২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এই নিষ্প্রাণ নির্বাচন কি চেয়েছিলাম?

এই নিষ্প্রাণ নির্বাচন কি চেয়েছিলাম? - ছবি : সংগৃহীত

এ দেশে জনগণের ভোটের অধিকার এমনিতে আসেনি। অনেক ত্যাগ কষ্ট ও সংগ্রামের বিনিময়ে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেও তা আজ প্রায় ভূলুণ্ঠিত। ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। নাগরিকেরা আশা করেছিল দলীয় সরকারের অধীনে হয়তো এবার সুষ্ঠু,অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন জাতিকে প্রহসনের নির্বাচন উপহার দিলো। ক্ষমতাসীন দল এ নির্বাচনকে ‘ইতিহাসের মাইলফলক’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও প্রধান বিরোধী জোট, বাসদ, ইসলামী আন্দোলন এ নির্বাচনকে তামাশার নির্বাচন বলে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল দীর্ঘ ১০ বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট দেবে।

কিন্তু অনেকে নিজের ভোটটি দিতে পারেনি। তবু একশ্রেণীর গণমাধ্যম ও আওয়ামী ঘরানার সুশীলরা বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে এর চেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অতীতে হয়নি। তাদের কথা যদি সত্য হয় তাহলে এটাও ঠিক ১৯৭৩ সালের নির্বাচন ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ‘প্রহসনের নির্বাচন’। সে নির্বাচন কেমন ছিল তা আজকের তরুণ প্রজন্ম না জানলেও মুরুব্বিরা মনে রেখেছেন। ওই নির্বাচন ছিল নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। ক্ষমতার দাপটের কাছে ওই সময় বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা খুবই অসহায় ছিলেন। মাত্র ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জাসদের ভাগ্যে জুটেছিল মাত্র একটি আসন। অথচ জাসদ অতীত ভুলে নৌকার কাঁধে সওয়ার হয়ে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছে। যা হোক, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ইতিহাস কখনো শুভ হয় না। তার পরও ক্ষমতাসীনেরা এমন নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য।

একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা জনগণের পক্ষ থেকে করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা পূরণ হয়নি। তবে ক্ষমতার দাপটের কাছে জনগণ কখনো হারেনি। দৃশ্যত এবারের নির্বাচনে গণতন্ত্রকামী জনগণ হেরেছে। তবে অধিকারকে চিরস্থায়ীভাবে কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দলের দাপটে বিরোধী জোটের প্রার্থীরা শুধু এজেন্ট দিতে পারেনি তা কিন্তু নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও এজেন্ট দিতে পারেনি। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ৪০ হাজার কেন্দ্রে কী করে ভোট কারচুপি করা সম্ভব? সব কেন্দ্রে ভোট কারচুপি হয়েছে, তা মোটা দাগে বলা যাবে না। তবে অনেকে ভোটকেন্দ্রে গিয়েও নিজের ভোটটা দিতে পারেননি। একজন তরুণ ভোটার আমাকে আক্ষেপ করে বলছে, জীবনের প্রথম ভোট দেয়ার জন্য কেন্দ্রে গিয়েছিলাম।’ কিন্তু ভোট দিতে পারেনি। ‘নৌকার লোকজন আমাকে ধানের শীষের মনে করে ভোট দিতে দেয়নি। এই দুঃখ জীবনেও ভুলতে পারব না। এরই নাম যদি হয় ভোট, তাহলে নির্বাচনের কী দরকার ছিল?’ এরকম অভিজ্ঞতা দু’একজনের তা কিন্তু নয়, বেশির ভাগ ভোটারের। তবে আমরা মনে করি, কেন এরকম ভোট হলো তার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার হতাহতের চিত্র দেশবাসীর মনে উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। তার পরও আমরা আশা করেছিলাম অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু হলো না। এবারের নির্বাচনে যে বিষয়টি জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে তা হলো, ক্ষমতাসীনদলের কর্তৃত্ববাদিতা।

অতীতে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের গায়ে হাত তোলার দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়নি। কিন্তু এবার এমন ঘটনাও ঘটেছে। বিএনপির কয়েকজন প্রার্থী শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। একটি দেশের সব রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তখন তাকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা হয়। কিন্তু গ্রহণযোগ্য কিংবা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে বলা যায় না। কেননা একটি নির্বাচনের ফলাফলই বলে দেয় নির্বাচনটি কেমন হয়েছে। আমরা কখনোই মন্দের ভালো কিংবা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন প্রত্যাশা করি না। তবু একপেশে হওয়ার কারণে অনেকের মতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনে কোনো কারচুপি হয়নি এটা নিশ্চিত করে ক্ষমতাসীনেরাও বলেনি। কেননা গণমাধ্যমে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে নির্বাচনে কিছু কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছে। একদলীয় শাসন দেশের জন্য সুখকর নয়। সংঘাতের রাজনীতি যদি আমরা পরিহার করতে পারতাম তাহলে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাক্সক্ষা থাকে না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকারের মেয়াদ শেষে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৭ বছরের ইতিহাসেও গড়ে ওঠেনি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন আসনের ফলাফলে নৌকা প্রতীকের বিপরীতে ধানের শীষের যে ভোট দেখা যাচ্ছে সেটি অনেকের কাছেই অস্বাভাবিক। অনেক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যত ভোট পেয়েছে বিএনপির প্রার্থী তার মাত্র ১ শতাংশ পেয়েছে। পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে যে বিএনপির শতাধিক প্রার্থী তার নিজ ভোটকেন্দ্রে মাত্র একটি ভোট পেয়েছেন। তা কি করে সম্ভব? উভয় দলের ভোটের এতটা তারতম্য হবে সেটি কারও কাম্য ছিল না। যেখানে হাতপাখার এজেন্ট পাওয়া গেছে সেখানে বিএনপির এজেন্ট কেন পাওয়া যায়নি, তা কেউ খতিয়ে দেখছে না। কারণগুলো বিশ্লেষণ করলেই অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। মিডিয়ার উচিত নিরপেক্ষভাবে বিষয়টির তথ্য উদঘাটন করা। গত ১০ বছর নির্বাচন কমিশন পরিচালিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে বিএনপি দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল। প্রচণ্ড বৈরী পরিবেশের মধ্যেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ৩০০ আসনে একাধিক প্রার্থী দিতে পেরেছে, সেখানে নির্বাচনী এজেন্ট তারা দিতে পারেনি, তা কি বিশ্বাসযোগ্য?

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনে যাওয়া ব্যতীত আর কোনো বিকল্প ছিল না। নির্বাচনে গিয়েই তারা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রহসনের ভোট অনুষ্ঠানের ঘটনা বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচন করেছে। ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীন দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলেও দেশের মানুষ হেরেছে এবং গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছে। একজন বিদেশী সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেন, নির্বাচন নিয়ে আপনি হতাশ কি না। জবাবে কামাল হোসেন বলেন,শুধু হতাশ নই, মর্মাহত। অভিধানে এর চেয়েও কঠিন শব্দ থাকলে লিখুন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সংসদ নির্বাচনে নানা অনিয়ম ও সহিংসতায় ১৯ জন নিহত হওয়া,বলপ্রয়োগ ও বহুমুখী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

তফসিল ঘোষণার পর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ থাকার কথা থাকলেও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নির্বাচন কমিশন নিতে পারেনি। সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। সেই অর্থে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ছিল। কিন্তু বাইরে ফিটফাট ভেতরে যে সদরঘাট তা বিরোধী জোট টের পায়নি বলেই এরকম ফলাফল হয়েছে। বিশ্বের কোথাও জাতীয় নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েনি বললেই চলে। তবু আমাদের দেশে হয়েছে। কিভাবে সম্ভব হয়েছে, তা হয়তো উন্মোচন করা হবে। পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে যে, খুলনা-১ আসনের মোট ভোটার দুই লাখ ৫৯ হাজার ৪২০ জন। নৌকা প্রতীক ভোট পেয়েছে দুই লাখ ৫৩ হাজার ৬৬৯,ধানের শীষ পেয়েছে ২৮ হাজার ১৭০। নৌকা আর ধানের শীষের ভোট যোগ করলে হয় দুই লাখ ৮১ হাজার ১৭০ ভোট, যা মোট ভোটারের চেয়েও ২২ হাজার ৪১৯ ভোট বেশি। এটা কী করে সম্ভব হলো তার জবাব আসা প্রয়োজন। স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১০টি জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, নির্বাচনের মধ্যে যেগুলো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার একটিও অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হয়নি। পক্ষান্তরে যে কয়টি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় হয়েছে ঠিকই। কিন্তু একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া যে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না তা এই নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো প্রমাণিত হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement