২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইরান-রাশিয়া-ভারত : যুক্তরাষ্ট্রের তিন সমীকরণ

ইরান-রাশিয়া-ভারত : যুক্তরাষ্ট্রের তিন সমীকরণ - ছবি : সংগৃহীত

আরো সাতটি দেশের সাথে ভারতকেও ইরান থেকে তেল আমদানির ব্যাপারে ছাড় দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র এখানেই থেমে থাকেনি, ইরানি বন্দর চাহাবার উন্নয়নে যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ভারত, তা এগিয়ে নিতেও সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ভারতের জন্য দু’টি সুখবর।
ইরান থেকে তেল কিনতে না পারলে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যেত ভারত। বিশেষ করে নির্বাচনী বছরে নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য তা বিপর্যয়কর হতে পারত বলে অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারত তেল কিনতে পারল।

আফগানিস্তানে প্রবেশের জন্য পাকিস্তানের করাচি বন্দরের ওপর নির্ভরতা কাটাতে চাহাবার বন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানকে কোণঠাসা করাও এই পরিকল্পনার অংশ। সেইসাথে মধ্য এশিয়ায় যাওয়ার একটি বিকল্প পথও খুঁজে নিতে চাইছে ভারত।

পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যেসব দেশ ইরানে বিনিয়োগ করবে, ইরানি তেল কিনবে, তাদের ওপরও এই অবরোধ আরোপ হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ইরানি তেলের অন্যতম ক্রেতা ভারতকেই ছাড় দিলো যুক্তরাষ্ট্র। এটি ইরানের জন্যও সুখবর। আবার চাহাবার বন্দরে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার সুযোগ দেয়ায় ইরান আরো স্বস্তিতে থাকার অবকাশ পেল।
মনে রাখতে হবে, চাহাবার বন্দর কেবল ভারতের কাজেই লাগবে না, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এই রুট ব্যবহার করে তারাও আফগানিস্তানে প্রবেশ করতে পারবে। ফলে পাকিস্তানের ওপর তাদের নির্ভরতাও অনেক কমবে। অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্র নানা কারণে খুব সহজেই এই বন্দর ব্যবহার করতে পারবে না।
আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার ব্যাপারেও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিএএটিএসএ আইনের আলোকে এই ক্রয়চুক্তির জন্য ভারতের ওপর অবরোধ আরোপ হওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে অপেক্ষা করার নীতি অবলম্বন করেছে।

ট্রাম্প কেন এত উদার হলেন? এর পেছনে বড় ধরনের কোনো হিসাব আছে? ইরানকে জব্দ করতে গিয়ে ইরানকে এমন সুবিধা প্রদান করার মানে কী?
একটি কারণ হতে পারে এই যে, খুব সম্ভবত মার্কিন প্রশাসন এখন ভারতের কাছ থেকে বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তির ঘোষণা আশা করছে। এটি হতে পারে এমন চুক্তি, যা নিশ্চিতভাবেই হোয়াইট হাউজকে খুশি করবে। এ প্রেক্ষাপটে গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে মার্কিন প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে হওয়া ২+২ সংলাপের বিষয়টি মনে করা যেতে পারে। ওই সভায় কমিউনিকেশন্স ইন্টারোপারেবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট (সিআইএসএমওএ) নিয়ে ভারতের আপত্তি দূর করা হয়, কমিউনিকেশন্স কম্পাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (সিওএমসিএএসএ) সই করার ব্যাপারে আরো কাছাকাছি আসে দুই দেশ।

সামরিক তথ্য বিনিময় সবসময়ই একটি আক্রমণাত্মক পরিভাষা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। ভারত এ নিয়ে অনেক হইচই করেছে। ব্রাজিল, মরক্কো ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অ-ন্যাটো সদস্যদের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের চুক্তি করেছে। ফলে বিষয়টি অনেক বেশি পরিচিত। আর সিওমসিএএসএ তুলনামূলকভাবে নীরবে অনুসরণ করা যায়। এতে নথিপত্র গোপন থাকে। ফলে এটি অনেক বাস্তবসম্মত বিবেচিত হয়ে থাকে।

ভারত ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অস্ত্র চুক্তি করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে সি-১৭ গ্লোবমাস্টার, সি-১৩০জে পরিবহন বিমান, পি-৮১ নৌবিমান, এম৭৭৭ হাউটজার, হারপুন ক্ষেপণাস্ত্র, অ্যাপাচি ও চিনুক হেলিকপ্টার। ভারত এখন সি গার্ডিয়ান ড্রোন কিনতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। এই চুক্তি হলে দুই দেশের মধ্যকার সামরিক সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হতে পারে।
এ ছাড়া লকহিড মার্টিন ও বোয়িংয়ের মতো মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদারেরা বিপুল অঙ্কের অস্ত্র চুুক্তির জন্য কাজ করছে। বিশেষ করে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে ১১০টি জঙ্গি বিমান, ৫৭টি মাল্টি রোল ক্যারিয়ার বোর্ন বিমান (এমআরসিপিএফ), ২৩৪টি নৌ ও বহুমুখী ব্যবহার্য হেলিকপ্টার বিক্রির জন্য চেষ্টার করছে।
এ ধরনের বিপুল অর্ডার পাইপলাইনে থাকায় ভারত বা রাশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক যাই হোক না কেন, মার্কিন প্রশাসন দিল্লিকে অসন্তুষ্ট করতে অবশ্যই সংযত থাকবে। কারণ এতে করে শেষ পর্যন্ত তাদেরই ক্ষতি হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভারত নীতিতে রয়েছে তেল আমদানিতে ইরানের ওপর এবং অস্ত্র আমদানিতে রাশিয়ার ওপর ভারতের নির্ভরতা হ্রাস করা এবং এর বদলে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা।
কিন্তু সেই দিকে চলার পথে খুব তাড়াহুড়ো করতে চাইছে না যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া ভারতের সব প্রয়োজন এই মুহূর্তেই তাদের পূরণ করার সামর্থ্য নেই। আর এ কারণেই ভারতকে কিছুটা ছাড় দিলো যুক্তরাষ্ট্র।


আরো সংবাদ



premium cement