২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

এক কিংবদন্তির এমন বিদায়!

অ্যাঞ্জেলা মার্কেল - ছবি : সংগৃহীত

জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিচ্ছেন। তার উত্তরসূরি হিসেবে তারই পছন্দনীয় নতুন নেতা জার্মানির হাল ধরবেন। বিশ্বরাজনীতিতে এবং নারী নেত্রী হিসেবে অনন্যসাধারণ অবদান রেখেছেন তিনি। জার্মানির রাজনীতিতে কিভাবে তার উত্থান ঘটেছে?

সম্প্রতি জার্মানির ক্ষমতাসীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক (সিডিইউ) পার্টির নতুন প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের পছন্দের প্রার্থী আনেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাউয়ার। হামবুর্গে দলের নেতাদের ভোটে তিনি ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎসকে হারিয়েছেন।

শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব ছাড়েন মার্কেল। তার বিদায়ী ভাষণের পর পরবর্তী নেতা নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দফা ভোটে ৯৯৯ ভোটের মধ্যে ৪৫০ ভোট পেয়েছিলেন কারেনবাউয়ার। ম্যার্ৎস পেয়েছিলেন ৩৯২ ভোট এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন্স স্পান পেয়েছিলেন ১৫৭ ভোট। পরে কারেনবাউয়ার আর ম্যার্ৎসের মধ্যে রান-অফ হলে কারেনবাউয়ার পান ৫১৭ ভোট আর ম্যার্ৎস ৪৮৭ ভোট।

কারেনবাউয়ার দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কেল তাকে উত্তরসূরি বিবেচনা করে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে নিয়ে আসেন বলে ধারণা করা হয়। মার্কেলের নীতির প্রতি কারেনবাউয়ারের সমর্থনের কারণে মাঝে মধ্যে তাকে অনেকে ‘মিনি-মার্কেল’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।

আবেগময় বিদায়ী ভাষণে মিসেস মার্কেল তার দেশের ভেতরে এবং বাইরে জার্মানির উদার মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। সুদীর্ঘকাল অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জার্মানির ক্ষমতায় আসীন রয়েছেন।
নিজেকে তিনি একজন বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী নেতা হিসেবে প্রমাণ করেছেন। এক সময় তাকে বর্ণনা করা হতো ‘জার্মানির রানী’ হিসেবে। এমনকি কেউ কেউ তাকে ডাকতেন ‘ইউরোপের সম্রাজ্ঞী’ বলে।
১৮ বছর তিনি তার দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর পর পর চার মেয়াদে দেশটির চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দলের নেতৃত্ব এখন ছাড়লেও চ্যান্সেলর হিসেবে তার চতুর্থ মেয়াদ শেষ করবেন ২০২১ সালে। তখন দেশটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মার্কেল। কাজেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানির নেতৃত্বে তিনি ২০১২ সাল পর্যন্ত থাকলেও, এটা এক অর্থে হবে সাময়িক দায়িত্ব পালন।

মিসেস মার্কেলের ক্ষমতার শক্ত ভিত প্রথম নড়ে যায় যখন শরণার্থীদের জন্য জার্মানির উন্মুক্ত দ্বার নীতির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে তাকে পড়তে হয়। তার এই নীতির ফলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দেশটির চরম ডানপন্থীরা এবং তার দল প্রায় ৭০ বছরের নির্বাচনী ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করে ২০১৭ সালে।
মিসেস মার্কেল বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক পদ নিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই। উল্লেখ্য, দুই জার্মানি একত্রিত হওয়ার পর থেকে তিনি কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখন পর্যন্ত একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন।
১৯৫৪ সালে যখন তার বয়স মাত্র দুই মাস, তখন তার বাবাকে পূর্ব জার্মানির এক ছোট শহরের গির্জার ধর্মযাজকের দায়িত্ব দেয়া হয়।

কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে বার্লিনের উপকণ্ঠে এক গ্রাম এলাকায় বড় হয়েছেন অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। এরপর বার্লিন প্রাচীর যখন ভেঙে ফেলা হয়, তখন পূর্ব জার্মানিতে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর তিনি পূর্ব জার্মান সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ নেন।
১৯৯০ সালে জার্মানির একত্রীকরণের দুই মাস পর তিনি মধ্য দক্ষিণপন্থী ক্রিশিয়ান ডেমোক্র্যাট পার্টিতে (সিডিইউ) যোগ দেন। পরের বছর চ্যান্সেলর হেলমুট কোলের সরকারে তিনি মহিলা ও তরুণবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

মি. কোল অবৈধ অর্থ লেনদেনের এক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লে মিসেস মার্কেল ১৯৯৯ সালে তার পদত্যাগ দাবি করেন। ২০০০ সালে সিপিইউ দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে তিনি জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর হন।
তার রাজনৈতিক জীবনের গোড়ায় তাকে দেখা হতো অনাকর্ষণীয় প্রাদেশিক সাদামাটা একজন নেতা হিসেবে। কিন্তু প্রথম থেকেই সেই ভাবমূর্তি তিনি ঝেরে ফেলতে উদ্যোগী হন তার পোশাক-আশাক ও চেহারার পরিবর্তন ঘটিয়ে। তিনি চুলের স্টাইল বদলান এবং উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরতে শুরু করেন।
তিনি ১৯৯৮ সালে ইয়োকিম সয়ারকে বিয়ে করেন। তার প্রথম সরকার তিনি গঠন করেন মধ্যবামপন্থী সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের সাথে মহাজোট করে। এরপর ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি ব্যবসাবান্ধব ফ্রি ডেমোক্র্যাট দলের সাথে জোট সরকার গঠন করেন।

ইউরোপ যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি ব্যয় সঙ্কোচের প্রতীক হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ ইউরোপের উপর্যুপরি ঋণসমস্যার মোকাবেলায় তিনি ব্যাপক বাজেট হ্রাস এবং কড়া নজরদারির সুপারিশ করেন।
সমালোচকেরা বলেন, তিনি অর্থসঙ্কট সামাল দিতে বাড়তি অর্থসাহায্য দেয়ার ব্যাপারে প্রথম দিকে অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু ইউরো জোনের আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে জার্মানিই পরে সবচেয়ে বড় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এবং ইউরোর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ইইউর প্রয়াসের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেন অ্যাঞ্জেলা মার্কেল।

গ্রিস ও স্পেনে বিক্ষোভকারীরা ব্যয় সঙ্কোচন নীতি বলবৎ করার জন্য জার্মানিকে দোষারোপ করে এবং মিসেস মার্কেলকে হিটলারের সাথে তুলনা করে।
কিন্তু এই সঙ্কটের মধ্যে জার্মানির শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থান, বেকারত্বের নিচু হার এবং বেশ ভালোমাত্রার রফতানির দেশের ভেতর তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। জার্মানির মানুষ ব্যাপকভাবে মনে করে, কঠিন সময়ে তিনি দেশের জন্য নিরাপদ একজন নেতা।

২০১৩ সাল নাগাদ ব্যয় সঙ্কোচ নীতি সম্পর্কে তিনি অপেক্ষাকৃত নমনীয় মনোভাব নেন। তিনি বলেন, বেকারত্ব মোকাবেলার জন্য ইউরোপের শ্রমবাজার আরো উন্মুক্ত করা দরকার, যাতে তরুণেরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ খোঁজার সুযোগ পান।
মিসেস মার্কেলের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসে যখন অভিবাসী ও শরণার্থীরা তাদের গন্তব্য হিসেবে বিপুল সংখ্যায় পাড়ি জমায় সফল অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে দেখা যায় জার্মানিতে আশ্রয় পাওয়ার জন্য কয়েক বছর ধরে অপেক্ষারত এক শরণার্থী নারীকে চ্যান্সেলর সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। তারা মনে করেছে, তিনি সহমর্মিতা দেখাননি।

কিন্তু দলে দলে নতুন শরণার্থী আসার স্রোত যখন বাড়তে থাকে, তিনি জার্মানির সীমান্ত খুলে দেন। শরণার্থীরা ইইউর যে দেশ দিয়ে ইউরোপে ঢুকছে সেখানে তাদের আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে নাম নথিভুক্ত করার ইইউ নীতি তিনি সাময়িকভাবে স্থগিত করেন।
জাতিসঙ্ঘ তার এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ভূয়সী প্রশংসা করে। তিনি টাইম সাময়িকীতে সেই বছরের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নির্বাচিত হন এবং তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘প্রকারান্তর নেতা’ ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু এই উন্মুক্ত দ্বার নীতিকে সবাই স্বাগত জানায়নি। চরম দক্ষিণপন্থীরা এই নীতির বিরোধিতা করে প্রচারণায় নামে।

দেশের পূর্বাঞ্চলে তারা ইসলামবিরোধী প্রচারণায় তৎপর হয়ে ওঠে। প্রচারণা পূর্বাঞ্চলের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যত্রও।
এরপর নববর্ষের এক অনুষ্ঠানে অভিবাসীদের দিক থেকে যৌন হয়রানির অভিযোগ এবং গ্রীষ্মকালে ইসলামি চরমপন্থী গোষ্ঠীর হামলা এই প্রচারণাকে শক্ত ভিত্তি দেয়। ধাক্কা খায় মিসেস মার্কেলের জনপ্রিয়তা।

মিসেস মার্কেল স্পষ্ট করে না বললেও এক রকম স্বীকার করতে বাধ্য হন তিনি ভুল করেছেন। তিনি বলেন, ‘যদি পারতাম ঘড়ির কাঁটা কয়েক বছর পেছনে নিয়ে যেতাম।’ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে মিসেস মার্কেলের সিডিইউ দল খুবই খারাপ ফল করে। ১৯৪৯ সালের পর এটাই ছিল দলের সবচেয়ে শোচনীয় ফল, যা ছিল মিসেস মার্কেলের প্রতি জনসমর্থন তলানিতে যাওয়ার ইঙ্গিত।
এরপর থেকে জোট গঠন ও নির্ভরযোগ্য সরকার গঠন নিয়ে নানা জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন মিসেস মার্কেল।

প্রাদেশিক নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের প্রতি এবং দলের নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও সমর্থনের অভাব।

বেশ কয়েক মাস আগেই মিসেস মার্কেল ঘোষণা করেছিলেন, দলের প্রধানের পদের জন্য তিনি আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না এবং বর্তমান মেয়াদের পর চ্যান্সেলর পদের জন্যও তিনি আর দাঁড়াবেন না। সমালোচকেরা অনেকেই বলেছেন, দলের খারাপ ফল থেকে এটা পরিষ্কার, তার আগামীতে জেতার সম্ভাবনা সম্ভবত ক্ষীণ।

কারণ যা-ই হোক, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের তিনিই সবচেয়ে বেশি মেয়াদে থাকা দলীয় প্রধান এবং আধুনিক জার্মানিতেও তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতাসীন নেতা।

 


আরো সংবাদ



premium cement