২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঐক্যফ্রন্ট, বেগম জিয়া ও ড. কামাল

-

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের আবির্ভাবের ফলে বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের দমন-পীড়নমূলক নীতির দরুন এক ধরনের গুমোট আবহাওয়া বিরাজ করছে। ন্যায্য-অন্যায্য কোনো ধরনের বিরোধিতাই ক্ষমতাসীনেরা বরদাশত করতে চাচ্ছে না। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মতো অনেকেই সরকারের রোষানলে দগ্ধ হচ্ছেন। বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস সরকারের অদূরদর্শী ও হঠকারী কার্যকলাপের চরম উদাহরণ।

এমন অরাজক অবস্থায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ ধানের শীষকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মেনে নিয়ে একটি শক্তিশালী নির্বাচনী ও আন্দলনী জোট গঠন করে সরকারকে এই প্রথম সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছেন। সরকারের মধ্যে এতদিন যে নিশ্চিত আয়েশি ভাবভঙ্গি দেখা যাচ্ছিল, তার অবসান হয়েছে। দলের প্রধান মুখোপাত্র ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সুর না হলেও সারমর্মের পরিবর্তন হয়েছে। বিরোধী শিবিরে বিশেষ করে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে দৃঢ়তার আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারি তরফের হাজারো বাধা সত্ত্বেও ঐক্যফ্রন্টের জনসভাগুলোর আয়তন বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে উঠেছে।

এ সবের পেছনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে ড. কামাল হোসেন যে রূপ মুন্সিয়ানার সাথে বিভিন্ন দল, মত ও ধারার নেতাদের ধানের শীষ প্রতীকের আওতায় ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন, তা সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে।

অত্যন্ত আশার কথা হচ্ছে, ঐক্যফ্রন্টের ভেতরে এখন পর্যন্ত কোনো নেতৃত্বের সঙ্কট দেখা যায়নি। বিশেষ করে বিকল্প ধারার ঐক্যফ্রন্টে যোগ না দেয়ায় ঐক্যফ্রন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ থেকে বেঁচে গেছে বলেই মনে করছেন সচেতন মহল। বিকল্প ধারাকে নিয়ে বি. চৌধুরী আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠে বসায় বিএনপি স্বস্তিবোধ করছে। এ ক্ষেত্রে একটি অনিবার্য প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর বিরোধী হিসেবে তো তিনি এ পর্যন্ত অসংখ্যবার বক্তব্য রেখেছেন এবং ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিতেও গিয়েছিলেন। ‘পড়তা না পড়ায়’ ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু কোন যুক্তিতে তিনি নৌকায় উঠে গেলেন?

ড. কামাল হোসেনকে নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তা হচ্ছে- তিনি কেন তার একমাত্র রাজনৈতিক গুরু বঙ্গবন্ধুর কন্যার আওয়ামী লীগের বিপক্ষে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপিকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তুললেন? তিনি তো নিরপেক্ষ থাকতে পারতেন। একটি পুরনো ঘটনা, যা অনেকেরই হয়তো মনে আছে- এতে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম ক্ষমতা গ্রহণের পর সিমিটার কোম্পানি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের মামলা করেছিল। ৫০০ কোটি টাকা তখন দেশের জন্য বিশাল পরিমাণ অর্থ। বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যবান রিজার্ভ না ভেঙে ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া বাংলাদেশের পক্ষে তখন সম্ভব ছিল না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার অনুরোধে ড. কামাল হোসেন ওই মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে লড়েছিলেন এবং বাংলাদেশকে জিতিয়ে ক্ষতিপূরণের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার অনুরোধ সত্ত্বেও ড. কামাল হোসেন সেই মামলায় কোনো ফি গ্রহণ করেননি। তার দিকে তখন তার দল গণফোরাম ফান্ড সঙ্কটে ভুগছিল।

ড. কামাল হোসেন বা বেগম জিয়া যদি অসৎ হতেন, তা হলে মামলায় হেরে বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণের ৫০০ কোটি টাকা সিমিটার কোম্পানিকে দিতে হতো। এ দিকে, কোটি কোটি টাকা খালেদা জিয়া আর ড. কামাল হোসেনের অ্যাকাউন্টে জমা হতো। সেসব কিছুই ঘটেনি; কারণ তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হননি। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের এক-দেড় কোটি টাকা তছরুপের মামলায় জেলে যেতে হয়েছে এবং এ ধরনের আরো কথিত দুর্নীতির মামলা করা হয়েছে। সততা ও দেশপ্রেমকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়া ও কামাল হোসেনের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

সেই সম্পর্কটা যে অটুট আছে, তা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে আবার পরিস্ফুট হলো। অপর দিকে, এমন সম্পর্ক শেখ হাসিনার সাথে ড. কামাল হোসেনের কখনোই গড়ে ওঠেনি। অথচ তাদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার দারুণ সুযোগ ছিল। কেন না, ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার বাংলাদেশে আগমন এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রী পদে অধিষ্ঠান ড. কামাল হোসেনের প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হয়েছিল। তারপরও হাসিনার সাথে তার সম্পর্কটা বরাবরই তিক্ত, কলহপূর্ণ ও শীতল।

সময়ের দাবি মেনেই ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্টের কাণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এস এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া ও সাবেক তথ্যপ্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদের মতো অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছেন। গোলাম মাওলা রনির মতো সুপরিচিত কলামিস্ট ও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সরাসরি বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। নির্বাচন উপলক্ষে যোগ-বিয়োগের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। দেখার বিষয়, ঐক্যফ্রন্ট সামনের দিনগুলোতে কতটা কী করতে পারে। ঐক্যফ্রন্ট কি সরকারের কাছ থেকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করে সেই নির্বাচনে জিতে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে পারবে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য সবাইকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত, রাজনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সামনের দিনগুলোতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের কার্যক্রমের ওপরই বাংলাদেশের রাজনীতির ভালো-মন্দ অনেকখানি নির্ভর করছে।


আরো সংবাদ



premium cement