২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্বপ্ন ও লোভের সীমানা

-

ইচ্ছের পাখিরাই জীবনে স্বপ্ন হয়ে ওড়ে। স্বপ্নগুলো দানা বাঁধে বুকের ভেতর। তারপর স্বপ্ন ছুঁতে ছোটে মানুষ। কখনো ধরা কখনো অধরায় থেকে যায় স্বপ্নরা। থেকে যায় স্পর্শের বাইরে। স্বপ্ন ছুঁতে গেলেই সে ছায়ার মতো সরে যায়। ধরার আগেই ফসকায় হাত থেকে। ক্রমেই হয়ে ওঠে দূরের। বহু দূরের। যখন দূরের, বুকের ভেতর জেগে ওঠে বেদনার ঢেউ। ছলাৎ ছলাৎ বাজে হৃদয়ের পাশে। কান পাতে মানুষ। শোনে বেদনার রোদন। দুঃখের দহন। আর না পাওয়ার জ্বলন-পোড়ন।

এভাবেই কারো কারো স্বপ্ন মরে যায়। কারো বিষন্নতায় ভরে ওঠে। না পাওয়ার দুর্ভাবনায় কারো ঘুমহীন হয়ে ওঠে চোখ। কখনো কখনো চোখের কোণায় নেমে আসে জলের ধারা। কারো চোখ থাকে অশ্রুহীন। হৃদয়ের জ্বালা ও দহনে দগ্ধ হতে থাকে এমন মানুষেরা। জীবনের স্বপ্নগুলো সাজানোর সুযোগ যেন মেলেই না এদের। মেলে না গুছিয়ে তোলার আনন্দ। স্বপ্নের পাখিগুলো ওড়ে না তেমন।

কত ইচ্ছের ফুল ফোটে মানুষের বুকের ভেতর। জীবনকে অন্যরকম করে সাজিয়ে তোলার অভিপ্রায় দুরন্ত হয়। ভাবে সবার চেয়ে আমি আলাদা। আমি বেড়ে উঠব নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে। লেখাপড়া, কাজকর্ম, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া ও অর্থবৃত্তে। কিন্তু জীবন বাড়তে থাকে আর স্বপ্ন কমতে থাকে। কমতে থাকে, কেননা সাফল্যের পথ বড় কঠিন। বড় বন্ধুর। বন্ধুর পথে চলতে চলতে নেমে আসে ক্লান্তি। স্বপ্নের দিকে ছুটতে ছুটতে বেড়ে ওঠে হতাশা। এভাবে ক্লান্তি আর হতাশার জ্বরে আক্রান্ত মানুষ মনের দিকে থাকে দুর্বল। স্বপ্নডানা আর বিস্তারিত হয় না। ডানা খোলে না স্বপ্নপাখি। স্বপ্নগুলো মরতে থাকে। বুকের ভেতর বাড়তে থাকে হাহাকার। অবসাদ নেমে আসে জীবনে। চারদিকে দেখে নৈরাশ্যের ছায়া। জীবনের পরিধি ক্ষীণ হতে থাকে। বিচরণক্ষেত্র হয়ে যায় সীমাবদ্ধ। বন্ধুর সংখ্যা কমে যায়। তখন মানুষ নিজের কাছে নিজে পরাজিত হতে থাকে। নিজেকে বেমানান মনে হয় সব ক্ষেত্রে। ভাবতে থাকে আমি এর উপযোগী নই। মনে হয় পৃথিবী অবহেলা করে। এভাবে নিজের কাছে নিজেই পরাজিত হতে থাকে মানুষ। সমাজ সংসার মনে হয় অসার। জীবনকে মনে হয় বেদনার এক বারিধি।

কেন স্বপ্নভঙ্গ হয় মানুষের? কেন মরে যায় স্বপ্নের মতো আশ্চর্য পাখি। স্বপ্নই তো বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। তবে? স্বপ্ন মরে গেলে বেঁচে থাকে মানুষ? হয়তো বেঁচে থাকে। জীবিত থাকে। কিন্তু জীবন্ত থাকে না। থাকতে পারে না। কারণ, স্বপ্নের উষ্ণতা ছাড়া জীবন্ত থাকার পথ কই? স্বপ্নই জীবন্ত রাখে মানুষকে। স্বপ্নই জাগিয়ে রাখে জীবনের দিকে।

কখনো কখনো স্বপ্নভঙ্গ মানুষেরা হয়ে যায় মানুষবিদ্বেষী। কোনো স্বাপ্নিক মানুষকে গ্রহণ করার সাহস থাকে না এদের। মানুষের সুখ দেখে অসুখে ভোগে এরা। সাফল্য দেখে জ্বলে ভেতরের সব। জ্বালায় পরশ্রীকাতরতার আগুন। বুদ্ধিদীপ্ত কোনো মানুষ থাকে না এদের পছন্দের আওতায়। হিংসাবিদ্বেষ আর প্রতিশোধস্পৃহা এসব মানুষকে নামিয়ে আনে অমানুষের কাতারে। তখন লোভী হয়ে ওঠে মানুষ।

আমাদের সমাজে এসব লোভী মানুষের ছড়াছড়ি। লোভী মানুষেরাই কেড়ে নেয় অন্যের অধিকার। ন্যায়-অন্যায়ের ব্যবধান থাকে না এসব মানুষের। সুন্দর-অসুন্দরের চিন্তাও উবে যায়। কে কী বলল, কে কী করল- এসবের বাছবিচারও তিরোহিত হয়ে যায়। শুধু অধিগ্রহণের লালসায় অস্থির হয়ে ওঠে। যোগ্য-অযোগ্য থাকে না তার বিবেচনায়। সমাজে অসুখ আনে এসব মানুষই।

লোভী মানুষেরা আত্মকেন্দ্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং চূড়ান্ত স্বার্থপরতায় আক্রান্ত। নিজের সম্মান-মর্যাদা রক্ষার দুর্গ নির্মাণে তৎপর এরা। এতে কেউ অপমানিত হলেও এদের কিছু যায় আসে না, বরং এদের লোভের ফণা উদ্যত হতেই থাকে। লালসার আগুন জ্বালতেই থাকে। এ আগুন দগ্ধ করে এদেরকে এবং এদের চারপাশের সবাইকে। লালসার আগুনে দগ্ধ হতে হতে এরা হয়ে ওঠে নির্মম। এসব মানুষের থাকে না হৃদয়বৃত্তি। মায়া-মমতা ও প্রেমের মতো অমূল্য সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যায় এদের হৃদয় থেকে। নৃশংসতায় ভরে যায় বুক। সম্মানিত মানুষের সম্মান রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না এদের পক্ষে। হামলে পড়ে ভদ্রতার শরীরে।

এভাবে মানুষেরা হেরে যায় মানুষের কাছে। মানুষেরা ছোট হয় মানুষের কাছে এবং মানুষেরা ঘৃণার পাত্র হয় মানুষের কাছে।
আহা জীবন কী সুন্দর, কী মায়াবী- এ কথা বোঝে না মানুষ। জীবনের আনন্দ জানে না মানুষ। জীবনের প্রশান্তি আনে না মানুষ। সুখের জন্য দুঃখ খরিদ করে তারা। শান্তির জন্য কেবলই জ্বালাই অশান্তির আগুন।

অথচ জীবনে স্বপ্নকে ধীরে ধীরে সাজাতে হয়। স্বপ্নের পথে সাধনার প্রদীপ জ্বালাতে হয়। দীর্ঘ করে তুলতে হয় স্বপ্নের পথ। স্বপ্ন যেমন তেমনি জ্বালতে হয় কর্মের বাতি। তেমনি রচনা করতে হয় সাফল্যের গান। তারপরই যোগ হয় বিজয়ের সুর। যে সুর মানুষকে শোনায় সাফল্যের গীতি।

লোভী মানুষ আর স্বাপ্নিক মানুষ কখনো এক হতে পারে না। কেননা লোভ স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন ও লোভ নয়। লোভী সুপথ ছেড়ে কুপথে এগোয়। স্বাপ্নিক কেবল সুপথকেই বেছে নেয়। লোভী যেকোনো উপায়ে তার লালসা চরিতার্থ করে। স্বাপ্নিক তার যোগ্যতার নিরিখে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য লাভ করে। এখানেই স্বপ্নের প্রেরণা। এখানেই স্বপ্নের বসতি। স্বপ্ন লোভ ছাড়িয়ে মাথা তোলে আকাশের বুকে। লোভ কেবল খোঁজে চোরাগলির পথ।

স্বাপ্নিক মানুষ সুখী নিরন্তর। বুকের ভেতর আশা জেগে থাকে তার। বেদনার অলিগলি পেরিয়ে আনন্দের রাজপথে তার পদচারণা। দুঃখরা ব্যথিত করে না তাকে। হতাশার নির্মম চাবুক পায় না তার নাগাল। একজন স্বাপ্নিক, তিনি প্রকৃতির মতো সচ্ছল। রৌদ্রের মতো উজ্জ্বল। বৃষ্টির মতো উৎসবমুখর এবং ছায়ার আরামের মতো প্রাণময়। সে জীবনকে জাগিয়ে রাখে সাহসের পাশে। শক্তির উৎস খুলে দেয় সাহস। বুকে জাগিয়ে দেয় প্রেরণার ঢেউ। তখন উন্মুখ হয় জীবনকে ভালোবাসার মন। এমন মনের অধিকারী মানুষই হয় উদার। ঔদার্যের আঙিনায় ওড়ে তার প্রশংসার নিশান।

একজন লোভী মানুষ ভীষণ অসুখী। তার বুকের ভেতর খেলা করে অসুখের জল। অস্থিরতা সঙ্গী হয়ে ওঠে তার। কোনোভাবেই শান্তির মুখ উঁকি দেয় না তার মনের ঘরে। একজন লোভী নিজের কাছে নিজেকে তুচ্ছ করে তোলে। তার দৃষ্টি নীচ। হৃদয় সঙ্কীর্ণ এবং মনের দেশ যন্ত্রণার লেলিহান। খোলা মনে মেশে না মানুষের সাথে।

লোভ এক ধরনের মনের অসুখ। এ এক অসুস্থ অজগর। জীবনের সব কিছু গিলে নিতে চায়। সব ঠেলে দিতে চায় নিজের পেটের ভেতর। এর মুখে লাগাম না পরালে ফুলতেই থাকে মনের ভেতর। ফলে তৃপ্তি আসে না কিছুতেই। মাটি ছাড়া আর কিছু এদের পূর্ণতা দিতে পারে না। সব পাওয়ার মানসিকতা এবং সব খাওয়ার আকাক্সক্ষা লোভীর বুকে জাগিয়ে দেয় দুঃখের অনল।

মানুষেরা কেন স্বপ্নের পরিবর্তে লোভ লালন করে? কেন নিজেকে নিজের কাছে নগণ্য করার কর্মে পারদর্শী হয়! কেন অন্যের চোখে বদলোক হিসেবে চিহ্নিত হয়! স্বপ্ন মানুষকে সুন্দর করে। যোগ্য করে। উপযুক্ত করে জীবনকে। তবুও মানুষ স্বপ্নের বদলে লালন করে লোভের দহন। তবুও মানুষ স্বপ্ন ফেলে লোভ তুলে নেয় বুকের ভেতর।

সুযোগের অভাবে স্বপ্নভঙ্গ হয় কারো কারো। কারো আবার আলস্য এবং যথাযথ পদক্ষেপের কারণেও ভেঙে যায় স্বপ্নের সেতু। কেউ কেউ ঠেলে দেয় অবহেলার দিকে। সাফল্যের দিকে যেতে হলে মানুষকে হতে হয় পরিশ্রমী। থাকতে হয় ধৈর্যের সাথে। ধৈর্যহীন স্বাপ্নিক পরাজিত হয় লোভের কাছে।

কেউ কেউ অনেক চেষ্টা করেও স্বপ্ন ছুঁতে পারে না। এখানে প্রথমত ধরে নেয়া যায় হয়তো স্বপ্নের পক্ষে তার পদক্ষেপ দৃঢ় ছিল না অথবা সাধনা ছিল না যথার্থ। অথবা স্বপ্নকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ ছিল দুর্বল। কোনো-না-কোনো ফাঁক গলে স্বপ্ন উড়ে যায় বুকের ভেতর থেকে কিংবা মরে যায় বুকের ভেতরেই।

কিন্তু স্বপ্ন যদি হয় দৃঢ়তার সঙ্গী এবং যদি হয় যথাযথ পদক্ষেপ, তবে সাফল্য ধরা দেবেই। আসবেই সে জীবনের আঙিনায়। তার পাখার দোলানি জীবনে সুবাতাস উড়িয়ে দেবেই। জীবনকে জাগিয়ে দেবে অর্থবহতার আনন্দে। কেবল তখনই বোঝা যায় জীবন এক আশ্চর্য সুন্দরের নাম। জীবন এক বিস্ময় অনুভূতির নাম। জীবনের কোনো নির্দিষ্টতা নেই। নেই কোনো নিশ্চিত যাত্রা। তবে জীবন তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্নের নেই কোনো সীমানা! এভাবে লোভও সীমাহীন।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল