২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় তুরস্কের ভূমিকা

লিবিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় তুরস্কের ভূমিকা - ছবি : সংগৃহীত

যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহায়তার জন্য চলতি সপ্তাহে ইতালি একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। এই সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বৃহত্তর ভূমিকা পালনকারী তুরস্ককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতাইয়ের নেতৃত্বে তুরস্কের সিনিয়র কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে।

তুরস্কের দৃষ্টিতে হতাশাজনকভাবে সম্মেলনটি শেষ হয়। তুরস্ক দেখতে পায়, তাদের প্রতিনিধিদলকে বাইরে রেখে সম্মেলনের সাইডলাইনে অন্যদের নিয়ে একটি মিনি বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। লিবিয়ার সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক দেশ ইতালির প্রধানমন্ত্রী এ বৈঠকের আয়োজন করেন। বৈঠকে আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান এবং আঞ্চলিক খেলোয়াড়েরা অংশগ্রহণ করেন।

জনাব ওকতাই বলেন, ‘কয়েকজন খেলোয়াড়কে নিয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করা হয়। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের অত্যন্ত বিপদগামী ও ধ্বংসাত্মক পথে চলার দিকনির্দেশনা দেন- আমরা এর তীব্র বিরোধিতা করি। কিছু দেশ যত দিন পর্যন্ত তাদের নিজেদের স্বার্থে লিবিয়াকে স্থিতিশীল করার বিরুদ্ধে তাদের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা অব্যাহত রাখবে তত দিন পর্যন্ত দেশটিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। লিবিয়ায় বেশি বেশি বিদেশী হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। আঙ্কারা জানিয়েছে, তারা অন্য দেশের মতো নয়। তারা লিবিয়ার সব মানুষ এবং আঞ্চলিক অভিনেতাদের সাথে সংলাপ করবে। তুরস্ককে বৈঠকের বাইরে রেখে শান্তিপ্রক্রিয়া চালানো হলে তুরস্ক তাতে কোনো অবদান রাখতে পারবে না। ওকতাই বলেন, লিবিয়ার বর্তমান জটিল পরিস্থিতির জন্য যারা দায়ী, তাদের দ্বারা সঙ্কট থেকে দেশটির পুনরুদ্ধারে কোনো ইতিবাচক অবদান রাখা সম্ভব হবে না।

লিবিয়ার অস্থিতিশীলতাকে পুঁজি করে অন্যান্য দেশ নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থোদ্ধারে তৎপর হয়ে ওঠায় লিবিয়া উদ্বিগ্ন।

তুর্কি পক্ষকে শান্তিপ্রক্রিয়া প্রত্যাহার থেকে বিরত রাখার জন্য ইতালির প্রধানমন্ত্রী গিওসিপি কন্টি তুর্কি নেতা ওকতাইর সাথে দু’বার সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানা গেছে। কন্টি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওকতাই সম্মেলন ত্যাগ করায় আমি দুঃখ পেয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে এ ধরনের সিদ্ধান্তে হয়তো বিশেষ অভিমান বা সংবেদনশীলতা রয়েছে।’

অন্যান্য অনেক দেশের মতোই তুরস্ক লিবিয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠার পর থেকে এ পর্যন্ত শান্তিপ্রক্রিয়ার অংশীদার হতে আগ্রহী। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিবিয়ার কাছে পরীক্ষিত। ২০১১ সালের প্রারম্ভে লিবিয়া যখন আরব বসন্তে উপনীত হয় এবং সেখানে রক্তপাত সংঘটিত হয়Ñ তখন আঙ্কারা প্রথমে ন্যাটোর হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল।

কিন্তু পরবর্তীকালে এটি যখন স্পষ্ট হয়ে উঠল, পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে এবং ন্যাটো তুরস্ককে সাথে নিয়ে অথবা তুরস্ককে ছাড়াই হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে তখন তুরস্ক দ্রুত অপারেশনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; যার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে সরকারের পরিবর্তন ঘটে। অর্থনৈতিক উদ্বেগের বিষয়টি মাথায় রেখেই তুরস্ক প্রথম দিকে এই অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তুরস্কের কাছে লিবিয়ার পরিস্থিতি তিউনিসিয়া ও মিসরের মতো নয়। লিবিয়ায় রয়েছে তুরস্কের ব্যাপক বিনিয়োগ। সেখানকার নির্মাণ খাতে তুরস্ক শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। বর্তমান তুর্কি নীতিতে এখনো অর্থনৈতিক উদ্বেগই সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অন্যান্য দেশ বলিভিয়ার অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগাতে চায়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চলতি সপ্তাহে লিবিয়ায় তার সফরের সময় তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সরকারের কাছে একটি মানচিত্র উপস্থাপন করেছেন বলে জানা গেছে। এই মানচিত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, গ্রিস লিবিয়ার অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে এবং লিবিয়ার উপমহাদেশীয় অবস্থান লঙ্ঘন করার চেষ্টা করছে। তুরস্ক ভূমধ্যসাগরীয় জ্বালানি সম্পদ নিয়ে এরই মধ্যে গ্রিসের সাথে বিরোধে জড়িয়েছে আর ভূমধ্যসাগরীয় জ্বালানি নিয়ে যে রাজনীতি চলছে তাতে লিবিয়াও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ন্যাটোর হস্তক্ষেপের ব্যাপারে আঙ্কারার সংশয়ের অন্য একটি কারণ হলো, আমেরিকার ইরাক আগ্রাসনের কারণে তুরস্কের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়া। আঙ্কারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও ইউরোপীয়দের প্রতি লিবীয় ইস্যুকে তেল স্বার্থের ভিত্তিতে নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউরোপীয় শক্তিগুলো লিবিয়ার মাধ্যমে অন্যত্র গমন, মানবপাচার এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তৈরি করতে জরুরি ভিত্তিতে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। সঙ্ঘাতের একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে ইউরোপীয় এবং আঞ্চলিক অভিনেতারা- সর্বোত্তম অপশন হিসেবে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তি বিশেষভাবে তুরস্কের সাথে অধিকতর সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। একটি ভূমধ্যসাগরীয় দেশকে বাইরে রাখলে শান্তিপ্রক্রিয়া অচল হয়ে পড়তে পারে।

ইরাক ও আফগানিস্তানের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, মিত্রদের স্থানীয় অভিনেতাদের সম্পৃক্ত করে একটি শক্তিশালী নীতি বা কৌশল প্রয়োজন, যেন শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জ্বালানি সম্পদকে রক্ষা করা যায়। লিবিয়া প্রশ্নে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় তুরস্ক-রাশিয়ার বর্তমান সহযোগিতায় বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। মস্কো হয়তো লিবিয়ার ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দিয়ে শান্তিপ্রক্রিয়ায় আঙ্কারার অংশগ্রহণ চাইতে পারে। উল্লেখ্য, মস্কো লিবিয়ার যুদ্ধরত দলগুলোকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার জন্য একটি বৃহত্তর ভূমিকা পালনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

দেশের ভবিষ্যতের জন্য লিবিয়ার সব পক্ষ এবং সব আঞ্চলিক কুশীলবকে (তাদের পররাষ্ট্রনীতি যা-ই হোক না কেন) নিয়ে একটি বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement