২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিচারবহির্ভূত হত্যা-গুম ও আত্মরক্ষার অধিকার

-

সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্যকারী ও পরিচয়পত্র প্রদর্শনবিহীন সাদা পোশাকধারী পুলিশ কর্তৃক যখন তখন যাকে খুশি তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, অতঃপর সেই আটকের বিষয় পরবর্তীকালে অস্বীকার করে হয় গুম করে ফেলা, নতুবা যা দেশের একটি মানুষও বিশ্বাস করে না, সেই তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা অথবা সাদা পোশাকের পুলিশের ছদ্মবেশ ধারণকারী অপর কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক কাউকে জোরপূর্বক অপহরণের পর হতভাগ্য সেই ব্যক্তির ‘নাই’ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও দেশের অপরাধ দমন ও উদঘাটনে বৈধ কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের কর্তাব্যক্তিদের রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তা- ইত্যাদি কারণেই এ দেশের মুষ্টিমেয় কিছু সরকারি দলের সক্রিয় নেতাকর্মী ব্যতীত আর সবার জীবন এখন যেকোনো গৃহপালিত পশুপ্রাণীর চেয়েও অনেক অনেক সস্তায় পরিণত হয়েছে।

এক.
পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাপ্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের শিকার হয়ে এ পৃথিবী থেকে ‘নাই’ হয়ে গেছেন ১৮৯২ জন হতভাগ্য মানুষ। পাওয়া বিবরণ অনুযায়ী, এর মধ্যে মে ’১৮ থেকে জুলাই ’১৮ পর্যন্ত শুধু ‘মাদক কারবারি’ উপাধি দিয়ে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে ২১১ জনকে। যে কার্যক্রম অদ্যাবধি চলমান প্রতিদিনই কম-বেশি দু-একজন করে হত্যা করার মাধ্যমে। সুতরাং তারপর থেকে পরবর্তী গত তিন মাসে সেই সংখ্যা কত হতে পারে সম্মানিত পাঠক তা অনুমান করতে পারেন। নভেম্বর মাসেই হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে, যাদের বেশির ভাগ হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল; যার আয়রোজগারের ওপর হয়তো নির্ভরশীল ছিল তার পুরো পরিবার।

এই লেখা তৈরির সময় মাসের বাকি আছে আরো তিন দিন। আল্লাহই জানেন এ তিন দিন শেষে সেই সংখ্যা মোট কততে গিয়ে দাঁড়াবে। তবে ভুক্তভোগীদের আশঙ্কা, আসন্ন সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এ হত্যাকাণ্ডের সংখ্যার হার ততই বৃদ্ধি পেতে থাকবে দু’টি কারণে- প্রথমত, দানবীয় এসব ‘সাদা পোশাকধারী’র কর্তৃত্ব, সক্ষমতা ও অপ্রতিরোধ্যতা প্রদর্শনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে এদের সম্পর্কে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা।
দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনে অপছন্দের রাজনৈতিক কর্মীদেরও সুবিধাজনক এমন কিছু উপাধি দিয়ে খুন-গুম করা হলেও জনসাধারণ চিন্তাচেতনায় তা যেন সহনীয় তথা নৈমিত্তিক বিষয় বলেই মনে হয়, এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা।

দুই.
সার্বিক অবস্থা তথা আইনি ব্যাখ্যা বিবেচনায় যে কারণে তথাকথিত ক্রসফায়ার ‘ঠাণ্ডা মাথার খুন’ বলে বিবেচিত-
ক. প্রতিটি ঘটনায়ই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী (তা নিজেরাই করুক অথবা তাদের হেফাজতে থাকা ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার দায়ভারের কারণেই হোক) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী র‌্যাব-পুলিশ বাহিনীর বয়ান মোটামুটি একই রকম।
খ. গত দশ বছরে পুলিশি নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা এমন শত শত মানুষ তথাকথিত সেই ক্রসফায়ারে নিহত হলেও পুলিশের কোনো সদস্য নিহত বা গুরুতর আহত হয়েছেন, এমন একটি নজিরও নেই।

গ. পিআরবি ধারা-১৫৭ (বা সংশ্লিষ্ট মেট্রো পুলিশ রুলস) অনুযায়ী, পুলিশ কর্তৃক প্রতিটি গুলি বর্ষণের ঘটনার পরপরই প্রকাশ্য নির্বাহী তদন্ত করে সেই গুলি বর্ষণের যথার্থতা তথা পুলিশের দায়দায়িত্ব নিরূপণের যে বিধান আছে, তা-ও গত দশ বছরে কখনো প্রতিপালিত হয়েছে, এমনটি এ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি।

সুতরাং এতদবিষয়ে এ পর্যন্ত সরকারি ব্যাখ্যা-বিবৃতি যা-ই প্রদান করা হোক না কেন, এটা যে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক ‘কর্তৃত্ববান কোনো ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করা’র মাধ্যমে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই তারা করে আসছে, তাতে জনমনে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আইনের পরিভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে, ‘মার্ডার ফর গেইন’।

আর তাই এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা সৃষ্টি হলে যদি কোনো নাগরিক তা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করে বসেন, তবে নিরপেক্ষ বিচারে তা যে যথার্থ বলেই পরিগণিত হবে তাতেও কোনো সংশয় নেই।
আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার বিষয়ে দণ্ডবিধি আইনের ১০০ ধারায় বলা হয়েছে, ৯৯ ধারার শর্তসাপেক্ষে যেকোনো ব্যক্তি নি¤œলিখিত ক্ষেত্রগুলোতে নিজের এবং অপরের দেহ রক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে যেয়ে আক্রমণকারী, সে যেই হোক, তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারেন-

প্রথমত/দ্বিতীয়ত, সেই আক্রমণ যদি এমন হয় যে, তার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু/গুরুতর আহত হতে
পারেন মর্মে যুক্তিসঙ্গত আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
তৃতীয়ত, . . .; চতুর্থত, . . .; পঞ্চমত, . . .;
ষষ্ঠত, কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক করার ইচ্ছা নিয়ে যদি কেউ আক্রমণ করে, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির এ রকম আতঙ্কের সৃষ্টি হয় যে, তিনি সেই আটকাবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বৈধ কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের সাহায্য পাবেন না।

তিন.
যেভাবে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগের বিষয়ে একজন ভুক্তভোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন- পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ তথা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো পরিচয় না দিয়ে বা কিছুই না বলে টেনেহিঁচড়ে কোনো ব্যক্তিকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর যখন সেই ব্যক্তির নিকটাত্মীয় আইন ও রীতি অনুযায়ী সর্বপ্রথম সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করছেন, তখন থানার ওসি সেই আটকের বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করে নীরব-নিষ্ক্রিয় থাকছেন। অথচ এ ক্ষেত্রে তিনিই হচ্ছেন দণ্ডবিধি ধারা-১০০ বর্ণিত সেই বৈধ সরকারি কর্তৃপক্ষ। এটা তিনি করতে পারেন না। কেননা তা একটি ফৌজদারি অপরাধ বলে বিবেচ্য। এমনটি করার মাধ্যমে আইনগতভাবে তিনি নিজেকে এই অপরাধমূলক ঘটনার সাথে জড়িত করে ফেলেন।

ফৌ:কা: ধারা-৪(১)(ণ) এর বর্ণনানুযায়ী কোনো [সরকারি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত] কর্মকর্তা যে কাজটি করতে আইনত বাধ্য, সে কাজটি যদি তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে এই বিরত থাকাও ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হয়ে যায়।

এমন সব অপহরণ/আটক ঘটনার ক্ষেত্রে থানার ওসির দায়িত্ব সম্পর্কে ফৌ:কা: ধারা-১৫৪/১৫৭ এবং পিআরবি ধারা-২৪৩ (বা সংশ্লিষ্ট মেট্রো পুলিশ রুলস)-এ বলা হয়েছে- ‘থানার ওসির নিকট কেউ এমন অপরাধ সংঘটনের সংবাদ নিয়ে এলে তিনি তা কোনোরূপ অজুহাত বা বিলম্ব ছাড়াই সেই বিষয়ে এজাহার দায়ের করে তা তদন্ত তথা উদঘাটনের জন্য সর্বপ্রকার আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।’
যেসব এলাকায় গত ১০ বছরে এ ধরনের অপহরণ-খুন-গুম ইত্যাদি হয়েছে, সেখানে ভুক্তভোগী অধিবাসীরা খুব ভালো করেই জানেন, সেই ঘটনাগুলো সংঘটনকারী কারা এবং বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত-নিষ্ক্রিয় থেকেছেন কারা।

সুতরাং সেসব চিহ্নিত পুলিশ কর্মচারী বা তাদের সহযোগী অন্য কোনো ব্যক্তি যদি অনুরূপ অপহরণ, খুন, গুম ইত্যাদি অপরাধের প্রচেষ্টা চালায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ ব্যতিরেকে জানমাল রক্ষার আর কোনো বিকল্পই থাকে না।
লেখক : ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ


আরো সংবাদ



premium cement
‘কাম না করলে তো ভাত জুটবো না, তাই রোইদের মধ্যেই কাম করি’ গাজা ইস্যুতে ইউরোপের নীতির সমালোচনায় অ্যামনেস্টি রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর গাজা যুদ্ধ নিয়ে প্রতিবাদ : নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৩৩ জন গ্রেফতার বিপজ্জনক মাত্রার অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতি থেকে বাঁচবেন কিভাবে বিয়ের বাজার শেষে বাড়ি ফেরা হলো না চাচা-ভাতিজির প্রধানমন্ত্রী আজ থাইল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন ভারতীয় ৩ সংস্থার মশলায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান সাবেক শিবির নেতা সুমনের পিতার মৃত্যুতে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের শোক গণকবরে লাশ খুঁজছেন শত শত ফিলিস্তিনি মা ভারতের লোকসভা নির্বাচনে আলোচনায় নেতাদের ভাই-বোন ও সন্তান সংখ্যা

সকল