২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রবৃদ্ধি বাড়াতে প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ন্ত্রণ

-

সম্প্রতি পত্রিকায় এসেছে প্রাণ-আরএফএল পণ্য উৎপাদনকারী গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার সব মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে শিল্প গ্রুপটির ব্যাংক ঋণ আছে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে শিল্প গ্রুপটির কাছে ব্যাংকগুলোর ঋণ দাঁড়িয়েছে ব্যবসায়ের প্রায় আড়াই গুণ। ব্যাংকারেরা বলেছেন, ঋণের সম্প্রসারণে রশি টেনে ধরা উচিত। ঋণ না বাড়িয়ে পরিশোধের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। জনগণের আমানতের টাকা ঋণ নিয়ে বার্ষিক টার্নওভার বাড়িয়েছেন। কিন্তু ঋণের টাকা ফেরত যে পরিমাণে দেয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে আড়াই গুণ কম হারে ঋণের টাকা পরিশোধ করেছেন।

এসব ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো জবাবদিহি আছে বলে মনে হয় না। শাসকগোষ্ঠী উন্নয়নের ডামাডোল বাজাচ্ছে, কিন্তু ব্যাংকগুলোর যে বার্ষিক লভ্যাংশ হারাচ্ছে, সেদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো দৃষ্টি আছে বলে মনে হয় না (সূত্র বণিকবার্তা, ৭ নভেম্বর ২০১৮)। আর্থিক খাতে যে অনিয়ম যা বহু বছর ধরে চলছে, সেই ছিদ্রপথ বন্ধ করা তো যায়নি, বরং তা আরো সম্প্রসারিত হয়েছে। সাধারণ অপরাধীকে ধরা সহজ, কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা কিংবা ব্যবসায়ী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সহজ কাজ নয়। বড় দুর্নীতির মধ্যে মানিলন্ডারিং ছাড়াও ঋণ আত্মসাৎ করা, ব্যাংকিং খাতে লুটপাট এবং সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাটের মহোৎসব চলছে সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চোখ বন্ধ করে রাজনীতি নিয়ে অতি মাত্রায় সময় ক্ষেপণ করছেন। ৩৬ কোটি হাত দিয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলবেষ্টিত বাংলাদেশকে মালয়েশিয়া শুধু নয়, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারের ধারেকাছেও আমরা পৌঁছাতে সক্ষম হইনি।

সরকার বলছে, দেশ উন্নয়নে সাগরে ভাসছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেশের অর্থনীতির সে অগ্রগতির সুফল পাচ্ছেন না। দেশের মোট জনশক্তির বড় অংশ প্রবৃদ্ধির সুফল থেকে বঞ্চিত। উন্নয়ন হলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জিডিপির প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে, সে অনুসারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। দেশে যে আর্থিক বৈষম্য বিরাজমান তা অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজ ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। অন্য দিকে, শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে, এর প্রভাব পড়ছে সার্বিক কর্মসংস্থানের ওপর। প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাঙালি যদি আর্থিক খাতে সব লেনদেন বন্ধ করে দেন, তা হলে বাংলাদেশের এক থেকে দুই মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম হবো না।

আমাদের দেশে মানহীন শিক্ষা কর্মসংস্থানে রাষ্ট্রের উন্নতির বড় বাধা। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে বিশিষ্টজনদের বক্তৃতায় এসব কথা উঠে আসে। গত ৪ নভেম্বর মরহুম অর্থনীতিবিদ আবদুর গফুর স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিশি ডায়লগের (সিপিএড) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিআইডিএসের রিসার্চ ফেলো ড. বিনায়ক সেন, সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

সবারই বক্তৃতার সারাংশ হলো- দেশের অর্থনীতিতে বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। এটি শুধু সম্পদের ক্ষেত্রে নয়, আয় ও ভোগের ক্ষেত্রেও বাড়ছে বৈষম্য। সম্প্রতি যোগ হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা ও আঞ্চলিক বৈষম্য। তারা আরো বলেছেন, বছরে ৯৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাজার ব্যবস্থায় আয় অনুপাতে ব্যয় বাড়ছে। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। একটি ইতিবাচক দিক হলোÑ-শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে একটি বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গড়ে তোলা। বাংলাদেশের বয়স ২০২১ সালে ৫০ বছরপূর্ণ করতে যাচ্ছে। তখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণার ওয়েলথএক্সের সর্ব সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে যে কথাটি বলতে হয়- গত পাঁচ বছরে বিশ্বে ধনীদের সম্পদ বাড়ানোর হারের বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যয়ের বোঝা বেড়েছে, আর কমেছে আয়ের বোঝা।

এক কথায় টাকা এখন ব্যাগে করে নিয়ে যাবেন, আবার ওই ব্যাগেই পণ্য কিনে ঘরে ফিরবেন। আমাদের অর্থনীতির মূল কাঠামোটা এমনভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে মনে হচ্ছে দেশে চেহারার চেয়ে মানুষের চেহারার পরিবর্তন দ্রুত গতিতে বাড়ছে। আজ বাংলাদেশে বিগত এক মাস থেকে প্রায় কয়েক শতাধিক প্রকল্প অনুমোদনের যে হিড়িক তা পৃথিবীর কোনো দেশে হয় বলে জানা নেই। নির্বাচন টার্গেট করে জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে এসব প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কাজই হলো নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া। পদ্মা সেতু- এই প্রকল্প শেষ হতে এখনো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ একটি প্রকল্প শেষ হতেই সময় লাগছে যেখানে চার থেকে পাঁচ বছর, সে ক্ষেত্রে দেশে মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কত সময় লাগবে তা পঞ্চাশের উপরে বয়সী মানুষ চোখে দেখে যেতে পারবেন না। রসিকজনের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি- দেশের জন্য যুদ্ধ করলাম যে কারণে, সেটা উপভোগ করার কথা ছিল বরং আরো প্রতিকূলতা বাড়িয়ে দিলো।

নভেম্বর ২০১৮ খোলাবাজারে এলপি গ্যাস কিনতে হচ্ছে ১২ লিটার (যার অর্ধেকই হাওয়া) এক হাজার ২৫০ টাকা। তিন মাস আগে ছিল এর দাম এক হাজার টাকা। দুই মাসের ব্যবধানে বেড়ে হয়েছে ২৫০ টাকা। নালিশ করার জায়গা পর্যন্ত এখন খোলা নেই। বুকের ব্যথা শুধু বুকের মধ্যে চেপে রাখা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। ৭ নভেম্বর ২০১৮ এক মন্ত্রীর কথা পত্রিকায় উঠেছে এভাবে- ৩৮ বছরের কাজ সাত বছরে করেছি। বর্তমান অর্থনীতির আকার ২৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা ৩৮ বছরের সরকারেরা পারেনি। কিন্তু বাস্তবে জনগণ এসব উন্নয়নের কতটুকু অংশীদার হতে পেরেছে এবং এদের শতাংশ হার কত। এসব বিবেচনা রাখতে হবে। এখন ৫০০ টাকা বাজারে নিয়ে গেলে শুধু সবজি কিনে বাসায় ফিরতে হয়।

সরকার বলছে- প্রায় এক হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার মাথাপিছু গড় আয় ২০১৮ সালে অর্জন সম্ভব হয়েছে। ঘুষখোর, লুটেরা এবং দুর্নীতিবাজদের টাকা যোগ করলে মাথাপিছু গড় আয় যথার্থ বলা যায়। কিন্তু তাদের টাকা বাদ দিলে ৭০০ ডলার মাথাপিছু গড় আয় হবে বলে মনে হয় না। আয় রোজগার ভালো হলে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে ভিক্ষুক মিসকিনদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে কেন? এখন তো পরিবহন খাতে এদের যন্ত্রণায় থাকা যায় না। এর পাশাপাশি হকারদেরও জ্বালা-যন্ত্রণা বাড়ছে। ফুটপাথ দখল এমনকি পরিবহন খাত, মসজিদ, মাদরাসা সব জায়গাই এদের উৎপাত লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে। বর্তমান সরকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে; কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সে হিসেবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা তাকিয়ে থাকেন প্রতি বছর বেতন কত বেড়েছে। যদি দেখেন ২০ শতাংশ বেতন বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তখন ব্যবসায়ীরা যৌথ উদ্যোগে শলাপরামর্শ করে বাজারে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেন। এর সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী মহল জড়িত থাকে বিধায় অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না।

৭ নভেম্বর ২০১৮ একটি দৈনিকে উঠেছে, আমদানি ব্যয় যেভাবে বেড়েছে; রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় সেভাবে বাড়েনি। ফলে গত দুই বছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্য নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর ধাক্কা লেগেছে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে। ফলে ক্রমবর্ধমান রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে বেশি, রাষ্ট্রের রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় অনেক দিন ধরে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স সরকারের ঘাটতি বাণিজ্য নিয়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টে আমাদানিতে আট দশমিক আট হাজার ২০০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি মাসেই দেশের আমদানি ব্যয় হচ্ছে গড়ে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার। গত সেপ্টেম্বর ২০১৮ মাসে রফতানি থেকে আয় হয়েছে দুই হাজার ৫৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার ওই সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে রফতানি আয়ের প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ ৭৪ হাজার ৫১ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। চলতি হিসাবের দীর্ঘ দিনের এই ঘাটতি নেতিবাচক ধারার নিয়ে গিয়েছিল ব্যালেন্স অব প্যামেন্টে। অর্থনীতির এই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ধারা অর্থাৎ বৃদ্ধি এবং কমে যাওয়া বাংলাদেশের ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ন্ত্রণ করে।

সম্প্রতি সরকারি রাজস্ব বিভাগ আয়কর বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মাইকিং করে জনগণের বাসাবাড়িতে জানান দিচ্ছে, বিদেশ থেকে আর ঋণ গ্রহণ নয়; নিজের আয়ে দেশ চালাব। কর দিলে ঋণ কমবে, মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবে। সাধারণ মানুষের যে আয় সে তো আয়করের আওতায় পড়ে না। কর যারা দেবেন, তারা দিচ্ছেন কর ফাঁকি। এদের ধরুন। কর ফাঁকি দেয়ার নানা ফন্দিফিকির এরাই করছেন। উপার্জিত কালো টাকা তারা কোথায় বিনিয়োগ করছেন, তা অনুসন্ধান করুন। করমেলা করে কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব নয়। উদীয়মান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে করের আওতায় আনুন। অবৈধ আয়ের উৎসগুলো বন্ধ করুন এবং কালো টাকার ওপর কর ধার্য করুন। আমদানির ও রফতানির মধ্যে ভারসাম্যযুক্ত একটি অর্থনীতি দেশের জন্য অতীব জরুরি। সেদিকে নজর দিন। তা হলেই বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে যাবে।
লেখক : গ্রন্থকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement