২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জাতীয় সংহতি

-

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ ভারত বিশাল উদারতা দেখিয়েছে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে সংগ্রামের দিনগুলোতে অসহায়, নিুপায় মানুষ তাদের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেয়েছে। আমরা সত্যিই ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। মানবিক সাহায্যের বিনিময় নেই জেনেও ভারতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা একটি অনন্য উদাহরণ। কিন্তু যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের সময়ের কিছু বিষয় ও যুদ্ধ-পরবর্তী ৪৭ বছরে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কার্যকলাপ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী, পীড়াদায়ক ও অস্বস্তিকর। ভারত জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি নিয়ে বেপরোয়া মন্তব্য ও সমালোচনায় মুখর, অথচ একই বিষয়ে নিজেদের বেলায় দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চেহারা। আর এসএস বা রাষ্ট্রীয় সেবক সঙ্ঘ, শিবসেনা, বিজেপির মতো রাজনৈতিক দলগুলো তো ক্ষমতায় আছেই; বরং ভারতীয় রাজনীতিতে প্রধান নিয়ামক হিসেবেও কাজ করছে।

ভারতের রাজনীতিবিদেরা বাংলাদেশ সম্পর্কে কী ধরনের মনোভাব পোষণ করেন তা সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজনীতিক ও রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সুব্রামনিয়াম স্বামী বাংলাদেশে দিল্লির শাসন প্রতিষ্ঠা করার হুমকি দেন। ত্রিপুরায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের উন্মত্ত মানুষ মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ বানাচ্ছে এবং হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। ২০১১ সালের ১৬ জুলাই ভারতীয় জনতা পার্টির এই নেতা মুম্বাইয়ের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় বলেন, সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত ভারতের দিকের অংশটি দখল করে নিতে হবে। এ ধরনের হুমকি আসামে বিজেপির বিধায়ক হোজাই শিলাদিত্যের কাছ থেকেও এসেছে। শিলাদিত্যের ভাষায় বলা হয়েছে- ’৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পরই বাংলাদেশকে ভারতের সাথে একীভূত করা উচিত ছিল। বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যে পিছিয়ে নেই সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এবং সম্পাদক রাম মাধবও।

১৯৯৯ সালের ২১ মার্চ ভোরের কাগজে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, “৬ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে যশোর টাউন হল ময়দানে বোমা বিস্ফোরণ এবং তার তিন সপ্তাহ পূর্বে কুষ্টিয়ার জনসভায় মুক্তিযোদ্ধা কাজী আরেফ আহমেদসহ ৫ জনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ আন্দোলনের নেতা কালিদাস বৈদ্য ও বঙ্গভূমির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব জনৈকা নির্মলা সেন স্বীকার করেছেন।” তথাকথিত স্বাধীন বঙ্গভূমির রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতা। রাজধানী ‘সামন্ত নগর’। রাষ্ট্রপ্রধান পার্থ সামন্ত। সামন্ত নগরের ঠিকানা কেউ জানে না। তবে নিখিলবঙ্গ নাগরিক সঙ্ঘের দাবি হচ্ছে, এটি বাংলাদেশে। তারা আরো বলেছে- বাংলাদেশের খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী নিয়ে ১৯৮২ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীন বঙ্গভূমির ঘোষণা দেয়া হয়। সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর লিখিত ‘কূটনীতির অন্দরমহল’ বইয়ে জানা যায়, পার্থ সামন্ত ও তার সমর্থকদের সাথে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্ক রয়েছে। সরাসরি যোগাযোগ আছে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সাথেও।

কলকাতার যে স্থানে কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা থাকেন, সেখানেই পার্থ সামন্তের বসবাস। কলকাতায় অবস্থিত ভারতীয় বহিঃপ্রচার বিভাগের অফিসে অবাধ যাতায়াত রয়েছে নিখিলবঙ্গ নাগরিক সঙ্ঘের। নাগরিক সঙ্ঘই বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীন বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা ১৯৮৩ সালের ৭ থেকে ১২ মার্চ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের সময় রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। লবিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করারও চেষ্টা করেছে তারা। এহেন গর্হিত কাজের কোনো বাধাই ভারত সরকার দেয়নি। উপরন্তু ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে তারা বলেছে, এখানে কোনো তৎপরতা বন্ধ করা যায় না। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের এ ধরনের আচরণ আমাদের জন্য অবশ্যই হুমকিস্বরূপ।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের এক-দশমাংশ জুড়ে যে পার্বত্যাঞ্চল তাকে ঘিরে স্বাধীন ‘জুমল্যান্ড’ গঠন করার প্রয়াস চলে। একজন প্রয়াত চাকমা নেতার নেতৃত্বে ভারতের মাটি থেকেই এর কর্মকাণ্ড শুরু হয়। শুধু প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ নয়, সর্বপ্রকার ভারতীয় প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা শান্তিবাহিনী আমাদের ভূখণ্ডে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। এখানে প্রখ্যাত সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর ‘কূটনীতির অন্দরমহল’ বইটিতে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানে ভারতের সাহায্য কামনা করা হয়েছিল। নরসিমা রাও ঢাকা সফরকালে আশ্বাস দেন। এ কে খোন্দকারকে চেয়ারম্যান করে কমিটি এবং পার্বত্য এলাকায় নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠন করা হয়। কিন্তু শান্তি ফিরে আসেনি। শান্তিবাহিনীর প্রতি ভারতের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সমর্থনের প্রামাণিক তথ্য থাকার পরও গঙ্গার পানি সমস্যার সমাধানে নেপাল অপশন বাদ দিয়ে আমরা কেন ভারতের মিথ্যা আশ্বাসে আপস করেছিলাম তা একদিন জনগণের কাছে স্পষ্ট হবে।’ ২০১০ সালের ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে পাহাড়িদের সাথে বাংলাদেশেরই সমতল থেকে আসা অধিবাসীদের মধ্যে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তার ওপর ভিত্তি করে নয়াদিল্লি-কেন্দ্রিক সংগঠন এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস আমাদের প্রিয় ও গর্বের সেনাবাহিনী সম্পর্কে সরাসরি অভিযোগ এনে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনারের হস্তক্ষেপ কামনা করে। এর সূত্র ধরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও সেই ঘটনার নিন্দা জানায়।

আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর বা কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের উন্নতিও নির্ভর করে কৃষকের ফলানো ফসলের ওপর। সুতরাং কৃষিকর্মের প্রধান উপাদান পানির সঙ্কট হলে দেশও সঙ্কটে পড়বে। এ কারণে পানি নিয়ে চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের নদীগুলোতে পানি আসতে দিচ্ছে না প্রতিবেশী দেশ ভারত। ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ৪২টিতেই বাঁধ দেয়া হয়েছে। ফারাক্কা ব্যারাজ ও উজানে পানি শুষে নেয়ায় হেমন্তেই পদ্মাসহ ৩৬টি শাখা নদী শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী, খরা মওসুমে ভারত-বাংলাদেশকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি দেয়ার কথা। অথচ তখন পদ্মা ও তার শাখা-প্রশাখাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ৬০ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল ৮০ হাজার কিউসেক। ’৭৭ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে নিম্নতম পানির প্রবাহ ধরা হয় ৫৫ হাজার কিউসেক। কিন্তু ভারত কর্তৃক একতরফা পানি অপসারণ করার ফলে ক্রমেই পানিপ্রবাহের পরিমাণ কমতে থাকে। তিস্তা আজ পানিশূন্য।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষরস্রোতা, ভরাযৌবনা তিস্তা নদী মৃতপ্রায়। বিশাল রংপুর বিভাগের অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষ্টি, পরিবেশ সব কিছুই নির্ভর করে নদীর পানিপ্রবাহের ওপর। কৃষিকাজে সেচ দেয়ার জন্য, পাট জাগ দেয়ার জন্য পানি নেই। মৎস্য সম্পদ বিলুপ্তির পথে। ভূগর্ভস্থ পানি দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ার ফলে পরিবেশ বিপর্যস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। ভারতের কুচবিহার জেলার গজলডোবায় বাঁধ দেয়ার ফলে তিস্তার বুকে ধু ধু বালুচরের সৃষ্টি হয়েছে। অকার্যকর হয়ে পড়েছে ‘তিস্তা ব্যারাজ’। ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নীতিমালা ও ১৯৯২ সালের ডাবলিন  নীতিমালার নিরিখে প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলোর ব্যবহার এমনভাবে করতে হবে, যাতে অন্য দেশের ক্ষতি না হয়। যেসব দেশে অভিন্ন নদী প্রবহমান, সেসব দেশ অবশ্যই সমতার ভিত্তিতে পানির ব্যবহার নিশ্চিত করবে এবং অববাহিকায় অবস্থিত দেশগুলো নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অববাহিকায় অবস্থিত অন্য দেশের সাথে আলোচনা করে সব পরিকল্পনা অবহিত করতে হবে। অথচ ভারত এ ব্যাপারে নির্বিকার। ভারতের মনোভাব বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল। নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক নদীসংক্রান্ত আইনের বিরুদ্ধাচরণ।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমাদের সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। ১৯৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ চূড়ান্ত পর্যায়ে ’৭১ সালে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে যেসব প্রয়াস, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ তা অব্যাহত রাখতে হবে। ইতিহাসের অন্যতম রাষ্ট্রচিন্তক ইবনে খালদুন চৌদ্দশতকে বলে গেছেন- ‘রাষ্ট্রের উৎপত্তি সামাজিক সংহতিতে, আবার বিনাশও হয় সংহতির অভাবে।’ বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে জাতীয় সংহতির বিকল্প নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement
গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান

সকল