২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আফগানিস্তানে শান্তির নতুন প্রত্যাশা

খালিলজাদে ও আশরাফ গনি -

মার্কিন কূটনীতিক খালিলজাদে আফগানিস্তানে শান্তি ও সমঝোতার জন্য চলমান উদ্যোগের হাল ধরায় শান্তি প্রয়াসের মাধ্যমে একটি সমাধান বেরিয়ে আসার ব্যাপারে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানির নির্বাচনী প্রচারণার অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল, রাজনৈতিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে তালেবানদের বিদ্রোহের অবসান ঘটানো। ক্ষমতায় আসার পর তাৎক্ষণিকভাবে তিনি পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে শান্তি উদ্যোগ শুরু করেছেন।

দুর্ভাগ্যজনক হলো, তিনি বারবার যে চেষ্টা চালিয়েছেন এর ফলাফল হতাশাব্যঞ্জক এবং পাকিস্তান সরকার এ ক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতা করেনি। মাত্র কিছু দিন আগে কাবুলে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জন্মদিন উপলক্ষে আলেম ও ছাত্রদের সমাবেশ লক্ষ্য করে লোমহর্ষক হামলা চালানো হয়। সম্প্রতি খোস্তে অপর এক হামলার ঘটনা ঘটেছে। দেশে প্রত্যেকবারের সন্ত্রাসী হামলায় নির্দোষ লোকদের জীবনহানি ঘটছে। এসব ঘটনা আফগানদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, অন্য কোনো কিছুর চেয়ে শান্তি অধিক অপরিহার্য।

সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের শাসনামলে যে উচ্চপর্যায়ের শান্তি পরিষদ গঠন করা হয়েছিল তা তালেবানদের সাথে আন্তঃআফগান সংলাপ এবং শান্তি আলোচনার একটি ফোরাম হিসেবে রয়ে গেছে। কিন্তু আফগানদের অনেকেই এই পরিষদকে ‘অকার্যকর’ এবং শুধুই ‘প্রতীকী’ হিসেবে বিবেচনা করছেন। অনেকে আবার এটাকে সরকারি দফতরের ‘অপ্রয়োজনীয় আর্থিক বোঝা’ বলে মনে করেন। আশরাফ গানি এখন একটি শক্তিশালী ও দক্ষ উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের জন্য কাজ করছেন। তারা তালেবানদের সাথে একটি শান্তি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন।

জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) তালেবানদের সাথে কোনো শান্তিচুক্তির ব্যাপারে সফল হতে না পারলেও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামী পার্টিকে মূলধারার রাজনীতিতে নিয়ে আসতে পারা একটি বিশ্বাসযোগ্য অর্জন। এর কৃতিত্ব আশরাফ গানির এবং এতে শান্তির ব্যাপারে সরকারের প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন ঘটছে।

একজন শান্তিকামী রাজনৈতিক কুশীলব হিসেবে রাষ্ট্রে হেকমতিয়ারের অন্তর্ভুক্তি বা শুভাগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সুতরাং আফগান সরকারকে তালেবানদের পক্ষ থেকে আলোচনার অবৈধ অংশীদার বলে চিহ্নিত করার আর কোনো সুযোগ থাকছে না। তালেবানরা দীর্ঘদিন ধরে জোর দিয়ে আসছিল যে, সরকারের সাথে যেকোনো শান্তিচুক্তি করলে তাতে আফগানিস্তানের মাটি থেকে সব বিদেশী সৈন্য সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহারের বিষয়টি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একটি শান্তিচুক্তিতে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে খালিলজাদের সর্বশেষ আশা, শান্তির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্যদের হয়তো প্রত্যাহার করে নেবে। তালেবানরা আরো দাবি করেছেÑ তাদের বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য করা কালো তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। হেকমতিয়ারের সাথে শান্তিচুক্তির জন্য একই ধরনের দাবি মেনে নেয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তালেবানদের ব্যাপারে একই দাবি মেনে নেয়া হবে না কেন এবং এই না করার কোনো কারণ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

গত ঈদুল ফিতরের সময় আফগান সরকার এবং তালেবানদের মধ্যে তিন দিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল। তখন দেশব্যাপী সহিংসতার একটি ঘটনাও ঘটেনি বলে খবর প্রকাশ। এতে প্রমাণিত যে, তালেবানদের একটি সুসংগঠিত কমান্ড আর কন্ট্রোল সিস্টেম রয়েছে। আর এটা একক নেতৃত্বের মাধ্যমে আলোচনায় সহায়তা করবে। যুদ্ধবিরতির সময় তালেবান কমান্ডার ও যোদ্ধারা আফগান সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, তাদের সাথে খাওয়া দাওয়ায় অংশগ্রহণ করেন এবং স্থানীয় জনগণের সাথে মেলামেশা করেছেন। কেউ কেউ জনগণের সাথে সেলফি তোলেন এবং সিটি সেন্টারে ঘুরে বেড়ালেন। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এগুলো ভাইরাল হয়েছে। এই নজিরবিহীন তৎপরতায় দেখা গেছে, আফগানরা তালেবানদের সাথে শান্তির ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী এবং তারা সহিংসতায় বিরক্ত ও খুবই হতাশ।

দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কোনো অ্যাজেন্ডা, সুশাসন, দুর্নীতি নির্মূল কিংবা জনগণের সেবা প্রভৃতি বাস্তবায়ন করা যাবে না। তাই প্রেসিডেন্ট গানি শান্তি প্রতিষ্ঠাকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়েছেন। শান্তি সম্ভব, কিন্তু জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমঝোতা ছাড়া সম্ভব নয়। তালেবানদের সাথে শান্তির ব্যাপারে আফগানদের যখন ব্যাপক সমর্থন রয়েছে, তখন আমাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের ভূমিকার মাধ্যমে টেকসই শান্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

শান্তির জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনকার মতো কখনো অনুকূল ছিল না। প্রধানত নতুন করে, মাার্কিন স্বার্থ এবং আফগান সরকার ও তালেবানদের রাজনৈতিক ইচ্ছার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আফগানদের মধ্যে খালিলজাদে অত্যন্ত সম্মানিত এবং তার কূটনৈতিক জ্ঞানের সুখ্যাতি রয়েছে। একজন আফগান-আমেরিকান হিসেবে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক গতিধারা এবং এই অঞ্চল সম্পর্কে তার গভীর উপলব্ধি ও জানাশোনা রয়েছে। তালেবানদের সাথে রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে আসার ব্যাপারে তিনি সহায়তা করতে পারবেন বলে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়। শান্তি শুধু আফগানদের জন্যই অপরিহার্য নয়; ওই অঞ্চলের এবং বিশ্বের স্বার্থে শান্তি প্রয়োজন। অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরশীলতা এবং বিশ্বায়নের এই যুগে শান্তি বজায় রাখা অত্যাবশ্যক।
লেখক : আফগানিস্তান সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট। আফগান গভর্নমেন্টের ডেপুটি মন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার আগে আশরাফ গানির পলিসি বিষয়ক উপদেষ্টা।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement