২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কর্তারপুর করিডোর, এরপর ...

ইমরান খান ও নবজ্যোত সিং সিধু - ছবি : সংগ্রহ

পাকিস্তানে চতুর্দিকে ইউটার্নের হইচই চলছিল। বিরোধী পক্ষ চিৎকার করে জানতে চাচ্ছিল, ইমরান খানের সরকার তাদের প্রথম তিন মাসে ইউটার্নের পর ইউটার্ন নেয়া ছাড়া আর কী করেছে? যাদের শাসনামলে পাকিস্তানকে ঋণ গ্রহণ করে চলতে হয়েছে, তারা ইমরান খানের কাছে জানতে চেয়েছেন, আপনি তো বলেছিলেন, বিদেশী ঋণ গ্রহণের পরিবর্তে আত্মহত্যা করব। এখন নিজে কেন ঋণের জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন?’ সমালোচনার এ খেলা আমরা বেশ উপভোগ করছি ইমরান খানের ওই সব পুরাতন বক্তৃতা বের করছি, যেখানে তিনি বিদেশী ঋণের বিরুদ্ধে বলেছেন। আর সম্ভবত এ সমালোচনার জবাবে খান সাহেবকে এ কথা বলতে হয়েছে, ‘আমি ইউটার্ন নিইনি, বরং কৌশল পরিবর্তন করেছি।’

তার পরও কি আমরা তা মানছি? আমরা হেলে দুলে ইমরান খানের বিরুদ্ধে ইউটার্নের অপবাদ দিচ্ছি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও তার কাছে প্রথম এক শত দিনে ওই সব ওয়াদার হিসাব চাওয়া শুরু করেছে, যা পাঁচ বছরেও পূরণ করা বেশ কঠিন। ইমরান খানের প্রথম এক শত দিন পূর্ণ হতে কয়েক দিন বাকি ছিল। এর মধ্যেই ২৭ নভেম্বর ওয়াগাহ বর্ডারের গেট খোলা হয়, আর ওই গেট দিয়ে নবজ্যোত সিং সিধু ‘ওয়াহ মেরে ইয়ার ইমরান, ওয়াহ’ সেøাগান দিতে দিতে দীর্ঘ একটি তরঙ্গ নিয়ে লাহোর পৌঁছেন এবং হাস্যমুখে কর্তারপুর সাহেব পৌঁছে যান। ওখানে ২৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান শান্তি করিডোরের শুভসূচনা করেন। এ করিডোর খুলে দেয়ায় সারা দুনিয়ার শিখ সম্প্রদায় ইমরান খানের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছে। নবজ্যোত সিং সিধু বারবার বলছেন, ইমরান খান গোটা জগৎকে আমাদের ঝুলিতে তুলে দিয়েছেন। ২০১৩ সালে মুসলিম লীগ (এন) সরকারও কর্তারপুর সাহেব শান্তি করিডোর খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তান আসেন এবং নওয়াজ শরিফের সাথে কোলাকুলি করে ফিরে যান। তবে কর্তারপুর শান্তি করিডোর খোলা হয়নি। ইমরান তার সরকারের প্রথম তিন মাসের মধ্যেই ওই শান্তি করিডোর খুলে দিয়েছেন।

এ করিডোরের শুভসূচনাকালে ইমরান খানকে সারা বিশ্বজুড়ে সাবাশ দেয়া হয়েছে। তিনি নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে কোনো নীতির ওপর সমঝোতা করেননি, কোনো চাপও মেনে নেননি। কাশ্মিরিদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন, সাথে সাথে কর্তারপুর শান্তি করিডোর খুলে দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর পৌত্র ড. রাজমোহন গান্ধীকে বলতে বাধ্য করেছেন, ‘আমি ইমরান খানকে স্যালুট জানাই।’ এ কীর্তির জন্য ইমরান খানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাক্ষ্য বা সমর্থনের কোনো প্রয়োজন নেই। বিরোধীপক্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা অফ দ্য রেকর্ড আমাকে বলেছেন, কর্তারপুর শান্তি করিডোর দ্বারা শুধু শিখ নয়, পাকিস্তানিদেরও অনেক লাভ হবে। কেননা পেলে পাকিস্তানে শিখ যাত্রীদের আসা-যাওয়া বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তানের অর্থনীতি বেশ আনুকূল্য পাবে। আমাকে এ কথাও বলা হয়েছে, অতীতে পাকিস্তান সরকার এ করিডোর খুলতে বারবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু মোদি সরকার এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি।’ এবার মোদি সরকারের পালানোর কোনো পথ ছিল না। কেননা ভারতে নির্বাচন এগিয়ে এসেছে। আর নবজ্যোত সিং সিধু কর্তারপুর সাহেবের বিষয়ে ভারতে এমন হইচই শুরু করেছেন যে, মোদি সরকারকেও নীরবে মাথা নত করতে হয়েছে এবং গুরুদাসপুর বর্ডার খুলে দিতে হয়েছে।

এ বাস্তবতায় কোনো সন্দেহ নেই, ইমরান খানের শপথ অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া ও সিধুর মধ্যে যদি কোলাকুলির ঘটনা না ঘটত, তাহলে বিষয়টা এত বেশি আলোচিত হতো না এবং কোটি কোটি শিখের স্বপ্ন এত শিগগিরই বাস্তবায়িত হতো না। এখন সামনে তাকিয়ে দেখুন কী হয়। ব্রিটেনের শিখরা এমন প্রস্তাবও দিয়েছেন, যদি পাকিস্তানে কোনো ড্যামকে বাবা গুরু নানকের নামে নামকরণ করা হয়, তাহলে তারা ওই ড্যামের জন্য সব অর্থের ব্যবস্থাও করবেন। কর্তারপুর সাহেব শিখদের কাছে তেমনি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেমনটা গুরুত্বপূর্ণ মুসলমানদের কাছে মক্কা ও মদিনা। সুতরাং কর্তারপুর শান্তি করিডোর খোলার দ্বারা নবজ্যোত সিং সিধুও বিশ্বজুড়ে নানকের অনুসারীদের ‘হিরো’ হয়ে গেছেন। করিডোরের শুভসূচনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ভারতের এক সাংবাদিকের বক্তব্য, সিধু এক দিকে ইমরান খানের রাজনৈতিক সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করেছেন, অপর দিকে ভারতের রাজনীতিতে তিনি নিজেও লাভবান হবেন।

তা হচ্ছে, তিনি খুব সহজেই ভারতের পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হবেন। সিধুর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দ্বারা পাঞ্জাবে কংগ্রেসের প্রত্যাবর্তনও ঘটতে পারে। কেননা, ১৯৮৪ সালে শিখদের বিরুদ্ধে অপারেশন ব্লু স্টার এবং এরপর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পর কংগ্রেস পাঞ্জাবে বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। নবজ্যোত সিং সিধু তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিজেপির দ্বারা সূচনা করেছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি অমৃতসর থেকে প্রথম নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে লড়াই করে জয়লাভও করে ছিলেন। সিধুর জীবনে বড় ধরনের চড়াই উতরাই এসেছে। তাকে হত্যার এক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। এ কারণে তাকে তার আসন ছাড়তে হয়েছিল। এরপর আদালত থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচনে দ্বিতীয়বার সফল হলেন। সিধুকে বিজেপি ২০১৬ সালে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে দেয়, যাতে তিনি লোকসভা থেকে বারবার জিতে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হতে না পারেন। বিজেপির সাথে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধির কারণে সিধু ২০১৭ সালে বিজেপি ছেড়ে দেন এবং রাজ্যসভাকেও গুডবাই বলে দিয়েছেন। তিনি কংগ্রেসে যোগ দিয়ে বেশ রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে ফেলেন। তবে কংগ্রেসের টিকিটেও নির্বাচন জিতে গেছেন।

সিধু শুধু পাঞ্জাবে নয়, বরং পুরো ভারতে কংগ্রেসের নতুন মুখ হয়ে গেছেন। রাহুল গান্ধী সিধুর কারণে শিখদের সমর্থন ফিরে পেলে তিনি শিখদের ও মুসলমানদের সহায়তায় ভারতের রাজনৈতিক চিত্র পাল্টে দিতে পারেন। বিজেপির উগ্রপন্থা অবলম্বনের নীতি মোদিকে শক্তিশালী করলেও ভারতকে দুর্বল করে দিয়েছে। পাঞ্জাবে কংগ্রেসের প্রত্যাবর্তনে মোদি দুর্বল হলেও ভারত শক্তিশালী হবে। কংগ্রেসকে জম্মু-কাশ্মির সমস্যার ব্যাপারে তাদের চিরাচরিত রাজনীতি পরিত্যাগ করে কোনো নতুন পথ অনুসন্ধান করতে হবে, যাতে কর্তারপুর ও গুরুদাসপুরের মধ্যে করিডোরের পর জম্মু ও শিয়ালকোটেও করিডোর খোলা যায় এবং মুজাফফারাবাদ-শ্রীনগর করিডোরকেও শান্তি ও আনন্দের করিডোর বানানো সম্ভব হয়। আজ বাবা নানকের অনুসারীরা আনন্দে আত্মহারা। নানক ও গৌতমের অনুসারীদের পাকিস্তান আসা-যাওয়া শুরু হলে শুধু ইমরান খান নয়, আমাদের সবারই ফায়দা। সুতরাং ইমরান খানকে কর্তারপুর সাহেব থেকে আরো এগিয়ে যাওয়া জরুরি। ‘নয়া পাকিস্তান’ বানানোর জন্য আরো শান্তি করিডোর খোলার প্রয়োজন রয়েছে। কারাগার পূর্ণ করার দ্বারা নয়া পাকিস্তান গঠিত হবে না, শান্তি করিডোরের দ্বারাই নয়া পাকিস্তান গঠিত হবে।

হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট-জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)
পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৯ নভেম্বর, ২০১৮ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব


আরো সংবাদ



premium cement