১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কঠিন বাস্তবতায় পোশাক শিল্পের সমৃদ্ধি

-

বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল আশির দশকে। তখন কর্মসংস্থানের হার ছিল নিম্ন। আর উচ্চশিক্ষিতের চেয়ে স্বল্পশিক্ষিত বেকারদের কর্মসঙ্কট ছিল আরো বেশি। এর মধ্যে নারীবান্ধব কর্মপরিসর ছিল সীমাবদ্ধতার প্রাচীরঘেরা। এই যখন অবস্থা, তখন জীবন পথের ঘন অন্ধকারে, লাখো বেকারের মাঝে, পোশাক শিল্প হয়ে ওঠে অনন্য বাতিঘর। সেই শিল্প দুই দশকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এ দেশের প্রধান রফতানি খাতে পরিণত হয়েছে। তবে এ শিল্পের ওপর এখন নেমে আসছে নানামুখী আঘাত ও বিপর্যয়।
নভেম্বরে পোশাক শিল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক দু’টি গণমাধ্যমে দু’টি সংবাদ এসেছে, একটি ৪ নভেম্বর সাউথ এশিয়া মনিটরে, অন্যটি ২২ নভেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সে। সংবাদ দু’টিতে এ দেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কথা উঠে এসেছে।

সাউথ এশিয়া মনিটরে খবর এসেছে, শ্রমিকের মজুরি ৫১ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় যে দেশগুলোয় শ্রমের মূল্য কম, সেসব দেশে আগ্রহী হয়ে উঠছে নামী ব্র্যান্ডগুলো। বিশেষ করে সস্তা শ্রমের বাজার আফ্রিকার দিকে ঝুঁকে পড়ছে কোম্পানিগুলো।

২২ নভেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, অ্যাকর্ডের প্রতি ৩০ নভেম্বরের মধ্যে কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ রয়েছে আদালতের। আন্তর্জাতিক পোশাক প্রতিষ্ঠান জারা এবং এইচঅ্যান্ডএমসহ কমপক্ষে ২০০ প্রতিষ্ঠান অ্যাকর্ডের সদস্য। তারা নিরাপদ পরিবেশের কারখানা থেকে পোশাক কিনতে অ্যাকর্ড গঠন করেছেন। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর পাশ্চাত্যের পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলো এ সংগঠন তৈরি করে।

ওই সংবাদের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে দুই হাজারের বেশি কারখানা পরিদর্শন করে অগ্নিঝুঁকির বিষয়ে দেড় লাখ পরিকল্পনা গ্রহণে সহায়তা করেছে অ্যাকর্ড। এসব সমস্যার ৯০ শতাংশের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। কিন্তু একটি কারখানার মালিকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ঢাকায় অ্যাকর্ডের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু কারখানা থেকে পোশাক নেয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এসব তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে আমাদের পোশাক শিল্প যে বড় একটা সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে- এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

শ্রমিকদের কম বেতনের সুবাদে চীনের পর পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ বাজার। এখানে কারখানা চার হাজার। কাজ করেন ৪০ লাখ শ্রমিক। এক তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এ খাত থেকে বছরে ৩০০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রফতানি হয়। মোট যে পরিমাণ পোশাক কেনে বিশে^র ফ্যাশন গ্রুপগুলো, তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই যায় বাংলাদেশ থেকে।

বিজিএমইএর হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে রয়েছে চার হাজার ৫৬০টি পোশাক কারখানা। দেশের মোট রফতানি পণ্যের ৮৩.৫ শতাংশই তৈরী পোশাক। গত বছর বিদেশে ৩০.৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এক দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি ৬ শতাংশের উপরে থাকার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এই পোশাক খাতের। কিন্তু নানা সঙ্কটে গত পাঁচ বছরে দেশে প্রায় ২২ শতাংশ গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। বলা যায়, পোশাক শিল্পে সঙ্কট ও সম্ভাবনা হাত ধরাধরি করে চলছে।

একসময় সকাল ৮টার খানিক আগে এ দেশের পোশাক কারখানা অধ্যুষিত মহল্লাগুলোর অলিগলির চিত্রই পাল্টে যেত। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা কর্মমুখী কিশোর, যুবক ও নারীরা সময় বেঁধে যখন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করত, তখন কর্মীদের সুশৃঙ্খল চলাচল দেখে মনে হতো এ যেন প্রতিদিনের উৎসবযাত্রা।

কর্মদীপ্ত ওইসব নারী-পুরুষের উপার্জন চলে যায় গ্রামবাংলায় নিকটজনের সান্নিধ্যে, গহিন পল্লীর আলো-আঁধারীর অনেক জীর্ণ কুটিরে। সেখানে হয়তো অর্থের অপেক্ষায় প্রহর গোনে প্রিয় স্বামী-সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মা কিংবা স্কুলপড়–য়া ভাইবোনেরা। তাই আমাদের পোশাক খাতের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা শুধু জাতীয় অর্থনৈতিক রিজার্ভে গতি সঞ্চারই করে না, এ উপার্জনের বড় অংশ চলে যায় দিগন্তবিস্তৃত মেঠোপথ বেয়ে তৃণমূলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এর প্রভাব পড়ে ওইসব অঞ্চলের গ্রামগঞ্জে, হাট-বাজারে কেনাকাটায়। এখন কিছুটা হলেও এতে ভাটার টান পড়েছে।

পোশাক উৎপাদনে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এ অর্জন অনেক আগের। দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশকে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও ইথিওপিয়ার সাথে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। ওই দেশগুলোর সাথে এই প্রতিযোগিতাও পুরনো হতে বসেছে। তবুও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে টিকে থেকে আমাদের রফতানিকারকরা আজো দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছেন।

এ দেশের শ্রম তুলনামূলকভাবে সস্তা। তথ্যমতে, দেশের একজন পোশাককর্মী প্রতি মাসে প্রায় ১০১ ডলার আয় করেন। এটা মিয়ানমারে ১৩৫ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১৭০ ডলার, ভিয়েতনামে ২৩৪ ডলার ও চীনে ৫১৮ ডলার। কিন্তু আফ্রিকার গরিব দেশ ইথিওপিয়ায় একজন পোশাক শ্রমিক মাসে আয় করেন মাত্র ৫০ ডলার; যা বাংলাদেশের অর্ধেক।

সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন। সরকার এবার পোশাক শ্রমিকদের বেতন ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। প্রতিষ্ঠিত অনেক কোম্পানি প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে এমনিতেই বেতন বৃদ্ধি করে থাকে। কিন্তু এবার বেতন প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। শ্রমিকের অপর্যায়ক্রমিক মাত্রায় বেতন বাড়ার সাথে সাথে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। বিদেশী ক্রেতারা পোশাকের ক্রয়মূল্য না বাড়িয়ে এখন সস্তা শ্রমের দেশে নিম্নমূল্যে পোশাক কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।

সাউথ এশিয়া মনিটরে প্রকাশিত ওই খবরে বলা হয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত বেতন বৃদ্ধির কারণে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের চাহিদা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বিদেশী ক্রেতারা চান, পোশাকের মূল্য কম থাকুক। বেতনের এ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ আর খুব বেশি দিন কম খরচে পোশাক সরবরাহ করতে পারবে না।

অধিক বেতনের চাপে বায়ার বা বিদেশী ক্রেতা হারিয়ে যদি পোশাক শিল্পই স্থবির হয়ে যায়, তাহলে বর্ধিত বেতন পরের কথা, আগের বেতনটাই আসবে কোথা থেকে? এতে তো অনেক কারখানা বন্ধ হওয়া এবং অনেক শ্রমিকের চাকরির ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। হয়তো সরকার শ্রমিক শ্রেণীর জীবন-মান উন্নয়নে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বেতন বৃদ্ধিতে পোশাক খাত রয়েছে এক বড় ধরনের চাপে।

বাংলাদেশের পোশাক কর্মীরা কাজে দক্ষ। শ্রম-দক্ষতা ছাপ ফেলে পণ্যের উৎকর্ষের ওপর। এ কারণে বাংলাদেশের পণ্যের বিশ^জুড়ে গ্রহণযোগ্যতা। পোশাক উপাদনের পাশাপাশি চীন সহায়ক পণ্যও তৈরি করছে। ফলে বেতন উচ্চ মাত্রার হলেও পোশাক তৈরিতে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। কিন্তু আমাদের কাপড় এবং অন্যান্য সহায়ক পণ্য প্রধান প্রতিযোগী চীন থেকেই আমদানি করতে হয়। এতেই বিক্রয় মূল্যের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যয় হয়ে যায়। ফলে মুনাফার পরিমাণ কমে আসে। পোশাক রফতানিকারী চীন চাহিদার ধাপে ধাপে সহায়ক পণ্য তৈরিতে দক্ষতা অর্জন করেছে। এখন তারা প্রয়োজন মিটিয়ে পোশাক রফতানি করে। কিন্তু আমাদের পোশাক ব্যবসায়ীরা এত দিনেও এ স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে পারেননি?

চীনের মতো সহায়ক উপকরণ তৈরির ক্ষেত্রে নতুন কিছু প্রবর্তন আনা জরুরি। পোশাক উৎপাদনের উপকরণের জন্য আমদানিনির্ভর না হয়ে তা দেশেই উৎপাদন করতে হবে। এ শিল্পকে নিয়ে ভাবতে হবে গভীরে গিয়ে। শিল্পের যেকোনো সঙ্কটে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে দৃঢ় প্রত্যয়ে। তাহলেই হয়তো আগামী দিনে পোশাক রফতানির দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখা সম্ভব।

এখন একধাপে এত ব্যয় বৃদ্ধি, সহায়ক পণ্যের আমদানিনির্ভরতা, আফ্রিকার সস্তা শ্রমের প্রতিযোগিতা এবং অ্যাকর্ডের কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়া- এসব কারণ আমাদের পোশাকশিল্পকে সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি শুধু কর্মদক্ষতাকে পুঁজি করে বসে থাকে, তাহলে আস্তে আস্তে আফ্রিকার দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের বেশির ভাগ দখল করে নেবে।

দেশের রফতানি অর্থনীতির মেরুদণ্ড পোশাক শিল্প নিয়ে লড়াই থেমে নেই। পোশাক শিল্পের বহুমুখী সঙ্কট দূর করা জরুরি।
আমাদের কামনা, কঠিন বাস্তবতার দুর্বিপাকে পড়ে পোশাক কর্মীদের সকাল-সাঁঝের নিত্য পদধ্বনি যেন থেমে না যায়, থমকে না যায় জীর্ণ কুটিরে আশার আলো।
mubarokhosen83@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement