২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অযোধ্যায় সঙ্ঘ পরিবারের বিক্ষোভ

বাবরি মসজিদ - ছবি : সংগৃহীত

আসন্ন অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের সম্ভাবনা যেভাবে বেড়ে চলেছে, ঠিক তেমনি অযোধ্যায় বেড়ে চলেছে সাধু-সন্তদের ভিড়ও। এরা সেই সাধু-সন্ত, ধর্মের সাথে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং আইনের শাসনের প্রতিও তাদের নেই কোনো বিশ্বাস। এ কারণে অযোধ্যার বিবাদ ফায়সালা হওয়ার আগেই বিবাদপূর্ণ স্থানে জোরপূর্বক রামমন্দির নির্মাণের জন্য বিক্ষোভ করা হচ্ছে এবং অযোধ্যায় ‘আইনের পতাকা’ উড়ানোর জন্য বেআইনিভাবে লোক সমাগম করা হচ্ছে। লক্ষণীয় হচ্ছে, এবার অযোধ্যায় লোকদের সমবেত করার দায়িত্ব স্বয়ং আরএসএস পালন করছে। তারা এ জন্য নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। বিশ্বহিন্দু পরিষদ নেতা অশোক সিংহাল মারা যাওয়া ও অনলবর্ষী নেতা পারভীন তোগাড়িয়ার পল্টিবাজির পর এখন সঙ্ঘ পরিবারের কোনো নেতা নেই, যিনি অযোধ্যার বিষয়কে ধারালো করতে পারবেন।

সুতরাং স্বয়ং আরএসএসের বড় নেতারা অযোধ্যায় ছাউনি ফেলেছেন। তাদের পক্ষ থেকে হুমকিপূর্ণ বক্তৃতা করা হচ্ছে, যা রীতিমতো সরাসরি আইন-আদালতকে কটাক্ষ করা। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এখন পর্যন্ত আদালত এ বেআইনি আন্দোলনের বিরুদ্ধে কোনো নোটিশ জারি করেননি এবং আইন নিজের কাজ শুরু করেনি। অযোধ্যায় আগুন লাগানোর চেষ্টা এখন তুঙ্গে। সঙ্ঘ পরিবারই শুধু নয়, শিবসেনাও নিজের দুর্বল অবস্থানকে মজবুত করার জন্য অযোধ্যার শিবিরে এসে পৌঁছেছে। শিবসেনা প্রধান উদ্ভব ঠাকরের অযোধ্যাযাত্রা এ ধারাবাহিকতারই একটি অংশ। তবে শিবসেনাকে এখানে ঠাঁই পেতে সঙ্ঘ পরিবারের ওই সব নেতার আশ্রয় নিতে হয়েছে, যারা অযোধ্যাকে নিজেদের জায়গির বলে মনে করেন।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদকে বর্বরোচিতভাবে শহীদ করার পর এটা দ্বিতীয় ঘটনা, যখন অযোধ্যায় একসাথে এত কট্টর উগ্রপন্থীর সমাবেশ ঘটেছে। যে ধরনের বক্তব্য দেয়া হচ্ছে এবং হুমকি দেয়া হচ্ছে, তার প্রেক্ষাপটে অযোধ্যার মুসলমানেরা শঙ্কাবোধ করছেন যে, এখানে ১৯৯২ সালের মতো পরিস্থিতি আবার সৃষ্টি হতে পারে। সুপ্রিম কোর্টে অযোধ্যা বিবাদের শুনানির তারিখ পিছিয়ে যাওয়ার পরই আরএসএস হুমকি দিচ্ছিল, ‘অযোধ্যায় এখন ১৯৯২ সালের মতো আন্দোলন শুরু করা হবে। হিন্দুদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। তারা আর অপেক্ষা করতে পারছে না।’ মোহন ভাগবত বলেছিলেন, ‘সরকার হয়তো অর্ডিন্যান্স জারি করবে, অথবা পার্লামেন্টে আইন করে রামমন্দির নির্মাণের পথ সুগম করবে।’ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্যই একটি পরিকল্পিত কর্মসূচির অধীনে অযোধ্যায় লক্ষাধিক সাধু-সন্তকে একত্র করার ডাক দেয়া হয়েছে। আরএসএসের মুখপাত্র বাবা রামদেবের বক্তব্য, ‘যদি রামমন্দির তৈরি করা না হয়, তাহলে দেশে বিদ্রোহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘খাঁটি রামভক্ত’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘রামমন্দির নির্মাণের পথ সুপ্রিম কোর্ট নয়, বরং পার্লামেন্টের মাধ্যমে সুগম হবে। সরকারকে এদিকে পা বাড়ানো উচিত।’ তিনি বলেন, ‘মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। তারা আর অপেক্ষা করতে পারবে না। যখন কোনো সমস্যাকে সীমা ছাড়িয়ে দাবিয়ে রাখা হয় এবং কোনো সমস্যার সমাধান করা হয় না, তখন তৈরি হয় বিদ্রোহের সম্ভাবনা।’

বাবা রামদেব ও সঙ্ঘ পরিবারের অপর নেতাদের হুমকিপূর্ণ বক্তব্যে স্পষ্ট, সঙ্ঘ পরিবার এটাই চায় যে, ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করা হোক; যাতে দেশের সরলমনা মানুষ এ চালাকির ফাঁদে পা দিয়ে বিজেপির হাতে আবার ক্ষমতা তুলে দেয়। এ কথা কারো কাছে গোপন নয়, বিগত সাড়ে চার বছরে মোদি সরকার জনকল্যাণমূলক তেমন কোনো কাজই করেনি, যার দ্বারা জনগণ স্বস্তি লাভ করে কিংবা তাদের সুদিন অনুভব করতে পারে। এর বিপরীতে নোট বাতিল ও জিএসটির মতো পদক্ষেপগুলো জনগণের কোমর ভেঙে দিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, নোট বাতিলের সময় কৃষকদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যে খেলা চলছে, তা কারো কাছে গোপন নেই। সিবিআইয়ের মতো দেশের সবচেয়ে বড় তদন্ত সংস্থাতে চলছে বিশৃঙ্খলা। একজন বড় কর্মকর্তা সিবিআইয়ের কাজের মধ্যে সরকারের নাক গলানোর অভিযোগ করেছেন। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘুষ খাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাফেল বিমান ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছে। দুর্নীতির কয়েকটি বিষয়ে এই সরকারকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত দেখা যাচ্ছে।

বিজেপি প্রধান অমিত শাহের বিরুদ্ধে একজন উচ্চপদস্থ তদন্ত কর্মকর্তা সিবিআই আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছেন যে, সোহরাবুদ্দীনের ভুয়া এনকাউন্টারে অমিত শাহও এক গুরুত্বপূর্ণ ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে শরিক ছিলেন। এতে বিজেপির ব্যাপক দুর্নাম হচ্ছে। রাহুল গান্ধী ঠিকই বলেছেন, ‘বিজেপির দরকার এমনই প্রেসিডেন্ট।’ মূলত ওই সব বিষয় থেকে জনগণের দৃষ্টি সরানোর জন্যই অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের আওয়াজ জোরালো করা হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, বিজেপি নেতারা জনগণের ক্ষোভের সামনা সামনি হওয়া থেকে দূরে থাকছেন। আর এ কারণেই আরএসএস এখন সবকিছু সামাল দিচ্ছে। আরএসএসের সাম্প্রতিক তৎপরতা দেখে এটা স্পষ্ট যে, এ পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে নিজেদের একটি সামাজিক ও কল্যাণমূলক সংগঠন হওয়ার যে দাবি করা হয়েছিল, তার সবটুকুই প্রতারণা। কেননা আরএসএস এখন পুরোপুরি রাজনৈতিক পোশাক পরে নিয়েছে এবং তারা প্রকাশ্যে বিজেপিকে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আরএসএস অযোধ্যায় বিপুলসংখ্যক লোকের সমাবেশ ঘটাতে নিজেদের শক্তির বাঁধন খুলে দিয়েছে।

ধর্মসভার জন্য আরএসএসের তৎপরতা লোক জড়ো করা থেকে শুরু করে সাধু-সন্তদের সমাবেশ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে নজরে পড়ছে। সবাই জানে, এখন পর্যন্ত অযোধ্যার সব আন্দোলনে বিশ্বহিন্দু পরিষদ সবার সামনে থেকেছে এবং আরএসএস তার পেছনে থেকে শক্তি জুগিয়েছে। তবে এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এখন আরএসএস শুধু দৃশ্যপটেই নয়, বরং আয়োজন ও ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্বই তাদের সামলাতে হচ্ছে। এ কথা তখনই স্পষ্ট হয়ে গেছে, যখন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত এ ব্যাপারে ভাষণ দিয়েছিলেন এবং এরপর অযোধ্যার ধর্মসভার বাগডোর নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিলেন।

আরএসএসের শীর্ষ নেতা ভাইয়া জোশি বলেছেন, ‘মন্দির নির্মাণ হিন্দু সমাজের স্বপ্ন। এটাকে বাস্তবে রূপদান করার দায়িত্ব সঙ্ঘ পরিবারের। আরএসএস এ ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ অযোধ্যায় যতই লোক সমাগম বাড়ছে, ওখানকার মুসলমানদের মাঝে ততই ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে। ১৯৯২ সালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে জুলুম-নির্যাতন হয়েছিল, তাতে বহিরাগত লোকের হাত ছিল। এবারো ওখানে বিপুলসংখ্যক বহিরাগত জমা হয়ে গেছে। অযোধ্যা মামলার একটি পক্ষ ও অযোধ্যার বংশীয় অধিবাসী ইকবাল আনসারীর বক্তব্য, ‘বিগত আন্দোলনের সময়ও সরকার বলেছিল, ওখানে কেউই প্রবেশ করতে পারবে না। তথাপি অযোধ্যায় ধ্বংসযজ্ঞ করেছে। ১৫ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে।

শহীদ করা হয়েছে কয়েকটি মসজিদ। আর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।’ আফসোসের বিষয় হচ্ছে, জেলা প্রশাসন মুসলমানদের নিরাপত্তা দিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ কারণে স্থানীয় মুসলমানেরা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে স্মারকলিপি পাঠিয়ে তাদের নিরাপত্তার জন্য আবেদন করেছেন। অযোধ্যায় সঙ্ঘ পরিবারের সাম্প্রতিক তৎপরতা মূলত হিন্দুদের এ আশ্বাস দেয়ার জন্য যে, তারা রামমন্দির নির্মাণের বিষয়ে কোনো সমঝোতা করবে না। তবে দীর্ঘকাল ধরে সঙ্ঘ পরিবারের মিথ্যা বাণীতে অস্থির হিন্দু সমাজের লোকেরা অনুধাবন করছে যে, ‘অযোধ্যা কার্ড’ সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা ওই সময় ব্যবহার করে, যখন নির্বাচনের ময়দানে বিজেপির অবস্থা হয়ে পড়ে শোচনীয়। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও তেলেঙ্গানার মতো রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের পরাজয়ের পদধ্বনি অনুভব করে তারা আরো একবার অযোধ্যার বিষয়কে উত্তপ্ত করেছে। আর এ ইস্যু ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত উত্তপ্ত রাখতে চাচ্ছে। এ কাজে পোষ্য মিডিয়া সঙ্ঘ পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা করছে। অযোধ্যা বিবাদের সব আইনি ও বিচারিক দিককে পদদলিত করে সবকিছু সংখ্যার শক্তি ও লোক সমাগমের ভিত্তিতে চূড়ান্ত করার চেষ্টা চলছে, যা মূলত দেশে আইন ও ন্যায়বিচারের শাসনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস ২৫ নভেম্বর,
২০১৮ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
জামালপুরে সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার অবৈধ গাড়ি কালীগঞ্জে আওয়ামী লীগে বিভেদ শরীয়তপুরে বৃদ্ধি পাচ্ছে ভুট্টার আবাদ মিরসরাইয়ে ৩ দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি আলুতে দাম বেড়েছে ১০ টাকা ফরিদপুরের পদ্মাপাড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ২৩ এস্কেভেটর ও ৮ ট্রাক ফেলে পালালো বালুদস্যুরা বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা গলাচিপায় নির্বাচনী মাঠে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নাটোরে চেয়ারম্যান প্রার্থী লুৎফুল হাবীবকে শোকজ হোসেনপুরে গ্রামের গ্রাহকরা দিনে এক ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না ঈদগাঁওতে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ৭ প্রার্থীকে জরিমানা গাজীপুরে স্মার্ট প্রিপেইড মিটার স্থাপন কার্যক্রম উদ্বোধন

সকল