১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্বাচনী মাঠ কতটা সমতল?

-

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচন গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিন দশক ধরে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে চলমান রাজনৈতিক মতবিরোধ। এর উত্তরণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে যদি নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারে। সারা বিশ্বের গণতন্ত্রমনা মানুষ অধীর আগ্রহে বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে চেয়ে আছে। এ নির্বাচন কলঙ্কিত হলে শুধু দলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১৫ কোটি মানুষ। আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ইতিহাস তিক্ত। কারণ যারাই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের আয়োজন করেছেন, তারাই জনগণের ভোটের অধিকার ভূলুণ্ঠিত করেছেন। হ্যাঁ-না ভোটের কথা আজকের তরুণ প্রজন্ম না জানলেও ‘গায়েবি’ ভোটের কথিত নির্বাচন দেখেছে।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ এবং নির্বাচন কমিশনারের পক্ষপাতিত্বহীন ভূমিকা জরুরি। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। জনগণ নির্বিঘেœ ভোট দিতে চাইলেও স্বৈরশাসকেরা ভোটের অধিকার হরণ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তারা চান যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে কেউ টিকে থাকতে পারেনি।

যে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করে না, সেখানে সুষ্ঠু ভোটাভুটি কিংবা সমতল নির্বাচনী খেলার মাঠ প্রত্যাশা করা যায় না এবং ক্ষমতাসীনেরা অসমতল মাঠে খেলতে পছন্দ করে। কারণ তারা জানে অসমতল মাঠে বিশ্বচ্যাম্পিয়ানরাও হেরে যায়। আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীনেরা এত বেশি ‘পেনাল্টি’ পায় যে, প্রতিপক্ষ মাঠে থাকলে কী আর না থাকলেই বা কী। তখন প্রতিপক্ষ কেবল লালকার্ড পাবে। এ দিকে, ক্ষমতাসীন দল ফ্রি কিক পায় ডি বক্সের সামনে। নির্বাচনের মাঠে বড় খেলোয়াড় আওয়ামী লীগ সরকার এবং ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচন কমিশন হচ্ছে রেফারি। নিরপেক্ষভাবে রেফারির দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও এই কমিশন নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনের ভূমিকা অপরিসীম। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন হলেও বাস্তবে তারা কতটুকু স্বাধীন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কমিশন ইচ্ছা করলে ভোট কারচুপি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই কিংবা অবৈধ সিলমারা প্রতিরোধ করতে পারে। আমাদের দেশে দৃঢ় নির্বাচন কমিশনের যেমন উদাহরণ আছে, তেমনি সরকারের কাছে নতজানু কমিশনেরও দৃষ্টান্ত অনেক। নির্বাচন কমিশন সত্যিকার অর্থে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে বাধ্য; কিন্তু লজ্জাকর হলেও সত্য, যারা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকেন তারা দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা একটি নিরপেক্ষ ও সাহসী নির্বাচন কমিশন পাইনি। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না বলেই কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালে তৎকালীন সরকার সে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি। তৎকালীন বিরোধী দল ও আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতির বিধান সংবিধানে সংযুক্ত করতে এমনকি, নৈরাজ্যের পথ বেছে নিয়েছিল। অথচ তারাই পরে ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিলো। অজুহাত, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা নাকি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। তা এমন একটি পদ্ধতি কি বের করা যেত না, যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?

বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনী উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা থাকে। সর্বত্র বিরাজ করে নির্বাচনী আমেজ। এবারের নির্বাচন অতীতের যেকোনো নির্বাচনের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রথম নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যেখানে পার্লামেন্টের ৩৫০ জন এমপি স্বপদে বহাল থেকেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সে কারণে জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও ভয় কাজ করছে। তফসিল ঘোষণার পরও বেশির ভাগ থানায় আগের ওসিরাই রয়েছেন। তারা দলীয় সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন বলে ভাবা যায় না। নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে পারে, এমন সম্ভাব্য কর্মকর্তাদের ব্যাপারে ইতোমধ্যে আইন প্রয়োগকারী বাহিনী খোঁজখবর নিচ্ছে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সমতল মাঠ, মন্ত্রী-এমপিদের পছন্দের ইউএনও এবং ওসিদের বদলি করা প্রয়োজন অবিলম্বে। কারণ ক্ষমতাসীনেরা গত ১০ বছরে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে বলয় সৃষ্টি করেননি। নির্বাচন কমিশনের অদক্ষতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার নজির আমাদের দেশে বহু, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির হাস্যকর নির্বাচন।

তফসিল ঘোষণার পরও আইন প্রয়োগকারী বাহিনী এবার দলীয় বাহিনীর মতো আচরণ করছে। জামায়াত আর বিএনপির নেতাকর্মীদের গণহারে গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অথচ ক্ষমতাসীন দলের দলীয় কোন্দলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে দু’জন নিহত হলেও পুলিশ নির্বিকার। এহেন পক্ষপাতমূলক আচরণ অব্যাহত থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না।

লেভেল প্লেয়িং কোথায় আছে? পোস্টার দেখলেই তো বোঝা যায়। রাজধানীর এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে নৌকার বিলবোর্ড, পোস্টার বা ব্যানার দেখা যাবে না। রাজধানীর বেশির ভাগ স্থানে নৌকার প্রচার অবিরাম চলছে। এমনকি সরকারি অফিসের সামনেও নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে লাগানো বিলবোর্ডগুলো দৃশ্যমান। আসলে আওয়ামী লীগ তার সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। ক্ষমতায় আসার পর তারা লুটপাট করেছে, তা লিখলে হয়ে যাবে মহাকাব্য। সরকারের তলপিবাহকেরা ভাঙা রেকর্ডের মতো উন্নয়নের গল্পে জাতিকে বুঁদ রেখে বিভ্রান্ত করছে। তাদের মুখে উন্নয়নের স্লোগান যেভাবে মুখরিত হয়, সেভাবে যদি নির্বাচনী সমতল মাঠের দাবি শোনা যেত, তা হলে দূর হয়ে যেত সুষ্ঠু ভোটের ভয়। উন্নয়নের আড়ালে কয়েক বছরে হাজারো কোটি টাকা লুটপাটের দায় কার? দেশের জনগণের মাথা বন্ধক দিয়ে অর্থলগ্নি সংস্থার কাছ থেকে ঋণ এনে উন্নয়নের নামে কী করা হয়েছে?

৪৭ বছরের ইতিহাসে কোনো সরকারের আমলে এত আর্থিক অনিয়ম হয়নি, যেটা এই সরকারের শাসনামলে হয়েছে। প্রতি জনের মাথাপিছু ঋণ ৭০-৮০ হাজার টাকা। এই ঋণের ভার আজ হোক কাল হোক, জনগণকেই বহন করতে হবে। অশিক্ষিত মানুষেরাও জানেন, ঋণ করে বাহাদুরি করার কোনো মানে হয় না। অথচ ক্ষমতাসীনেরা ঋণের টাকায় পায়রা উড়িয়ে জনগণকে বোকা বানাতে চাচ্ছে। দেশের প্রত্যেকটি নির্বাচন কমিশন আস্থার সঙ্কটে থেকে কাজ করেছে। কিছু ক্ষেত্রে আস্থার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারলেও অনেক কমিশনই তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে যারা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন, তারা মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। নির্বাচন কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর ভূমিকার ওপর। ইতিহাসের এক টার্নিং পয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। সরকার ও নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে অঙ্গীকার বারবার জাতির সামনে করেছে, তা বাস্তবায়নে সমতল মাঠ নিশ্চিত করবে; এটিই দেশবাসীর দাবি ও প্রত্যাশা।


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের গণপিটুনিতে নিহত ২ নির্মাণশ্রমিক জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান

সকল