২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বিস্ময়কর নাটকীয়তা

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে বিস্ময়কর নাটকীয়তা -

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিস্ময়কর নাটকীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা গত শুক্রবার পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে ৫ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন। আর এর মাত্র চার দিনের মাথায় দেশটির সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্টের সংসদ বাতিলের ঘোষণাকে অবৈধ বলে রায় দিয়ে এটিকে বাতিল ও অকার্যকর করে দিয়েছেন। আর এর পরদিন ১০টায় সংসদের বৈঠক ডাকার আদেশও দিয়েছেন আদালত। নির্দেশ অনুসারে আহূত এই অধিবেশনে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসের বিরুদ্ধে আনীত এক অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন না। তাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাকে। এই রাজনৈতিক টানাপড়েনে শ্রীলঙ্কা এক নজিরবিহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশটির মুদ্রা ও শেয়ারবাজারে।

প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা সংসদ বাতিল করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়ার পরপরই এই সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে এটাকে আইনিভাবে চ্যালেঞ্জ করার কথা জানিয়েছিলেন বিক্রমাসিংহে। তিনি দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা এবং সংসদ ভেঙে দেয়ার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা সংবিধানপরিপন্থী। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার সুশীলসমাজ, অ্যাক্টিভিস্ট ও রাজনৈতিক কর্মীদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ কামনা করে এক আবেদন পেশ করা হয়। যেসব রাজনৈতিক দল প্রেসিডেন্টের আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি), প্রধান বিরোধী দল তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (টিএনএ) ও মার্ক্সবাদী জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি)।

এই আবেদনের ওপর দুই দিনব্যাপী শুনানি করার পর সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্টের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। প্রধান বিচারপতি নলিন খোরেরা, বিচারপতি প্রসনা জয়বর্ধনে ও প্রিয়ন্ত জয়বর্ধনে সমন্বয়ে গঠিত এই বেঞ্চ আবেদনকারী আইনজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের প্রেসিডেন্টের উদ্যোগ যে সংবিধানপরিপন্থী এ মর্মে উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক শোনেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়টির শুনানির জন্য যথাযথভাবে নির্বাচন কমিশনকে নোটিশ করা উচিত বলে আদালতে যুক্তি দেখালেও জরুরি জাতীয় ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করে সুপ্রিম কোর্ট এ আবেদনের শুনানি করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়ে শুনানি করার জন্য যে সময় প্রার্থনা করেছিলেন, সেটিও আদালত নাকচ করে দেন।

শ্রীলঙ্কায় তিন সদস্যের যে নির্বাচন কমিশন রয়েছে, তার একজন সদস্যও প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জকারী আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছেন। সিরিসেনা সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদে প্রেসিডেন্ট সংসদ ভেঙে দিতে পারেন বলে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেটিকে প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু ৭০(১) নম্বর অনুচ্ছেদে প্রেসিডেন্ট কোন অবস্থায় সংসদ ভাঙবেন, সেটি উল্লেখ করে তার ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে বলে যুক্তি প্রদর্শন করেন আবেদনকারীরা।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা গত ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে তার জায়গায় সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসেকে নিয়োগ দেয়ার ফলে দেশটিতে যে রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়, গত শুক্রবার পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার পর তা নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। আর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সেটি আরো জটিল আকার ধারণ করল। সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্টের সংসদ ভেঙে দেয়ার আদেশ স্থগিত করায় ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল। প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করে রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী করার যে আদেশ দিয়েছেন, সেটিকে অবশ্য বাতিল করেননি আদালত। এর পরিবর্তে সংসদে অধিবেশন আহ্বান করার নির্দেশ দেয়ায় রাজাপাকসের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করার সুযোগ পায় বিরোধীরা।

আস্থা ভোটে রাজাপাকসে জয়ী হতে পারবেন না বলে প্রতীয়মান হওয়ায় সেই ঝুঁকি না নিয়ে প্রেসিডেন্ট সিরসেনা সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। রাজাপাকসের ধারণা ছিল, স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনে তিনি যেহেতু নিরঙ্কুশভাবে জয় পেয়েছেন, তাই সংসদ নির্বাচন হলে তাতেও তিনি জয়লাভ করতে পারবেন। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে এখানে আদালতের হস্তক্ষেপ চলে আসায় রাজনৈতিকভাবে একেবারে অনিশ্চিত এক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

নতুন পরিস্থিতিতে অনেক ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে। প্রথমত, সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্টের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করার পর সংসদ পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় প্রেসিডেন্টের তার পদে বহাল থাকা নৈতিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়বে। এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিক্রমাসিংহে দায়িত্বে আবার চলে এলে তার সাথে কাজ করা কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত, সংসদে বিক্রমাসিংহের দলের এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই যে, প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি সরকার পরিচালনা করতে পারবেন। এতে বরং দেশটির শাসন ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে।

এ অবস্থায় সব রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ছাড়া সৃষ্ট অচলাবস্থার নিরসন হবে বলে মনে হয় না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, রাজাপাকসের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে তামিল দলগুলো। তারা বিক্রমাসিংহের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে ভারসাম্য সে দিকে ঝুঁকে পড়ে। শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা এটাকে মোটেই ভালোভাবে নেবে না। এর প্রভাব ভবিষ্যৎ সব নির্বাচনে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শ্রীলঙ্কায় এখন যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত চলছে, এর পেছনে বাইরের শক্তির সক্রিয় প্রতিযোগিতা রয়েছে। চীনা মদদ রয়েছে রাজাপাকসে-সিরিসেনার ওপর। অন্য দিকে বিক্রমাসিংহেকে সমর্থন করছে ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলো। এই প্রতিযোগিতায় ক’দিন আগেও মনে হচ্ছিল রাজাপাকসের জয় হচ্ছে নতুন নির্বাচন ঘোষণার মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের কারণে বিষয়টি এখন ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার নেয়া পদক্ষেপকে আইনগতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে সঠিক বলে মনে হয় না। এর আগেই দেশটির সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি যেভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন তাতে নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটেছে। আইনিভাবে এ ক্ষমতা সঠিক বলে গণ্য হলে এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়া হবে। এই বিবেচনা থেকে মনে হয় সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন।

শ্রীলঙ্কার বাস্তবতা হলো, রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে কয়েক দশকের তামিল বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়ে নজিরবিহীন জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। কিন্তু তার একনায়কসুলভ পদক্ষেপে বিরোধী পক্ষগুলো গোপনে ঐক্যবদ্ধ হলে চীন সেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা তাকে দেয়নি। যদিও যে অক্ষশক্তি রাজাপাকসের পতনের জন্য কাজ করেছে, তারা এটি করেছে দেশটি থেকে একটি চীনপন্থী সরকারের বিদায় ঘটানোর জন্য। রাজাপাকসে নতুন করে শক্তিমান হয়ে ওঠার পর এখন তাকে ঠেকানোর কাজেও ভারত ও পশ্চিমা অক্ষের ভূমিকা রয়েছে।

দেখার বিষয় হলো, নতুন পরিস্থিতিতে বেইজিংয়ের অবস্থান কী দাঁড়ায়। আর রাজনৈতিক টানাপড়েন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখনো ক্ষমতা দখলের খেলায় অনেক কিছু বাকি রয়েছে। যার পেছনে সক্রিয় রয়েছে আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তিগুলোও।


আরো সংবাদ



premium cement