২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নির্বাচনী ইশতেহার ও বিবেকের প্রশ্ন

-

বিরোধী দলের নেত্রীকে জেলে রেখে নির্বাচনে দাঁড়াতে না দিয়ে, বিরোধী নেতাকর্মীদের কারাগারে ঢুকিয়ে কিংবা হামলা-মামলায় হয়রান করে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় নির্বাচনে জিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘অভূতপূর্ব’ নজির স্থাপন করা হলো এবার। একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অবিশ্বাস্য ‘পরাজয়’ মহাজোটের ‘বিজয়’কে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। মাত্রাতিরিক্ত সাফল্য অর্জন করে ক্ষমতাসীন দলীয় সংসদ সদস্যরা বিবেকের তাড়না থাকলে বিব্রত বোধ করবেন। তাদের অনেকের আক্ষেপ, ঐক্যফ্রন্টকে আরেকটু কম ব্যবধানে হারাতে পারলে নির্বাচন ‘অনেকটা মানানসই’ হতো এবং তারা জয়ের প্রকৃত স্বাদ পেতেন। এই নির্বাচনকে ভিত্তি করেই এবার বিজয়ী আর বিজিত উভয় পক্ষকেই নির্বাচনকেন্দ্রিক কার্যক্রমের প্রতিফলের মুখোমুখি হতে হবে।

সংসদ নির্বাচনের অভিঘাতের প্রসঙ্গ সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে এখনো। এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়ে কিছু বলা যেতে পারে। এতে অনেক বিষয়ের সাথে দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ বজায় রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে। মনে হয়, ইশতেহারে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এটা কি ‘১০ টাকা কেজি চাল খাওয়ানো’র মতোই কথার কথা, না কাজে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে; সেটি একটি বড় প্রশ্ন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১০ টাকা কেজি চাল কিংবা ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার চেয়েও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা অনেক বেশি জরুরি বলেই মনে করছেন সচেতন মহল।

বিগত পাঁচ বছর বিরোধী দল কার্যকর আন্দোলনের সূচনাই করতে পারেনি। বরং তাদের নেতাকর্মীরা খুন ও গুম হয়েছেন, মামলায় রিমান্ডে হয়েছেন নাস্তানাবুদ। এমনকি, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ‘দুর্নীতি’র মামলায় জেল দেয়া হয়েছে। তদুপরি প্রচণ্ড বাধার মুখে কেউ আন্দোলনে নামতে পারেনি। সেই তুলনায় কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং এর আগে হেফাজতে ইসলামের আলেমরা সরকারকে বেশ ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে পেরেছিলেন। এ দিকে হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ভল্টের সোনা উবে যাওয়া, বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ খোয়ানো বা মজুদ কয়লা উধাও হয়ে যাওয়ার তো বড় বড় দুর্নীতির বিষয়গুলোই শুধু সরকারের স্বস্তি বিঘিœত করেছে। এসব দুর্নীতির কারণে সরকার দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়েছে।

এসব দুর্নীতির সাথে জড়িত রথী-মহারথীদের প্রতি সরকার কি জিরো টলারেন্স বজায় রেখেছে? একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কি অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি? সিইসিকে ‘বিব্রত ও মর্মাহত’ করে ড. কামাল হোসেন এবং মির্জা ফখরুলের ওপরে হামলা করা হলো। এটা কি নির্বাচনী বিধির মারাত্মক লঙ্ঘন নয়? এবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ১০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়েছে। এ কারণে ঐক্যফ্রন্ট অনেক ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টও দিতে পারেনি। এর পরও যারা জেলের বাইরে ছিলেন, তারা সাহস করে ভোটকেন্দ্রে ঢুকেছিলেন, কিন্তু ভোট গ্রহণ শুরু হতে না হতেই তাদের অনেককে মারধর করে বের করে দেয়ার খবর মিডিয়ায় এসেছে। এসব কি দুর্নীতি আর সন্ত্রাস নয়? বিবিসির সংবাদচিত্রে দেখা গেল, ভোটের আগের রাতেই কোথাও কোথাও ব্যালট পেপারে নৌকায় সিল মেরে বাক্স ভরে রাখা হয়েছে। এসব তো নির্বাচনী দুর্নীতি হিসেবে ভয়াবহ। খুলনা-১ আসনে চরম অনিয়মের খবর জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। ওই আসনে ধানের শীষ ও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দু’জন মোট ভোট পেয়েছেন (২৮১৭০+২৫৩৬৬৯) দুই লাখ ৮১ হাজার ৮৩৯টি। অথচ ওই আসনে ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৫৯ হাজার ৪২০ জন। অর্থাৎ (২৮১৮৩৯-২৫৯৪২০)=২২৪১৯টি অতিরিক্ত ভোট ‘আকাশ থেকে পড়েছে’। এসব দুর্নীতি না হলে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কাকে বলা হয়? ক্ষমতাসীন মহল নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে বিবেকের প্রতি এই প্রশ্নগুলো করা দায়িত্ব।

এত কিছুর পরও বর্তমান সরকার যদি বাস্তবিকই দুর্নীতির মাত্রা অন্তত অর্ধেক কমিয়ে আনতে পারে, তা হলেও দেশের চেহারা অনেকটা পাল্টে যেতে বাধ্য। সরকারি ও বেসরকারি দুর্নীতিবাজদের প্রতি আগামী পাঁচ বছর সরকার যদি জিরো টলারেন্স বজায় রাখে, তাহলে বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্সপ্রবাহ, গ্যাস ও অন্যান্য খনিজসম্পদ, গার্মেন্ট, ওষুধসহ নানা শিল্প, কৃষিজ উৎপাদন ইত্যাদির নিরিখে বলা যায়- বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট যথার্থ উন্নয়ন সাধনের জন্য দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের অপেক্ষায় আছে।


আরো সংবাদ



premium cement