২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সেই তালেবানকে এখন তোষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র

সেই তালেবানকে এখন তোষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র - ছবি : সংগৃহীত

এই তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশকে বোমা মেরে মেরে প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু জয়লাভ তো দূরের কথা, ন্যূনতম সম্ভাবনাও দেখা দেয়নি। পরিণতিতে এখন সেই তালেবানের সাথেই আলোচনা করতে যাচ্ছে অন্তত মুখরক্ষা যাতে হয়, সেই ব্যবস্থা করতে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যাতে মনে হচ্ছে, আর দেরি না করে আরো অপদস্থ হওয়ার আগে কেটে পড়াই ভালো। এ জন্য যা যা করার তাই তারা করতে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে।

বিশেষ করে আফগানিস্তানে রাশিয়ার উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কঠিন মনে হচ্ছে। সিরিয়ায় পরাজয়ের পর আফগানিস্তানেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা পরাশক্তিটির জন্য খুবই করুণ হবে। রাশিয়া এখন জোরকদমে তাদের শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে পর্যন্ত তারা কাছে টেনেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। রাশিয়ায় আসন্ন শান্তি সম্মেলনে তিনি যাবেন বলে মনে হচ্ছে। সেই সাথে চীন, পাকিস্তানের তাতে যোগ দেয়ায় খোদ যুক্তরাষ্ট্রই বেকায়দায় পড়েছে। তালেবানও এতে যোগ দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অবশ্য এখন তালেবানও চায় শান্তি। যুক্তরাষ্ট্র যেমন বুঝতে পেরেছে তাদের পক্ষে তালেবানকে হারানো সম্ভব নয়, ঠিক একই ধারণা পোষণ করে তালেবান। তারা ইতোমধ্যে রাশিয়া, চীন এবং মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছে।

আবার আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি সবাই জানে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়; অথচ শান্তির প্রয়োজন সবার। আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হলে আশপাশের এলাকায়ও তা আসবে না। শান্তির প্রতি এমন তাগিদ দেখা যাওয়ার প্রেক্ষাপটেই বলা যায়, সব পক্ষ নিজ নিজ হিসাব অনুযায়ী এগিয়ে এসেছে।

এমন এক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় ‘তালেবান ফাইভ’-এর নাম আলোচিত হচ্ছে। কট্টরপন্থী বিবেচিত এই পাঁচজনকে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকারের মেনে নেয়া মানে হলো, তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলেছে। গুয়ানতানামো কারাগারে বন্দী থাকা ‘তালেবান ফাইভ’ মুক্তি পান ২০১৪ সালে। ওবামা প্রশাসনের আমলে বন্দিবিনিময় কর্মসূচির অংশ হিসেবে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই পাঁচজনের মধ্যে তালেবান সরকারের সাবেক সেনাপ্রধান, গোয়েন্দাপ্রধান, দু’জন গভর্নর ও একজন মন্ত্রী রয়েছেন। ফলে সামরিক ও বেসামরিক মানসিকতার সুন্দর সমন্বয় রয়েছে এখানে।
এই গ্রুপের সমন্বয়ে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, সৈন্য প্রত্যাহার ও সামরিক ঘাঁটির ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে তালেবান পক্ষ ভাবছে। অথচ কিছু দিন আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এসব বিষয় আলোচনার অযোগ্য ছিল।

এই পাঁচজনের অন্যতম খাইরুল্লাহ খাইরুয়া এক সময় ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমর উভয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি কয়েকজন ভাষ্যকারের মধ্যে এই সন্দেহ সৃষ্টি করেছেন, এসব নেতার নিয়োগের ফলে আলোচনা ও নিষ্পত্তির পথ সহজ হবে না। আবার অন্যরা মনে করছেন, এই পাঁচজন যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো সমঝোতায় পৌঁছে যান, তবে অন্যদের পক্ষে তা মেনে নিতেই হবে। তালেবানের সব পর্যায়ে তাদের গ্রহণযোগ্যতা থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের করা চুক্তিই হবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।
তা ছাড়া, এসব লোকের নিয়োগে ওয়াশিংটনকে এই ইতিবাচক বার্তাও পাঠিয়েছে যে, এসব আলোচনার ব্যাপারে তালেবান অত্যন্ত আন্তরিক। তারা সময়ক্ষেপণ ও তাদের নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণের জন্য আলোচনার টেবিলে যাচ্ছে না।

বস্তুত আফগান সরকারের শান্তি পরিষদের সদস্য হিসেবে সক্রিয় সাবেক তালেবান নেতা হাকিম মুজাহিদ স্পষ্টভাবেই বলেছেন, গুয়ানতানামো বেতে বন্দীদের উপস্থিতিতে প্রমাণিত হয়, তালেবান চুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক।

এই পাঁচ ব্যক্তির নিয়োগে প্রমাণ করে, এসব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না তালেবান। তারা চাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যেন এসব লোক যেসব দাবি উত্থাপন করবে, সেগুলো মেনে নেয়। তারা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছে, তারা জয় বলতে বোঝে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ লাভ আর মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি বা সামরিক ঘাঁটি বহাল থাকা মেনে নেয়া হলো পরাজয়।
এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে দুই রাউন্ড আলোচনার পরও মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি বা সামরিক ঘাঁটি নিয়ে মার্কিন দাবির ব্যাপারে তাদের মূল অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এ দিকে সময় শেষ হয়ে আসছে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্র বেশ ভালোভাবেই জানে প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আরেকটি পুতুল সরকার বসানো হলে এবং নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় ওই সরকার বৈধতা পাবে না, এমনকি দেশের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে।

তালেবানকে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিয়ে আসা হবে খুবই বাস্তবসম্মত বিষয়। কিন্তু এত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কিভাবে তা করা সম্ভব?
তবে কাতারে আলোচনা যদি শুরু হয়, সাথে সাথেই কাবুলের ওপর থাকা বৈধতার শেষ বিন্দুটিও শেষ হয়ে যাবে। ক্ষমতার শূন্যতা পূরণের চাপ অনিবার্যভাবেই বাড়বে। আর এবার ১৯৯২ সালের মতো না-ও ঘটতে পারে। সেবার মুজাহিদিনদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল, কিন্তু এবার তালেবানকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পাকিস্তান তৈরি হয়ে আছে।

অবশ্য পাকিস্তান বিনা শর্তে এতে কাজ করবে না। তারাও তাদের প্রাপ্য আদায় করে নিতে চাইবে। তবে যুদ্ধ বন্ধ হোক, এমনটিই সবার কাম্য।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রও বুঝেছে, পাকিস্তানকে ছাড়া তার পক্ষে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। আবার সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক কারণে চীন ও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে পাকিস্তান। ফলে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক দাবা খেলায় পাকিস্তানই হয়ে পড়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ।


আরো সংবাদ



premium cement