২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাড়ার বন্দুক

-

আজকাল পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘ইউটার্ন’ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। বহু রাজনীতিবিদই তো ইউটার্ন নিয়ে থাকেন, কিন্তু ইমরান খানের ইউটার্ন আমাদের দৃষ্টিতে বেশ বেখাপ্পা মনে হয়। কেননা তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং এ কথা বলতে তিনি লজ্জাবোধ করেন না যে, ভালো নেতা তিনি, যিনি দেয়ালে ধাক্কা খাওয়ার পরিবর্তে ইউটার্ন নিয়ে জাতিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। আজ আমাকেও ইমরান খানকে একটি বিষয়ে ইউটার্ন নেয়ার আবেদন জানাতে হচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বেশির ভাগ পাকিস্তানি আমার সাথে একমত পোষণ করবেন। ইমরান খানকে ইউটার্ন নেয়ার অনুরোধের ধারণা এসেছে তার সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকার শোনে।

তুরস্কের সাম্প্রতিক সফরে তিনি টিআরটির ইমরান গার্ডাকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছেন, অতীতে আমেরিকা পাকিস্তানকে ‘ভাড়ার বন্দুক’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এখন আমরা ভাড়ার বন্দুক হিসেবে আর ব্যবহৃত হতে প্রস্তুত নই। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জেনারেল জিয়াউল হক ও জেনারেল পারভেজ মোশাররফের শাসনামলে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়গুলোর কথাও উল্লেখ করেন। এর আগে তিনি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, এখন আমরা আর আমেরিকার ভাড়ার বন্দুক হবো না। ওয়াশিংটন পোস্ট ওই সাক্ষাৎকারের শিরোনাম করেছে, ‘আমরা তোমাদের ভাড়ার বন্দুক থাকব না- আমেরিকাকে পাকিস্তানি নেতার পয়গাম।’

ওয়াশিংটন পোস্টের লালি ভেমাউথকে দেয়া এ সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের জনগণের বিশাল অংশের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটেছিল। কিন্তু সামনে এগিয়ে ওই সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেন, ষাটের দশকে পাকিস্তান দৃষ্টান্তমূলক উন্নয়নের পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ইমরান খান একাধিকবার ষাটের দশককে ‘উন্নয়নের যুগ’ অভিহিত করেছেন। তিনি যখনই ষাটের দশকের উল্লেখ করেন, তখনই আমাদের সামনে জেনারেল আইয়ুব খানের ছবি ঘুরতে থাকে, যিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসক ছিলেন। জেনারেল আইয়ুব পাকিস্তানের প্রথম সেনা স্বৈরশাসক, যিনি ১৯৫৬ সালের পার্লামেন্টের সংবিধান রহিত করে ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট আইন জারি করেন।

আইয়ুব খানের শাসনামলে প্রবর্তিত প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ককে দুর্বল করে দেয়। কিছু মানুষ বলে, এ যুগে তারবেলা ও মংলা ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে, এ জন্য এ যুগ ছিল উন্নয়নের যুগ। বাস্তব কথা হচ্ছে, জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৬০ সালে সিন্ধু পানি চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের তিনটি নদী রাভি (রবি), সাতলুজ (শতদ্রু) ও বিয়াস (বিপাশা) নদীর পানি ভারতের নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দেন। ওই নদীগুলোর পানি ভারতের নিয়ন্ত্রণে যাওয়াতে পাকিস্তান পানি হ্রাসের সঙ্কটের মুখে পড়তে যাচ্ছিল, সুতরাং কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য সিন্ধু ও ঝিলামের পানি সংরক্ষণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, তন্মধ্যে তারবেলা ও মংলা ড্যামও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু পানি চুক্তির বিরোধিতার ফলে আজো পাকিস্তানকে ঝিলাম ও চেনাবের পানি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যে যুগকে উন্নয়নের যুগ বলা হচ্ছে, সে যুগের চিত্র দেখতে চাইলে ইমরান খান রাভি, সাতলুজ ও বিয়াসকে দেখে নিন, যা নদীর পরিবর্তে দুর্গন্ধময় নালায় পরিণত হয়েছে।

ইমরান খান যখনই ষাটের দশককে ‘উন্নয়নের দশক’ বলেন, তখনই এ ধারণা সৃষ্টি হয় যে, সম্ভবত তিনি সরাসরি পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থাকে সমর্থন করছেন। এ ‘মন্দ ধারণা’র কারণ তার কিছু নিকটতম সঙ্গীর পক্ষ থেকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় পার্লামেন্ট ব্যবস্থার বিরোধিতা এবং কিছু মন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে সংবিধানে ১৮তম সংশোধনীর বিরুদ্ধে সমালোচনা করা। এ ‘মন্দ ধারণা’র আরো একটি কারণ হচ্ছে, আমার গুনাহগার কানে আহমদ শুজা পাশাকে (আইএসআইর সাবেক প্রধান) এ কথা বলতে শুনেছি, পাকিস্তান ও পার্লামেন্ট ব্যবস্থা এক সাথে চলতে পারে না। তিনি আরো বলেছিলেন, তিনি তার পরবর্তী জেনারেশনকে বিলাওয়াল ও হামজা শাহবাজের গোলাম হতে দেবেন না। এরপর এ অধমকে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করার কঠিন ফল ভোগ করতে হয়। ইমরান খানের কাছে নিবেদন, তিনি ষাটের দশকের ব্যাপারে তার অবস্থানের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন। কেননা ওই দশকের প্রশংসার অর্থ জেনারেল আইয়ুব খানের প্রশংসা। আর জেনারেল আইয়ুব খানের প্রশংসার অর্থ, প্রেসিডেনসিয়াল ব্যবস্থার প্রশংসা। আমার ক্ষুদ্র অভিমতে সে ব্যবস্থার সমর্থন করার অর্থ, পাকিস্তানকে দুর্বল করা।

ষাটের দশক উন্নয়নের দশক হলে তা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে নয়, বরং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানেও তা নজরে পড়ত, যা এখন বাংলাদেশ হয়ে গেছে। জেনারেল আইয়ুব খান এক দিকে বাঙালিদের তাদের অধিকার প্রদান করেননি, অন্য দিকে বেলুচদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান শুরু করেন। তিনি কায়েদে আজমের সহচর ও পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে ‘গাদ্দারি’র মামলা গঠন করে তাকে কারাগারে প্রেরণ করেছিলেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি জাস্টিস মুহাম্মদ মুনীরকে আইয়ুব খান তার আইনমন্ত্রী বানান। জাস্টিস মুনীর তার ‘ফ্রম জিন্নাহ টু জিয়া’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে লিখেছেন, তিনি ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের বিশেষ তাগিদে পার্লামেন্টের বাঙালি সদস্যদের সাথে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া বা কনফেডারেশন গঠনের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করলে বাঙালি নেতা রমিজুদ্দীন বলেন, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ; আমরাই পাকিস্তান। যদি আলাদা হতে হয়, তাহলে তোমরাই পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাও। জাস্টিস মুহাম্মদ মুনীরের এ গ্রন্থটি ইমরান খানের পড়া আবশ্যক। আর যদি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের লাইব্রেরিতে এ গ্রন্থ না থাকে, তাহলে এ অধম ওই গ্রন্থ তাকে জোগাড় করে দিতে পারবে। যে ব্যক্তি এটা দাবি করেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান অনেক আগে থেকে ভারতের সাথে যোগসাজশ করে পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছিলেন, তিনি জাস্টিস মুনীরের গ্রন্থের ব্যাপারে কেন নীরব? এ গ্রন্থ কি এ তিক্ত সত্য প্রকাশ করছে না যে, পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র স্বয়ং সেই প্রেসিডেন্ট করেছিলেন, যার শাসনামলকে ‘উন্নয়নের যুগ’ অভিহিত করা হচ্ছে?

ষাটের দশককে উন্নয়নের যুগ অভিহিতকারী এটি কেন ভুলে যান যে, ওই সময় একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আর এ বাস্তবতা সবাই জানেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা মওদূদী, খান আব্দুল গাফফার খানসহ (আইউব খানের ভাষায়) বহু ‘গাদ্দার’ কায়েদে আজমের এই বোনের পক্ষ নিয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল আইয়ুব অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে কায়েদে আজমের বোনকে ‘হারিয়ে দেন’। ষাটের দশক পাকিস্তানে জবাবদিহিতার নামে প্রতিশোধ গ্রহণ, অনিয়ম, কারচুপি ও দুর্নীতির দশক ছিল। হ্যাঁ, সম্পদ ভরপুর দেখা যেত, কেননা জেনারেল আইয়ুব খান সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মোকাবেলায় আমেরিকার পক্ষ নিয়েছিলেন। পেশোয়ারের কাছে বাদাবেরে আমেরিকাকে সেনাঘাঁটি করতে দেয়। এটিই সেই যুগ, যখন পাকিস্তানকে আমেরিকার হাতে ভাড়ার বন্দুক বানিয়ে দেয়া হয়। আজ ইমরান খান বলছেন, আমরা আগামীতে ভাড়ার বন্দুক হবো না। এ সত্য কথা বলায় আমি তাকে সালাম জানাই। তবে পাকিস্তানকে ভাড়ার বন্দুক বানিয়েছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান, সুতরাং ইমরান খান ওই যুগকে উন্নয়নের যুগ বলা বন্ধ করবেন এবং ইউটার্ন নেবেন। এ ইউটার্ন তার জন্য ভালোই প্রমাণিত হবে।

হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১০ জানুয়ারি, ২০১৯ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement