২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অযোধ্যা মামলা এবং সুপ্রিম কোর্ট

অযোধ্যা মসজিদ ভাঙ্গছে উগ্র হিন্দুরা - ছবি : সংগৃহীত

সুপ্রিম কোর্টে অযোধ্যা মামলার ওপর শুনানি মুলতবি হওয়ার পর সঙ্ঘ পরিবার ছাউনিতে আরো একবার হতাশা নেমে এসেছে। অথচ আদালত এ শুনানি ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করেছেন। এ ব্যাপারে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের নেতাদের বক্তব্য শুনে অনুমান করা যায়, তাদের আদালতের কার্যক্রমের ওপর কোনো আস্থাই নেই এবং তারা আদালতের কাছে শুধু সেই কথাটাই শুনতে চাচ্ছে, যা তাদের পছন্দ। সুপ্রিম কোর্ট গত ৪ জানুয়ারি মাত্র এক মিনিট স্থায়ী কার্যক্রমের মধ্যে এতটুকু বলেছেন, আগামী ১০ জানুয়ারি এ মামলার শুনানি নতুন ডিভিশন বেঞ্চ করবেন। আদালতের এ মনোভাবকে টালবাহানা আখ্যায়িত করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপির নেতারা কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

তারা বলেছেন, অযোধ্যা মামলার সমাধান করা সুপ্রিম কোর্টের অগ্রাধিকার তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং টুইটারে এ কথাও লিখেছেন, “এক বাবরের আগমনে এক শ’ কোটি হিন্দুকে হিন্দুস্তানে রাম মন্দিরের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। রাম মন্দিরের কথা বাদ দিন, দেশে রামের নাম নেয়াও কঠিন হয়ে যাবে।” এ ব্যাপারে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের নেতাদের যে বক্তব্য দিয়েছে, এর মাধ্যমে শুধু তাদের নৈরাশ্য প্রকাশ পাচ্ছে তা নয়, বরং এর মাধ্যমে এ কথাও জানা যাচ্ছে- তারা দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর সমালোচনার জন্য যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে নৈরাশ্য প্রকাশের অর্থই হচ্ছে, এরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে সরকার পার্লামেন্ট মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করে রাম মন্দির নির্মাণের পথ সুগম করে। বিজেপি নেতৃবৃন্দ আদালতে দিন পেছানোয় এ বলে কংগ্রেসকেও সমালোচনার লক্ষ্য বানিয়েছে যে, তাদের উকিল আদালতে হাজির হয়ে এ মামলায় বাধা সৃষ্টি করছে এবং কংগ্রেসই এ সমস্যা সমাধানে বাধা হয়ে আছে।

অথচ এ কথা সবাই জানে যে, অযোধ্যা মামলা একটি মারাত্মক জটিল সমস্যা। আর এটি বছরের পর বছর ধরে আদালতে পড়ে রয়েছে। বিরোধী পক্ষ এ সমস্যাকে জটিল করতে কোনো চেষ্টার ত্র“টি করেনি। এমন কোনো আইনি প্রচেষ্টা বাকি নেই, যা এ মামলাকে জটিল করতে ব্যবহার করা হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এ কথা ভালোভাবেই জানেন, এ মামলার সাথে দেশের সাম্প্রদায়িক বন্ধন ও জাতীয় ঐক্য একসূত্রে গাঁথা। অতীতে এ মামলার কারণে বেশ রক্তপাত ঘটেছে। এ জন্য আদালত এ বিষয়ে অতি সতর্ক হয়ে পা ফেলছেন। অযোধ্য মামলা নিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের সাম্প্রতিক অস্থিরতা ও তাড়াহুড়ার মৌলিক কারণ হচ্ছে, তারা এ ইস্যুকে সাধারণ নির্বাচনের আগে নিজেদের পক্ষে ফায়সালা করতে চাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারেরও অবস্থান এমনই। তবে তারা বর্তমানে নিজেদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও আরএসএসের হ্যাঁ-এর সাথে হ্যাঁ মেলাতে পারছে না। অবশ্য মন থেকে তারাও চাচ্ছে, আদালতের ফায়সালা বা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে রাম মন্দির নির্মাণের পথ সুগম হোক। আর তারা এর কৃতিত্ব নিয়ে সাধারণ নির্বাচনে নিশ্চিন্তে ময়দানে নামতে পারবে।

কিন্তু বিষয়টি এত সহজ কখনোই হবে না, যতটা সরকার ও সঙ্ঘ পরিবার মনে করছে। সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা জনসাধারণের মাঝে চূড়ান্তভাবে ভুল ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে যে, দেশের প্রতিটি নাগরিক রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষে। আর তারা অতি দ্রুত অযোধ্যায় এক বিশাল মন্দির নির্মাণের স্বপ্ন দেখছে। অথচ এ ব্যাপারে না এখনো কোনো সার্ভে করানো হয়েছে, আর না জনগণের আগ্রহ দ্বারা তার সমর্থন পাওয়া যায়। স্বয়ং হিন্দুদের বেশির ভাগ রাম মন্দিরকে একটি রাজনৈতিক ইস্যুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় না। কেননা যখনই নির্বাচন কাছে চলে আসে, তখনই সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠনগুলো মন্দিরের সুর তোলে। এ কথা স্পষ্ট যে, তারা এ কাজ শুধু নিজেদের সাম্প্রদায়িক ভোট ব্যাংককে মজবুত করার জন্য করে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন সাধারণ হিন্দুরাও এ কথা বুঝে গেছে, বিজেপির জন্য মন্দির ইস্যু একটি রাজনৈতিক প্রতারণা। তারা এ সমস্যাকে সমাধান করার পক্ষে নয়। সুপ্রিম কোর্টে ভূমির মালিকানাসংক্রান্ত অযোধ্যার মামলা শুনানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আদালতকে অযোধ্যার পৌনে তিন একর ভূমির মালিকানার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ন্যায্যভাবে এ ভূমির মালিক কে?

এ ব্যাপারে আদালত আগেই স্পষ্ট করেছেন যে, তারা এ মামলার ফায়সালা কারো আস্থা বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে করবেন না, বরং তারা প্রমাণের ভিত্তিতে মালিকানা অধিকারের ফায়সালা দেবেন। যখন থেকে আদালত স্পষ্টভাবে এ কথা বলছেন, তখন থেকে সঙ্ঘ পরিবারের ছাউনিতে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। কেননা সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা আদালতে এ চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছে যে, আদালত যেন এ মামলাকে আস্থার ভিত্তিতে ফায়সালা করেন। কিন্তু আদালতের কাজ যেহেতু প্রমাণাদির আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে তারা কারো আস্থা বা বিশ্বাসকে কেন সামনে নিয়ে আসবেন। আদালতের এ ভঙ্গিমা সঙ্ঘ পরিবারকে তাদের কার্যকৌশল পরিবর্তনে বাধ্য করেছে।

আর এ কারণে তারা বিবেকহীন ও বিক্রয় হওয়া কিছু মুসলমানকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে একতরফাভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছে। আর যদি এভাবে সম্ভব না হয়, তাহলে পার্লামেন্টের মাধ্যমে আইন বানিয়ে, আর যদি সেভাবেও সম্ভব না হয়, তাহলে তারা অর্ডিন্যান্স জারি করিয়ে মন্দির নির্মাণের পথ সুগম করতে চাচ্ছে। বর্তমানে বেশ জোরেশোরে মন্দিরের ওপর অর্ডিন্যান্স জারি করানোর দাবি করা হচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও এক টিভি সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এ ব্যাপারে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পরই অর্ডিন্যান্স জারির ব্যাপারে ফায়সালা করা হবে।’ তিনি এ কথাও বলেন, ‘বিচারিক কার্যক্রমকে তার পথে চলতে দিন।

রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর ওপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার হিসেবে যা কিছু আমাদের দায়িত্বে আসবে, আমরা তা পূর্ণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করব।’ আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সাড়ে চার বছরের শাসনকালে প্রথমবারের মতো কোনো সাক্ষাৎকার দিলেন। দেড় ঘণ্টার বেশি দীর্ঘ এ সাক্ষাৎকারের যে অংশটুকু মিডিয়া সবচেয়ে বেশি হাইলাইট করেছে, তা হচ্ছে মন্দির সম্পর্কে অর্ডিন্যান্সের বিষয়ে তার জবাব।

সব টিভি চ্যানেল ও পরদিনের পত্রিকাগুলো অর্ডিন্যান্স-বিষয়ক অংশটুকুকেই শিরোনাম বানায়। এটি এ জন্যও হয়েছে যে, অযোধ্যা মামলা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর এটি প্রথম বক্তব্য ছিল। অথচ তিনি এর আগে গত মাসে অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের প্রচারাভিযানের সময় বলেছিলেন, ‘অযোধ্যা মামলায় বিচারিক কার্যক্রমে কংগ্রেসের উকিল বাধা সৃষ্টি করছেন। তিনি চাচ্ছেন না, এ বিষয়টি দ্রুত ফায়সালা হোক।’ তিনি এ কথাও বলেছিলেন, ‘কংগ্রেসের উকিলদের বাধা সৃষ্টির কারণেই বিষয়টি আদালতে দীর্ঘ সময় পার করছে।’

পক্ষান্তরে, বাস্তবচিত্র হচ্ছে- এগুলো ছিল অবাস্তব কথা। কেননা কংগ্রেস এ মামলার না কোনো পক্ষ, না তার পক্ষ থেকে কোনো উকিল নিয়োগ করেছে। এটি তো ভিন্ন কথা যে, এ বিবাদ সৃষ্টি ও তাকে জটিল রূপ দিতে কংগ্রেস পার্টির ভূমিকাও কম নয়। আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, গত বছর সুপ্রিম কোর্টে অযোধ্যা মামলার শুনানির সময় সিনিয়র উকিল ও কংগ্রেস নেতা কপিল সিবাল সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের উকিল হিসেবে আদালতে হাজির হয়েছিলেন এবং তিনি তার মক্কেলের পক্ষ থেকে বলেছিলেন, এ মামলার শুনানি সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত মুলতবি করা হোক। কেননা এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা ওঠানো হতে পারে। কপিল সিবালের আদালতে প্রদত্ত এ বক্তব্যকে বিজেপি এক বড় রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়েছে এবং তারা কংগ্রেসের ওপর চড়াও হচ্ছে। অথচ কংগ্রেস কপিল সিবালকে এ মামলায় উকিল হিসেবে কাজ করতে বিরত থাকতে বলেছে। এরপর কপিল সিবাল কখনো এ মামলার জন্য আদালতে উপস্থিত হননি।

কিন্তু বিজেপি এ বিষয়টিকে এখন পর্যন্ত কংগ্রেসকে আক্রমণের জন্য ব্যবহার করছে। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সাক্ষাৎকারে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর তার দায়িত্ব পূর্ণ করার যে কথা বলেছেন, তিনি কি তার ওপর অটল থাকবেন? মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, যদি আদালত বাবরি মসজিদের পক্ষে ফায়সালা ঘোষণা করেন, তিনি কি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাবরি মসজিদ নতুন করে নির্মাণের দায়িত্ব পালন করবেন? প্রকাশ থাকে যে, আদালতের ফায়সালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকার ও সরকারি সংস্থাগুলোর ওপর বর্তাবে। আর এ অবস্থায় যখন তিনি নিজের দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর ওয়াদা করেছেন, তখন তাকে বাবরি মসজিদ নতুন করে নির্মাণের পথও সুগম করতে হবে।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস ৬ জানুয়ারি,
২০১৯ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ সখীপুরে সাবেক ও বর্তমান এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস সৈয়দপুরে জামায়াতের উদ্যোগে সালাতুল ইসতিসকার নামাজ আদায় জিম্বাবুয়ে সিরিজের শুরুতে না থাকার কারণ জানালেন সাকিব ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৮ এপ্রিল খুলে দেয়ার প্রস্তুতি, ক্লাস চলবে শনিবারও মিরসরাইয়ে জুস খাইয়ে অজ্ঞান করে লুট, মূল হোতা গ্রেফতার

সকল