২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিভ্রান্তির নমুনা ও আত্মরক্ষার উপায়

-

মানব জাতির প্রধান শত্রু ইবলিস। আল্লাহর হুকুম চ্যালেঞ্জ করে সে হয়েছে শয়তান। তার প্রধান কাজই হলো আল্লাহর পথ থেকে সবাইকে দূরে রাখা। তবে শয়তানে পরিণত হওয়ার আগে সে ছিল আল্লাহ পাকের অতি অনুগত বান্দা। আল্লাহর ইবাদতে সে ছিল একনিষ্ঠ। ইবাদত করে সে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ফেরেশতাদেরকেও। তাই সে জানে ইবাদতের নাড়ি-নক্ষত্র এবং ভালো করেই জানে ইবাদতগুজার বান্দাদেরকে ধোঁকায় ফেলার অপকৌশল। সে জানে আমল নষ্ট করার যাবতীয় কায়দা-কানুনও। আর যেহেতু মুসলমানদেরকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করতে হয় নিয়মিত, তাই মুসলমানেরাই শয়তানের ‘প্রধান কর্মক্ষেত্র’। এ কারণেই মুসলমানদের মধ্যে এত বিভক্তি। সেই বিভেদে শয়তান এখন তুলেছে জোয়ার। মতভেদ হানা দিয়েছে ঘরে ঘরে। অতি আবশ্যক প্রাত্যহিক ইবাদতের মধ্যেও সৃষ্টি হয়ে চলেছে দ্বন্দ্ব, সংশয় আর সঙ্ঘাত। এতে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে ‘সফট টার্গেট’ হিসেবে খ্যাত নারীসমাজ।

প্রচার করা হচ্ছে, নারী-পুরুষের নামাজের মধ্যে ‘কোনো পার্থক্য নেই’। বলা হচ্ছে, ‘নবীজী সা: যেভাবে নামাজ পড়া শিখেছেন জিব্রাইল আ:-এর কাছে সেটাই অনুসরণ করতে হবে নারীদেরকেও; তা না হলে নামাজ আদায় হবে না।’ আপাতদৃষ্টিতে খুবই যথার্থ কথা। নবীজীকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা যেকোনো ক্ষেত্রেই কাম্য। তবে সত্যটি হচ্ছে, নবীজী সা: নামাজের মধ্যে তাকবির বলতেন জোরে এবং প্রয়োজন মতো তেলাওয়াতও করেছেন উচ্চস্বরে। কিন্তু নারীদের তাকবির ও তেলাওয়াত করতে হয় নীরবে, মনে মনে। এমনকি যারা নবী করিম সা:কে কঠিনভাবে মেনে চলার কথা বলেন, সেসব নারীও কখনো জোরে তেলাওয়াত করেন না এবং তাকবিরও বলেন না উচ্চস্বরে। বস্তুত উচ্চস্বরে তাকবির ও তেলাওয়াত না করতে পারার কারণেই নারীদের পক্ষে নিজেদের মধ্যেও জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ পড়া সম্ভব নয়। কারণ, জামাতের নামাজে উচ্চস্বরে তাকবির বলা ছাড়া উপায় থাকে না। পুরুষ ও নারীদের নামাজের মধ্যে এটি একটি মৌলিক পার্থক্য। এটি মহানবীরই শিখিয়ে যাওয়া নারীদের নামাজের নিয়ম যা কোনো কালে কোনো নারী কখনো চ্যালেঞ্জ করেননি। এত বড় পার্থক্যের পরও ‘নারী-পুরুষের নামাজের মধ্যে কোনো তফাত নেই’ দাবি করা গুরুতর মিথ্যাচার। নবীজীকে অনুসরণের অজুহাতে এহেন জঘন্য মিথ্যাচার বস্তুত এক ধরনের শয়তানি কর্মকাণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়।

শুধু তাকবির ও তেলাওয়াতই নয়; বরং নামাজের মধ্যে দাঁড়ানো এবং ওঠা-বসা ও রুকু-সেজদার মধ্যেও পুরুষদের অনুকরণ করার কোনো সুযোগ নারীদের নেই। কারণ নারী ও পুরুষের একে অন্যের বেশ ধরা, তথা একে অন্যকে অনুকরণ করা ইসলামে হারাম (সহি বুখারি শরিফ দ্রষ্টব্য)। এই নিষেধাজ্ঞা শুধু পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যেই সীমিত নয়; জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেই অনুকরণ যদি নামাজের মধ্যে করা হয় তাহলে তা যে বিরাট ভুল ও অন্যায় হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। উপরন্তু পুরুষের মতো নামাজ পড়তে গেলে নারীদের জন্য অবধারিতভাবেই সৃষ্টি হবে পর্দাহীন অবস্থার, তখন সেখান থেকে ফেরেশতাদেরও সরে যাওয়ার কথা। অথচ সে কাজটিই এখন করা হচ্ছে খোদ নবীজীর দোহাই দিয়ে। এর পরিণতি গুরুতর হতে বাধ্য। এই ফেতনা বস্তুত শয়তানের বড় একটা সফলতা। কারণ মায়েদের নামাজ নষ্ট করতে পারার মানে হলো, পুরো পরিবারের আমল ধ্বংস করার পথ পেয়ে যাওয়া। এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল রীতিমতো ভয়ঙ্কর।

মৌলিক এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় না নিয়ে নামাজ-সংক্রান্ত কোনো কোনো হাদিস ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টাই মূলত নারীদের এই বিভ্রান্তির কারণ। বুখারি শরিফের একটি হাদিস অনুযায়ীÑ নবীজী সা: কোনো এক মজলিসে উপস্থিত সাহাবিদের লক্ষ করে বলেছিলেন, ‘আমি যেভাবে নামাজ পড়ছি, তোমরাও ঠিক সেভাবে নামাজ পড়ো।’ হাদিসটির পর্যালোচনায় দেখা যায়, মজলিসটি ছিল পুরুষদের, কোনো নারী সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তাই নবীজীর নির্দেশও ছিল সে মোতাবেক। আর সেজন্যই শুধু ওই হাদিসকে ভিত্তি করে নারীদের নামাজকে পুরুষের মতো বলা খুবই অনৈতিক ও অযৌক্তিক।

এমন সহজ সত্যও এখন আমরা আর সহজভাবে মানতে পারি না। কারণ আমরা অনেকে মনে করি, আমার হুজুর বা স্কলারই একমাত্র সঠিক, তারা কখনো ভুল করতে পারেন না। বস্তুত এটা হলো সেই অহং, যে কারণে ইবলিস বহিষ্কৃত হয়েছিল জান্নাত থেকে ধিকৃত শয়তান হিসেবে। এই অহংই প্রকৃত জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক পরম সত্যকে মানার পথে মূল বাধা। কাউকে ভক্তি করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই যে, একমাত্র আল্লাহ পাক ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই সর্বজ্ঞ বা নির্ভুল হওয়া সম্ভব নয়। এই গুণ শুধু আল্লাহ পাকের একক বিশেষত্ব। অন্য কাউকে সে রকম মনে করা আল্লাহর সাথে শিরক করার শামিল। সে কারণেই লাখ লাখ হাদিস কণ্ঠস্থ থাকার পরও ইমাম বুখারি রহ:কে সর্বজ্ঞ বলা হয় না। একই কারণে ডা: জাকির নায়েকের শত শত বই মুখস্থ থাকলেও তাকে সর্বজ্ঞ ভাবা যায় না। অন্যান্য হুজুর-স্কলারকেও নির্ভুল ভাবার কোনো সুযোগ নেই।

উল্লেখ্য আল্লাহর দরবারে হিসাব দিতে হবে একাকী। কোনো পীর, দরবেশ বা স্কলার সেখানে কাজে আসবেন না। তাই আলেমদের কাছ থেকে শিখতে হবে ঠিকই তা কিন্তু আমল করতে হবে নিজের বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে; সঠিক পদ্ধতি এবং ঠিকভাবে বুঝে। তবেই তা আমাদের উপকারে আসবে নতুবা জীবন নষ্ট হবে। তেমন বুদ্ধিদীপ্ত যথার্থ উপলব্ধি সহকারে পৌঁছানোর পথ বলে দিয়ে গেছেন আল্লাহর রাসূল সা:। তিনি বলেছেন- তাঁর সাহাবিরাই সর্বশ্রেষ্ঠ, তারপর তাবেইনগণ; অতঃপর তাবে-তাবেইনগণ (সহি বুখারি)। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এমনও থাকবে যাদের কুরআন তেলাওয়াত হবে সুমধুর, কিন্তু তেলাওয়াতের সেই বাণী তাদের হৃদয়ে পৌঁছবে না; বরং গলায়ই আটকে থাকবে। এটি বলা হয়েছে বিভিন্ন বিবরণীতে। অর্থাৎ কুরআন ও হাদিসের প্রকৃত জ্ঞানের যথার্থ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্য শুরুর ওই তিন প্রজন্মই শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত, অন্য কেউ নন। তারা হলেন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আল্লাহ ও তার রাসূল সা:-এর সেসব নির্বাচিত ‘আমির’, যাদেরকে মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ পাক স্বয়ং (সূরা নিসা, আয়াত ৫৯)। এ কারণেই মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত ইমামদের সবাই ওই তিন প্রজন্মভুক্ত। তাদের সম্মানিত ইমাম বানিয়েছেন আল্লাহ স্বয়ং। এভাবে মানুষকে দিয়েই আল্লাহ পাক তাঁর দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে সুসংরক্ষিত রাখার ওয়াদা পূরণ করে চলেছেন।

এক কুরআন ও এক রাসূল সা: থেকে একাধিক মাজহাব ও অনেক হাদিস গ্রন্থের ব্যবস্থা করে আল্লাহ পাক মানব জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মানুষের পক্ষে কখনোই সর্বজ্ঞানী হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সর্বজ্ঞানী শুধুই মহান আল্লাহ তায়ালা। তাই অন্য সব বিষয়ের মতো ইসলাম নিয়েও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। বিষয়টি একই মামলার বিচারে বিচারকদের ভিন্ন ভিন্ন রায়ের মতো। মূল আইনের মধ্য থেকে দেয়া হয় বিধায় একই বিচারে তেমন ভিন্নতাও আইনসিদ্ধ। অবশ্য যেনতেন সবার মতামতই গ্রহণযোগ্য নয়। মতামত গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য অনুমোদিত বিশেষজ্ঞ হওয়া আবশ্যক। কিয়ামত অবধি মানুষ কুরআনভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যত ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, তার সবই সমাধান করা সম্ভব বিভিন্ন মাজহাব এবং হাদিস গ্রন্থ দিয়ে। সুযোগ্য আলেম, ওলামা ও বুজুর্গ ব্যক্তিরা কখনোই সম্মানিত ইমামদের বিশ্লেষণের বাইরে কথা বলেন না।

পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, গুগল ও ইউটিউবের ওপর ভর করে কেউ কেউ ইসলামের মূল ইমামদের চেয়েও বেশি জানার দাবি করছেন ইদানীং। এমনকি ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মতো ব্যক্তিত্বেরও ‘ভুল’ ধরা হচ্ছে প্রকাশ্যে। বলা হচ্ছে, সব হাদিস জানা না থাকার কারণে তিনি ভুল ফতোয়া দিয়েছিলেন। সামান্য বাড়ি-গাড়ির দলিল বুঝতেও যেখানে যোগ্য উকিল ধরতে হয়, সেখানে নেট থেকে ইসলামের সব দলিল ‘বুঝে ফেলা’র দাবি করা নিতান্তই হাস্যকর। ইমাম আবু হানিফা রহ: হলেন সেই অতি ভাগ্যবান তাবেইন যিনি অন্তত ২৫ জন সাহাবির সরাসরি সাহচর্য লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই তার ‘ভুল’ ধরার সাধ্য এ যুগের কারো থাকার কথা নয়। মনে রাখা আবশ্যক, হাতে অর্থকড়ি থাকলেই যেমন ব্যবসায়ী হওয়া যায় না তেমনি কম্পিউটার ভরা তথ্য থাকলেই কুরআন সম্পর্কে বিদ্বান হওয়া যায় না। আল কুরআনকে জানতে প্রয়োজন আল্লাহ তায়ালার নিরবচ্ছিন্ন পরম রহমত। নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে সমস্ত বিভ্রান্তির সমাধান। মহান আল্লাহ সেটাই চান। তিনি চান, বান্দারা অন্য কোথাও ধরনা না দিয়ে তাঁর কাছেই ফিরে আসবে সব সমস্যা নিয়ে।

অর্থাৎ বিবাদ-বিসংবাদ এবং ভ্রান্তি ও সমস্যার মধ্যেও রয়েছে আল্লাহ পাকের অনুপম হেকমত। কারণ তেমন সমস্যা ঈমানদারদের করে থাকে আরো আল্লাহমুখী আর অন্যরা নিজেদের মতো সমাধান খুঁজতে গিয়ে হয়ে পড়ে আরো বিভ্রান্ত। এভাবেই আল্লাহ আলাদা করে থাকেন সাচ্চা ঈমানদারদেরকে অন্যদের থেকে।

কুরআনি জ্ঞানের অন্তহীন মহাসমুদ্র থেকে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়। তাই চাইতে হবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছেই। তিনিই দেখাবেন পথ, জানাবেন যথাযথ তথ্য এবং দেবেন যথার্থ সমাধান। আল্লাহ অবশ্যই আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। শেষ বিচারের আসরে মানুষের অজুহাত দেখানো বন্ধ করতে তা করবেন। কেবল তিনি আহকামুল হাকিমীন তথা সব বিচারকের চেয়ে সেরা ও সূক্ষ্ম বিচারক। আর এভাবেই সম্ভব শয়তানের শত ধোঁকাবাজির মুখেও ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকা এবং আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের কার্যকর অনুশীলন করে যাওয়া।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলস প্রবাসী
লেখকের বই পেতে: Search 'Mainul Ahsan' at 'amazon.com'


আরো সংবাদ



premium cement