঙ্খলা পছন্দ করেন না। যখন তাকে বলা হয় ‘তুমি আল্লাহকে ভয় করো’, তখন তার আত্মাভিমান তাকে পাপে লিপ্ত করে’ (সূরা আল বাকারা : আয়াত ২০৪-২০৬)। ‘আল্লাহর তরফ থেকে এ সব সুস্পষ্ট নিদর্শন তোমাদের কাছে এসে যাওয়ার পরও যদি তোমরা পদস্খলন ঘটাও, তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখো, আল্লাহ মহাবিজ্ঞ ও পরাক্রমশালী’ (সূরা আল বাকারা : আয়াত ২০৯)। পক্ষান্তরে ‘এ মানুষদের মাঝে এমন কিছু লোকও রয়েছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজেদের জীবন বিক্রি করে দেয়। আল্লাহ এ ধরনের বান্দাদের প্রতি সত্যিই অনুগ্রহশীল’ (সূরা আল বাকারা : আয়াত ২০৭)। অন্যায়কে প্রতিরোধ করাই বিবেকবান মানুষের কর্তব্য।

গত ৩০ ডিসেম্বর যে জাতীয় নির্বাচনটি হয়ে গেল তাকে কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। এতে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, তা যতই লুকানোর চেষ্টা হোক না কেন। কথায় আছে ‘গোয়ালার দুধ গোয়ালা ভালোই’ বলে। ক্ষতিগ্রস্ত ও বিক্ষুব্ধ দলগুলো সরকারের সাথে পরামর্শের মাধ্যমে, যথাশিগগির স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য পুনঃনির্বাচন দাবি করছে। কিন্তু সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এটি ‘অসম্ভব’ এবং ‘মামার বাড়ির আবদার’। দেশটি ১৭ কোটি মানুষের, কোনো দল বা ব্যক্তিবিশেষের নয়। এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেও ভোট দিয়ে জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে কিন্তু কাউকে দেশের মালিক বানায় না। এ ছাড়া আল কুরআনে মুসলমানদের গুণাবলি ও রাষ্ট্রীয় কার্যপদ্ধতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে’ (সূরা আশ শূ-রা: আয়াত ৩৮)। আরো বলা হয়েছে- ‘কাজকর্মে তুমি তাদের সাথে পরামর্শ করবে। তারপর তুমি কোনো সংকল্প করলে আল্লাহ্র ওপর নির্ভর করবে’ (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)। সঙ্কটকালে এ পরামর্শ নিজের দলের সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, এ পরামর্শের ব্যাপ্তি রাষ্ট্রের সব দলকে অন্তর্ভুক্ত করে। যে নির্বাচনে রাষ্ট্রের নাগরিকেরা ভোট দিতে পারেনি, তা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। এই পরিস্থিতিতে একটি হাদিসে উল্লেখ আছে- ‘তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো নিয়ে ওই সব লোকের সাথে পরামর্শ করবে, যারা আল্লাহকে ভয় করে কাজ করে’ (মুসতাদরাকে হাকেম)। সুতরাং উল্লিখিত প্রস্তাব কোনো ‘মামার বাড়ির আবদার’ নয় বরং এতে জনগণের অধিকার আদায়ের প্রশ্ন জড়িত। এর ব্যত্যয় ঘটলে দেশে অশান্তি দেখা দিতে পারে।

অন্যান্য ধর্ম যেমন- ইসলামও তেমনি একটি শান্তির ধর্ম। ইসলামে ‘শান্তি’ বলতে যা বুঝায় তার মর্মকথা হলো, ‘আল্লাহর সাথে শান্তির অর্থ- তার ইচ্ছার প্রতি পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পিত করা। মানুষের সাথে শান্তির অর্থ- এমন জীবনযাপন করা যা কোনো মানুষের শান্তি বিনষ্ট করার কারণ না হয়’ (হাদিস : বুখারি ২/৩)। সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে-পরে দেশে বহু মানুষের শান্তি বিনষ্ট হয়েছে। মানুষে মানুষে শান্তির বুনিয়াদ হলো আলোচনার মাধ্যমে এবং পরস্পর বোঝাপড়া করে কাজ করা। সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনপূর্ব সংলাপে যা আলোচনা হয়েছে, নির্বাচনকালে দেখা গেল এর কিছুই কার্যকর হয়নি। ফলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও সঙ্কটাপূর্ণ হলো। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় সঙ্কট উত্তরণে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সংলাপের রীতি অনুসৃত হয়ে থাকে। তাহলে আমাদের দেশে তা কেন হবে না? এ জাতীয় আলোচনায় উভয়পক্ষের ন্যায়নিষ্ঠাই কাম্য। ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচারের নির্দেশ দেন’ (সূরা আন নাহল : আয়াত ৯০)।

ন্যায়বিচার সম্বন্ধে বিধান হলো ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারের ওপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতামাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায়, সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন হোক, আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠ। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হবে না। যদি তোমরা প্যাঁচালো কথা বলো অথবা পাশ কেটে যাও তবে তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন’ (সূরা আন নিসা : আয়াত ১৩৫)। আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, তারা চাই দেশে ন্যায় ও শান্তির প্রতিষ্ঠা হোক অবিলম্বে ও স্থায়ীভাবে।

এই নিবন্ধে বেশ কিছু কুরআনের আয়াত ও হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। বিগত নির্বাচনের বিষয়ে পার্থিব গবেষকদের কথা সরকার কানে তুলছে না। আশা করি আল্লাহ্ ও রাসূল সা:-এর কথায় তাদের সম্বিত ফিরে আসবে । পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দেশের নাগরিকদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। ইসলামেও এটাই হয়ে থাকে। এ অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা মারাত্মক অন্যায়। জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকদের স্বাধীন মতামত গ্রহণ করা জরুরি। জনগণের মতামত ব্যতিরেকে রাষ্ট্রীয় পদ দখল করা বৈধ নয়। এই ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই সমান। দেশের নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলরা জুলুম করলে এর প্রতিবাদ করা ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বোত্তম ‘জিহাদ’।

তাই বলা হয় ‘জালিম শাসকের সামনে হক কথা বলাই সর্বোত্তম জিহাদ’ (হাদিস : তিরমিজি)। এরূপ বলা হয়েছে এ কারণে যে, রাষ্ট্রের যাবতীয় ব্যয়ভার জনগণই বহন করে। জনগণের শ্রম ও সেবায় দেশ চলে এবং দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঘটে। বস্তুত একটি রাষ্ট্র জনগণের এ জাতীয় ভূমিকা ছাড়া অচল হয়ে যায়। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের ভূমিকা ও অবদানের স্বীকৃতি দেয়া অপরিহার্য। তাদের অধিকার খর্ব করা যায় না কোনো সময়েই। বারবার এ দেশের স্থানীয় এবং বা জাতীয় নির্বাচনে এর অন্যথা কম-বেশি করা হয়। জনগণের শক্তিকে উপেক্ষা করে এবং তাদের অধিকারকে পাশ কাটিয়ে শাসক শ্রেণী কিসের বলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে? যদি কোনো সরকার দেশের মণিসদৃশ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত মতামতকে উপেক্ষা করতে পারে বা করতে চায় সঙ্গত কারণেই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় প্রশ্ন ওঠে ‘কী ধনে হইয়া ধনী, মণিরে মান না মণি’? এ গোপন রহস্যের হদিস সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ জানতে চাইবে এবং সরকারের পক্ষে এর প্রত্যুত্তরে পুনঃনির্বাচন দিয়ে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই উত্তম।
লেখক: অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা কাডার

 


আরো সংবাদ



premium cement
কুলাউড়ায় জঙ্গল থেকে তরুণীর লাশ উদ্ধার ঈদগাঁওতে মাদককারবারি গ্রেফতার শিক্ষায় ব্যাঘাত : ফেসবুক-টিকটক-ইনস্টাগ্রাম-স্ন্যাপচ্যাটের বিরুদ্ধে ২৯০ কোটি ডলারের মামলা আমতলীতে কিশোরীকে অপহরণ শেষে গণধর্ষণ, গ্রেফতার ৩ মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর

সকল