২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জনগণ চায় অর্থবহ পরিবর্তন

-

একটি সরকার দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতায়; তাও আবার পরবর্তী পাঁচ বছর জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকারকে পাশ কাটিয়ে অনৈতিকভাবে টিকে আছে। এতে জনগণ অতিষ্ঠ হওয়ারই কথা। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শুভ পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে নির্বাচনের প্রতি আওয়ামী লীগের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে করে এ পরিবর্তন কঠিন হতে পারে। নির্বাচনে কারচুপি ও জবরদস্তি বড় দলটির অনেক পুরনো অভ্যাস। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এর ব্যতিক্রম হলে তা হবে অস্বাভাবিক। তাই ক্ষমতায় আসতে হলে জাতীয় ঐক্যজোটকে এ প্রতিকূল অবস্থা ডিঙিয়েই আসতে হবে।

বিগত দশ বছরে বর্তমান সরকার জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এমন দলীয়করণ করেছে যে, নির্বাচন পরিচালনার মতো দক্ষ, সৎ ও নির্মোহ লোকবল পাওয়াই মুশকিল। খোদ নির্বাচন কমিশনকেই বিরোধীরা সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ বলছেন। তাদের এ যাবৎকালের আচরণ বিশ্লেষণ করলে কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। তদুপরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকলাপও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। তারা নির্বাচনকালে কেমন আচরণ করবে, তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন আছে। বারবার দেখা গেছে, এরা বিরোধীদের দমন করতে আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের সাথে হাত মিলিয়েছেন। নির্বাচনকালে ভোটকেন্দ্রে অনুরূপ আচরণ করা হতে পারে। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকার দলীয়করণ করেছে। নির্বাচন-ব্যবস্থাকে পুরোপুরি কব্জা করতে যা যা করা প্রয়োজন, তা করতে ক্ষমতাসীন দল বিগত দশ বছরে মোটেই পিছপা হয়নি।

অনেকের মতে, আওয়ামী লীগ কে চালায়, তা স্পষ্ট নয়। সরকারের মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নেতারা কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিয়ে কাজ করে থাকেন। সরকারের আমলা-কর্মকর্তারাও তাই করেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এবার প্রধানমন্ত্রী চার টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলে তারা পদত্যাগ করা সত্ত্বেও প্রায় এক সপ্তাহ পরও তা কার্যকর হয়নি। তারা এখনো মন্ত্রিপরিষদের সভায় যোগদান করছেন। উন্নত দেশগুলোতে তা সাথে সাথে কার্যকর হয়ে যায়। এর আগেও কোটাবিরোধীদের আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী সংসদে কোটা বিলোপের ঘোষণা দিলেও তিন মাসেও তা কার্যকর করা হয়নি। এ তিন মাসে নির্দোষ আন্দোলনকারীদের ব্যাপকভাবে দলীয় ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হেনস্তা হতে হয়েছে। এর জের এখনো কমবেশি চলছে। সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যজোটের সাথে সংলাপকালে প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন- আর বিরোধীদের অযথা গ্রেফতার করা হবে না।

কিন্তু তা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও অদ্যাবধি চালু আছে। আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো- ২০১৪ সালের অনৈতিক নির্বাচনকে ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলেও ক্ষমতাসীনেরা শিগগিরই নির্বাচন না দিয়ে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় কাটালেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নির্বাচন বিশ্লেষক মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা যে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেখতে চান না’- এ কথার ওপর এবং সরকার পরিবর্তনকারী জাতীয় নির্বাচনের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে কতটা ভরসা করা যায়? এটা যে কেবল একটি কথার কথা নয়, এ গ্যার‌্যান্টি কে দেবে? দলীয় নেতাকর্মীরা যে শীর্ষ নেতৃত্বের কথা মেনে চলবেন না, এর যথেষ্ট কারণ আছে। তারা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় আসতে চান।

দশ বছরে দেশে এক ধরনের লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে এবং এর বেনিফিশিয়ারিরা তা সহজে ছাড়তে চাইবেন বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রী এটাও বলেন, ‘আমরা ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করব এবং ২০২১ সালে পালন করব বাংলাদেশের রজতজয়ন্তী।’ সেগুলো যে তিনি ক্ষমতার বাইরে থেকে পালন করবেন, তেমন ধরে নেয়ার কোনো কারণ নেই। আসলে তারা একটি ফ্রি, ফেয়ার ও ক্রেডিবল নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে চাইবেন বলে মনে হয় না। যদি তাই না হতো, তবে উন্নত দেশের মতো নির্বাচনের আগেই সংসদ ভেঙে দেয়া হতো এবং মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করত।

একমাত্র সরকারপ্রধান ও সরকারি জোট ছাড়া দেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক জোট ও দল এবং সুশীলসমাজ এটাই চেয়েছিল এবং এখনো চায়। সংসদ ভেঙে দিয়ে এবং মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পর জাতীয় নির্বাচন সব দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ই আছে। যে পাকিস্তানের নিন্দায় ক্ষমতাসীন জোট অক্লান্ত, সে দেশেও ক’দিন আগে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের ‘উত্তরাধিকার প্রথা’র বিলোপ ঘটল। ‘উন্নয়নের রোল-মডেল’ বাংলাদেশই কেবল ব্যতিক্রম থাকবে কেন? এখানে রাজনৈতিক ‘জমিদারতন্ত্রের’ বিলোপ করা হচ্ছে না।

বিএনপির নির্বচনী প্রক্রিয়ায় এবার একটি পরিবর্তন লক্ষ্য গোচর হচ্ছে। এর শীর্ষ দুই নেতার অনুপস্থিতিতে তারা এমন সব নতুন দলের সাথে জোট বেঁধে নির্বাচনে যাচ্ছেন, যারা এককালে আওয়ামী ঘরানারই ছিলেন। এ জোটের শীর্ষ নেতাও ছিলেন সে দলের নেতা। এতদিন বিএনপিকে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বলে যে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করত, কাণ্ডজ্ঞান থাকলে তা আর করার যুক্তি নেই। উপরন্তু, বিএনপির শীর্ষ দুই নেতার মাঠে অনুপস্থিতিতে এবং অপর একটি দলের নেতাকে জোটের শীর্ষ পদে আসীন করায় দলটি ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি’ করার অপবাদও ঘুচল।

সার্বিক বিবেচনায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আওয়ামী জোটের তুলনায় অধিক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী মোর্চা। নির্বাচন কমিশন যদি দেশবাসীকে একটি মোটামুটি পরিচ্ছন্ন নির্বাচন উপহার দিতে পারে বা সে সদিচ্ছা তাদের থাকে, তবে আওয়ামী জোটের পক্ষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে টপকানো অসম্ভব হওয়ারই কথা। এমন নয় যে, কেবল আওয়ামী জোটের দীর্ঘ দশ বছরের শাসনে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে জনগণ ঐক্যফ্রন্টকে ভোট দেবে, বরং এ নতুন জোট বিপুল পরিমাণ ভোট টানবে, যদি জনগণ আওয়ামী ক্যাডার ও সরকারি নানা বাহিনীর সম্ভাব্য অসদাচরণের বাধা অতিক্রম করে ব্যালট পেপারটি হাতে পেয়ে ব্যালট বাক্সে ফেলতে পারে এবং ভোট গণনায় ও ফল প্রকাশে কোনো কারচুপি যদি না হয়।

তবে আশঙ্কা হলো ভোট কারচুপিতে ক্ষমতাসীন দলের জুড়ি নেই। অন্তত ১৯৭৩ ও ২০১৪ সালের নির্বাচন তা প্রমাণ করেছে। সে দু’টি নির্বাচনও একই দলীয় সরকারের অধীনেই হয়েছে এবং এবারেরটাও হতে যাচ্ছে। তাই জনগণ পরিবর্তন চাচ্ছে বটে, তবে আওয়ামী লীগ তা হতে দেবে বলে মনে হয় না।

২০১৪ সালের অনৈতিক নির্বাচনকে ‘নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলেও শিগগিরই নির্বাচন না দিয়ে আওয়ামী লীগ জাতির সাথে কথার বরখেলাপ করেছে। বিগত দশ বছরে ব্যাংকিং খাতে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘সাগর চুরি’ হয়েছে। শেয়ারবাজারে নেমেছে ধস। এমন ধস ২১ বছরের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ যখন ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসে, সেবারও নেমেছিল। সমাজে আয়বৈষম্য মাত্রাহীনভাবে বেড়েছে। দুর্নীতি প্রবেশ করেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শাপলা চত্বরে আলেমদের অপমানিত ও বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে (নয়া দিগন্ত, ১৩ নভেম্বর ২০১৮, পৃষ্ঠা ১, কলাম ১ ও পৃষ্ঠা ২, কলাম ১)।

সারা দেশে চাঁদাবাজি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সড়কপথগুলো যান ও লোক চলাচলের অনুপযোগী। বেকারত্ব চরম রূপ ধারণ করেছে। একটি সুবিধাভোগী ধনী শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের তোয়াজ করে ক্ষমতায় টিকে আছে সরকার। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে তাদের চলাচলের সুবিধার জন্য রাজধানীতে ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি ব্যয়বহুল প্রকল্প চড়া কমিশনের বিনিময়ে বাস্তবায়ন চলছে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভোগান্তি বেড়েছে। নানাভাবে ক্ষমতাসীন দলীয় লোকেরা জমি, জলমহাল, নদী দখল ইত্যাদি দখলদারিত্বে লিপ্ত। একপেশে পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশ হয়েছে বন্ধুহীন, যার প্রমাণ মিলেছে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় ব্যর্থতা। কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকার প্রতিবেশী একটি দেশকে অকাতরে সুবিধাই দিয়েছে, বহু দেশের জন্য তেমন কোনো প্রাপ্তি ব্যতিরেকেই। এসবের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ।

এক কথায়, আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে দেশের স্বার্থের তুলনায় তাদের ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ অনেক বড়। এমন কোনো দলকে দেশের জনগণ জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করার কথা নয়। জনগণই যেখানে দেশের মালিক, সেখানে সংবিধানে কারসাজি করে যারা দেশের মালিক-মোক্তার সেজে বসে আছেন, দলকে দেশের জনগণ তাদের স্বেচ্ছায় ভোট দিয়ে ক্ষমতায় রাখবে কেন? তাই জনগণ একটি পরিবর্তন চায়।

জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি জনগণের রক্তের বিনিময়ে, কিন্তু স্বাধীনতার মজা লুটল কিছু সুবিধাবাদী। জনগণের ভাগ্যে আজো শিকে ছিঁড়ল না। এরও কারণ আছে। আমাদের গোড়ায় গলদ। ১৭ মার্চ, ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. মাজহারুল হক বলেছিলেন, সরকার আশ্রিত কিছুসংখ্যক লোকের হাতে ব্যবসাবাণিজ্যের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণভার ন্যস্ত করায়, এ গোষ্ঠী অক্টোপাসের মতো পুরো দেশের অর্থনীতিকে নিজেদের কবলে এনে শোষণ করে যাচ্ছে। বস্তুত গত দুই বছরের সমাজকে শোষণহীন করার নামে বাংলাদেশে যে লুণ্ঠন চলেছে, তার নজির ইতিহাসে নেই। অল্প কিছুদিনের মধ্যে দেশের সম্পদের এক বৃহৎ অংশ এমন সব ব্যক্তির হাতে গিয়ে পৌঁছেছে এবং আজও ক্রমাগত যাচ্ছে, যারা দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার কাজে কোনোদিন আত্মনিয়োগ করেনি। দুই বছর আগে যারা ছিল নিরন্ন, আজ তারা লাখপতি। দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে।

রাজনৈতিক নেতারা শত-লাখবার দুর্নীতি উচ্ছেদ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জনসাধারণকে জ্ঞাপন করেছেন। দুর্নীতি যাদের ব্যবসা, তারাও এ কোরাসে যোগ দিয়েছেন। অথচ দুর্নীতি পর্যায়ক্রমে বেড়েই চলেছে। এ শোচনীয় পরিস্থিতির অবসান ঘটাতেই হবে (পলিটিক্যাল ইকোনমি, ১৯৭৪, ভলিউম ১, সংখ্যা ১, কনফারেন্স ১৯৭৪, পৃষ্ঠা, ৭)। সে দিন আওয়ামী লীগ এককভাবে ক্ষমতায় ছিল। একই পরিস্থিতি যেহেতু আজও বিদ্যমান, তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থে একটি অর্থবহ পরিবর্তন অবশ্যই অপরিহার্য।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার


আরো সংবাদ



premium cement