২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জাতীয়করণ থেকে ক্যাডার সার্ভিসভুক্তকরণ

-

বেসরকারি শিক্ষকেরা কেন তাদের চাকরি জাতীয়করণ চান? এমন প্রশ্নের তিনটি উত্তর আমরা খুঁজে পাই। প্রথমত চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ; দ্বিতীয়ত সময়োপযোগী অর্থনৈতিক সুবিধা প্রাপ্তি এবং তৃতীয়ত সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি।

বেসরকারি শিক্ষকের মূল প্রারম্ভিক বেতন হতে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বাবদ শতকরা ৬ ভাগ বেতন কেটে রাখা হয় এবং চিকিৎসা ও বাড়ি ভাড়া বাবদ এক হাজার ৫০০ টাকা দেয়া হয়। এ অবস্থায় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাস্তব জীবনে টিকে থাকা বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই যুগোপযোগী অর্থনৈতিক সাপোর্ট পেতে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ প্রয়োজন।

বেসরকারি শিক্ষকেরা সামাজিক মর্যাদা পেতে চান অথবা সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে চান। তাই তারা চাকরি জাতীয়করণের মাধ্যমে ক্যাডারভুক্ত হতে চান। অনেকটা কাছাকাছি সময়ে জাতীয়করণ হওয়া ২৮৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে কলেজ শিক্ষকেরা ক্যাডারভুক্ত হতে চান। পূর্বে তাদের আন্দোলন চাকরি জাতীয়করণের ছিল, ক্যাডারভুক্তকরণের জন্য নয়।

বেসরকারি শিক্ষকদের কি ক্যাডারভুক্ত করা যায়? বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া খানিকটা সহজ। অপ্রিয় হলেও একথা সত্য এবং এটা অনেকটা ওপেন সিক্রেট যে, বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হয়। এত কিছুর পরও যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণী কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালিত হয়, ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা দীর্ঘ দিন শ্রেণী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে করতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হয়ে ওঠেন। ফলে তারা বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের শিক্ষকদের সমপর্যায়ে উন্নীত হয়। প্রশ্ন হলো তাদের ক্যাডারভুক্ত করা যাবে কিনা? সরকার একটি আত্তীকরণ বিধিমালা জারি করতে যাচ্ছে। বিধিমালা অনুযায়ী, জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে যাদের বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা রয়েছে; তারা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীনে পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। যাদের তা নেই, তারা ক্যাডারভুক্ত হবেন না; নিজ নিজ কলেজে চাকরি করবেন। তাদের চাকরি স্থানান্তরযোগ্য হবে না।

অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষরা নিজ নিজ পদে থাকবেন। নিরপক্ষে দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, জাতীয়করণকৃতদের ক্যাডারভুক্ত করা নিরর্থক। আবার অন্য দৃষ্টি থেকে বলা যায় এটা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। তাই তাদের ক্যাডারভুক্ত করা যাবে না। তাদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় বিতর্কে না গিয়ে তাদের ক্যাডারভুক্তিকরণের বাইরে রাখা দরকার। তবে তারা পদোন্নতির যোগ্য হবেন। সর্বোচ্চ স্তর অধ্যাপক পদে অবস্থানে সরকার নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা আরোপ করতে পারে। যেমন চাকরির অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি। সর্বোচ্চ স্তর অধ্যাপক পদে উন্নিত হওয়ার পর শতকরা ৪০ ভাগ শিক্ষা প্রশাসনের পদ তাদের জন্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। গত কয়েক দশকে আমরা লক্ষ করি, বেসরকারি দুই শক্তিশালী শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ মাজহার হান্নান এবং অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদকে যথাক্রমে খুলনা বিশ^বিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ট্রেজারার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এগুলো শুভ দৃষ্টান্ত।

জাতীয়করণকৃত শিক্ষকদের স্বার্থ গোষ্ঠীগত স্বার্থ। তাদের ক্যাডারভুক্ত করলে গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষা পায়। অন্য দিকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগদান জাতীয় স্বার্থ। এ দুই ধরনের স্বার্থের মধ্যে শেষেরটি উৎকৃষ্ট। আমরা লক্ষ করি, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে যেভাবে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে; তাতে গড় পাসের হার শতকরা দুই ভাগের কম। তাই জাতীয় স্বার্থে ক্যাডার সার্ভিসকে বিতর্কিত করা যাবে না। সরকার যদি বেসরকারি শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করে, তাহলে সরকারের আরো অনেক বিভাগ রয়েছে যেখানে নিয়োগকৃত কর্মকর্তারা ক্যাডারভুক্ত হতে আন্দোলন করবেন।

তাই সরকারের কোনো সিদ্ধান্তই নন-ক্যাডারদের ক্যাডার হওয়ার আন্দোলনের সুযোগ তৈরি করবে কিনা তা সরকারকেই ভেবে দেখতে হবে। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো একমাত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরিবারের সদস্য হওয়ার জন্য যারা নির্বাচিত হবেন তারাই হবেন ক্যাডার। অন্যদের এখানে প্রবেশের কোনো সুযোগ থাকবে না। অথবা প্রয়োজন নেই। অন্যরা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যথাযথ মর্যাদার সাথে চাকরি করবেন। আমরা সব পক্ষকে মর্যাদার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব।

পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, অন্তত শতকরা আশি ভাগ বেসরকারি কলেজ শিক্ষক বিসিএস পরিবারের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদনের যোগ্যতা রাখেন। তাদের অনেকে বিভিন্ন কারণে ওই পরিবারের সদস্য হতে ব্যর্থ হয়েছেন। অনুকূল পরিবেশ অথবা সৌভাগ্যের কারণে ও কিছুটা যোগ্যতার প্রমাণ দেখাতে পারার কারণে তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। তারা ভালোভাবে অবগত রয়েছেন; ক্যাডার সার্ভিস সম্পর্কে। তাই জাতীয়করণের মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখা একটা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। সমাজ বা রাষ্ট্র তা প্রত্যাশা করে না। তবে এ কথা সত্য, তারা ক্যাডার সার্ভিসার্স তৈরি করে থাকেন। তারা ক্যাডার সার্ভিস নন তবে ক্যাডার সার্ভিসের কারিগর। তাই তাদের নিজ অবস্থানে মর্যাদার আসনে রাখতে হবে। যাতে ক্যাডারভুক্তরাও তাদের যথাযথ সম্মান করেন। বেসরকারি শিক্ষক অথবা নন-ক্যাডারভুক্ত কেউ যদি ক্যাডারভুক্ত হতে চান, তাহলে সরকার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে তা করতে পারবে এমন বিধান রাখতে হবে। তা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে করতে হবে।

ব্রিটিশ আমলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য নিয়োগের পাঁচটি পদ্ধতির মধ্যে চতুর্থ পদ্ধতি ছিল প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস হতে প্রমোশনের মাধ্যমে। এসব অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমানে আমাদের দেশে একটি নির্দিষ্ট বয়সের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যে বিসিএস ক্যাডার সদস্য নিয়োগ করা হয়, তাকে আরো সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন বিভাগ থেকে বয়স্ক বিসিএস সিনিয়র সদস্য নিয়োগের বিধান করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ হিসেবে ¯œাতক কলেজের জাতীয়করণকৃতদের পূর্ববর্তী সব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক পদে যথাক্রমে ১২ বছর, ১৮ বছর এবং ২০ বছরের অভিজ্ঞতার ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের অভিজ্ঞতা আরো কিছুটা বেশির বিধান রেখে ওইসব পদে পদোন্নতির জন্য পিএসসির মাধ্যমে পরীক্ষাতে অবতীর্ণ হয়ে সফল হওয়াসহ প্রকাশনা, প্রশিক্ষণ প্রভৃতির বিধান চালু করা যেতে পারে।

একই সাথে তাদের বিসিএস ক্যাডার করা যেতে পারে। এভাবে কোনো বিধান করলে বর্তমান বিসিএস ক্যাডারভুক্তদের তাতে বিরোধিতার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকবে না। যদি বিরোধিতা করে তাহলে তাতে তাদের ঈর্ষণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে; যা হবে অগ্রহণযোগ্য এবং তা উচ্ছৃঙ্খলতা বলে প্রমাণিত হবে। বর্তমান সরকার জাতীয়করণকৃতদের পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত করার যে পরিকল্পনা তৈরি করেছে তা যথার্থ উদ্যোগ; এর আরো সংস্কার করা যেতে পারে।

এ ছাড়াও বিপিএসসির বাইরে মেধাবী অফিসার (ক্যাডারভুক্ত নন) নিয়োগে অন্যান্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেমন ব্যাংক সেক্টর, বীমা সেক্টর, করপোরেট হাউজসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো করে আরো কয়েকটি কমিশন বা Bangladesh Government officers Recruitment Board (BGORB) গঠন করে মেধাবী অফিসার নিয়োগের পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। 
লেখক : প্রেসিডিয়াম মেম্বার, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি
ই-মেইল : kazimain@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement