২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শক্তি নয়, সুশাসন গণতন্ত্র রক্ষা করে

শক্তি নয়, সুশাসন গণতন্ত্র রক্ষা করে - ছবি : সংগ্রহ

আমরা যদি কোনো বিষয়ে সমঝোতায় না আসি, যদি শুধু বলতে থাকি ‘আই ফরবিড’, যা ল্যাটিন শব্দ ভেটো থেকে এসেছে। এর পূর্ণাঙ্গ অর্থ হলো আমি মানি না। বিশ্বের পাঁচটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স এদের কেউ যদি ভেটো দেয় তাহলে বিশ্বশান্তি পরাভূত হয়। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ওই বৃহৎ শক্তিধর পাঁচটি দেশকে ঐকমত্যে আসা অতীব প্রয়োজন। বিশ্বে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোতে ধারাবাহিকভাবে যে অশান্তি বিরাজমান তার জন্য দায়ী বিশ্বের পাঁচটি পরাশক্তি। তাদের ঐকমত্যে না আসার কারণে বিশ্বে গোলযোগ বা অশান্তি কমছে না, এটা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। ঠিক তদ্রুপ বাংলাদেশে শতাধিকের ওপর দল থাকা সত্ত্বেও বৃহৎ দুটো দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঐকমত্যে না আশার কারণে দেশে তিন দশক ধরে শান্তি পরাভূত। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশ চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া ও আইন প্রণয়ন অনুমোদনে বাধা দিতে পারে, যা ভেটো ক্ষমতা হিসেবে খ্যাত। প্রথম ভেটো দাতা দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)।

বিশ্ব সংস্থা জতিসঙ্ঘ গঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। উদ্দেশ্য বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ওই পাঁচটি বৃহৎশক্তি যেন ঐকমত্যে পৌঁছে। কিন্তু দেখা গেল ষাটের দশক থেকে অশান্তি বাড়তে থাকল গোটা বিশ্বময়। ভেটো পাওয়ারের অধিকারী রাষ্ট্রগুলো বিশ্বে শান্তি না এনে বরং তা আরো বাড়িয়ে দিলো। একটি রাষ্ট্রও যদি একাধিক শক্তিসম্পন্ন দলে বিরাজমান থাকে, তাহলে ওই দেশে শান্তি আসবে না যদি দলগুলো দেশের সমস্যা নিয়ে এক টেবিলে বসে আলোচনা না করে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম ভেটো দেয়। এখন প্রশ্ন হলো, ভেটোর অর্থ দাঁড়ায় ‘আমি মানি না’। আজ যে বিশ^ময় অশান্তি, তা কিন্তু ওই পাঁচটি মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের কারণেই ঘটছে। বাংলাদেশে যে কারণে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, সেটির মূল হলো দেশের বড় দু’টি শক্তিধর দল। এরা যদি ঐকমত্যে পৌঁছে যায়, তাহলে বাংলাদেশের চলমান অশান্তি এক দিনেই সুরাহা হয়। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে বড়।

জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ যে ভূমিকা পালন করে, একটি দেশের জাতীয় সংসদও একই কাজ করতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য যদি এক হয়ে যায়, তাহলে বিশ্বে অশান্তি কমে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তেমনি একটি দেশের বড় দুটো দল যদি অহমিকা পরিত্যাগ করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সংলাপে বসে চলমান সঙ্কটের সমাধান করতে পারে। একটি দেশের জাতীয় সংসদ এবং জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ বলতে গেলে একই ভূমিকা। নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ও আইন প্রণয়ন অনুমোদনে কোনো বাধার মুখোমুখি হতে না পারে, সে জন্য বড় পাঁচটি শক্তিধর দেশকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা যদি শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ না করে তা আরো বিস্তৃতি ঘটায়, তাহলে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি কখনোই আসতে পারবে না। চলমান বিশ্বে যে অশান্তি বেড়েই চলছে, তা কিন্তু বড় শক্তিগুলোর ইন্ধনেই ঘটছে। তেমনি একটি রাষ্ট্র, যেমন ধরুন বাংলাদেশে বহু বছর ধরে বড় দুটো দলের একগুঁয়েমির কারণে নানা সমস্যা রাষ্ট্রে জড়িয়ে পড়ছে। উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। জিডিপির হার কমে যাচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্কট ব্যাপকতর হচ্ছে, গণতন্ত্র বেহাল দশায় রূপ নিচ্ছে।

অর্থাৎ সব কিছুই এলোমেলো ধারায় ধাবিত হচ্ছে। আর আমরা একে বলছি, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকায় লিড নিউজ দেখলাম বিগত ১০ বছরে দেশে খুন ও গুমের সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা প্রতিদিন ২০-এর উপরে থাকছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা সংশোধনের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সম্পাদকদের নজিরবিহীন মানববন্ধন। সম্পাদক পরিষদের মানববন্ধন এখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, আইন তো পাস হয়েছে, এখন কী করার আছে? এসব ব্যাপারে সংশোধনী আনা যায়। সম্পাদকেরা সে কথাই বলেছেন।

আমি উপরে যে দুটো উদাহরণ তুলে ধরলাম, সেখানেই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান আছে। একমাত্র ঐশী বাণী আল কুরআন ছাড়া সব কিছু পরিবর্তন, পরিবর্জন, পরিবর্ধন করা সম্ভব। মানুষের তৈরি বিধান মানুষই পরিবর্তন করতে পারে, যদি দেখা যায় এই আইনের ধারাটি দেশের চলমান জীবনে জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে। বিগত ৪৭ বছরে আমাদের দেশের সংবিধান বহু কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। যারা সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে উপনীত হন, তারাই এ কাজটি করেছেন। এখন সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। তারাই ক্ষমতায় এসে সংবিধানে বহু সংশোধনী এনেছেন। এখনো তারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন। তারা চাইলে জনস্বার্থে সংবিধান সংশোধন করে একটি সুন্দর নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারেন। এটা পুরোপুরি শাসক দলের ওপর নির্ভর করছে। ক্ষমতায় থাকলে সরকারের দাপট বেশি থাকে। যখন ক্ষমতায় থাকে এই দাপটের জোরে বড় দল ভাঙার চেষ্টা করে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ আইনের শাসন। ঠিক তদ্রুপ গণতন্ত্রেরও রক্ষাকবচ সুশাসন। আইনের শাসন ও সুশাসন দেশে না থাকলে স্বাধীনতা যেমন থাকে না, তেমনি গণতন্ত্রও থাকে না।

আরেকটু এগিয়ে যাই, সেটা হলো ‘নৈতিকতা শিক্ষা’ বলতে কী বুঝায়। একমাত্র যে শিক্ষা সবাইকে অন্যায় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে পারে, সেটাই নৈতিকতা শিক্ষা। দেশে সুশাসনের সঙ্কটের বড় উদাহরণ হলো বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। আর সংবাদমাধ্যম শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে। এগুলো আমাদের দেশে কতটুকু বিদ্যমান, সে বিষয়ে যথেষ্ট ভাবনার প্রয়োজন। বাংলাদেশের সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় বর্ণিত আছে নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। তা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর আছে, সেটিও ভাবনার বিষয়। সরকারের মধ্যে সহনশীলতা যত শক্তিশালী হবে সে ক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধের কাঠামো দৃঢ় হবে।

১৭ অক্টোবর ২০১৮ একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম, স্বাধীন দেশে সরকার ছাড়া আর কেউই স্বাধীন নয়। ‘আমার ভোট আমি দেবো, তোমার ভোটও আমি দেবো, যখন খুশি তখন দেবো, দিনের ভোট রাতে দেবো’- এ মন্তব্য সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. শাহাদাত হোসেনের। সোমবার ১৫ অক্টোবর ২০১৮ যমুনা টিভির টকশোতে তিনি এ কথা বলেন, তার বক্তব্যের সারকথা হলো একমাত্র সরকার ছাড়া আর কেউ স্বাধীন নয়। কিন্তু গোটা বিশ্বেই প্রচলিত বাক্যটি হলো বিশেষ করে যা ভোটারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো।

কিন্তু এখন সরকারি দল বলবে, আমরা ভোটারদের আরো ক্ষমতায়ন করেছি। এ ক্ষমতাও তাদের দেয়া হয়েছে, যা স্লোগান দিয়ে তারা জানান দেবে- আমার ভোট আমি দেবো, তোমার ভোটও আমি দেবো, যখন খুশি তখন দেবো, দিনের ভোট রাতে দেবো। এখন পুরোপুরি ক্ষমতায়িত হয়েছে ভোটাররা। দলীয় সরকার ক্ষমতায় রেখে নিরপেক্ষ এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করা দিবাস্বপ্ন বা অলীক কল্পনা। রাষ্ট্রযন্ত্র এমনভাবে সাজানো হয়েছে, দলীয় সরকার নিরপেক্ষ থাকলেও যখন তারা ক্ষমতায় থাকবে তখন নির্বাহী প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবেন না। স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলকে তারা খুশি করতে চেষ্টা করবে। এ সূত্র পাল্টে যাবে যদি বড় রকম কোনো আন্দোলন করে প্রশাসনকে সীমানা দেয়ালের ওপর বসানো যায়। সে রকম হবে কি না সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে এটা যদি সম্ভব হয় সে দিন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতি চর্মচোখে দেখতে পারবে। ওই টকশোতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, ইসির বক্তব্য নিয়েও বিতর্ক আছে, এই বলছে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারব না আবার বলছে দিতে পারব। তার অধীনে অতীতের সিটি কারপোরেশন নির্বাচনগুলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। এ ব্যাপারে আরো পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট হয়ে গেল ইসি মাহবুব তালুকদারের ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এ সন্দেহ আরো ঘনীভূত করে দিলো যে, একটা দলীয় সরকারের অধীনে এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যে আলোচনা করেছে, সেগুলো ছিল লোক দেখানোর জন্য। কিন্তু তাদের অ্যাজেন্ডা পূর্বনির্ধারিত। রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ ও স্টেক হোল্ডাররা যা বলছে, সেগুলো তাদের কাছে কোনো বিষয় নয়। তারা পূর্বপরিকল্পিত পথেই যাচ্ছে। তার মতে, এখানে গণতন্ত্র বলতে কিছুই নেই। এখানে সংসদে বিরোধী দল নেই। এখন সংসদে যাদের বিরোধী দল হিসেবে রাখা হয়েছে এবং আগামীতে যারা আসবে তারা সরকারের আজ্ঞাবহ হয়েই কাজ করবে। এটা ১৭ বছরের শিশুও বোঝে। ক্ষমতার পালাবদল এখন ওপেন সিক্রেট। বেগম এরশাদের যে অবস্থা দেখি তাতে একজন নারী হয়ে নিজের কাছে লজ্জা লাগে। তিনি বক্তব্য দিচ্ছেন আর তার দলের লোকেরা হাসছে। তার কোনো সেল্ফ রেসপেক্ট নেই। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যতটা নির্বাচন হতে আমরা দেখেছি, সেখানে সিইসিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এতটা চাপে রাখেনি। তখন সিইসি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। আগামী নির্বাচনে সেটা সম্ভব হবে না। কারণ হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমলাতান্ত্রিকভাবে সাজানো হয়েছে যেখানে সরকার পছন্দনীয় লোক ছাড়া আর কারো জায়গা দখল করার সুযোগ নেই। এখন যদি সরকার চায় আমি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে জনগণকে দেখিয়ে দেবো, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সরকারের পক্ষে সম্ভব।
লেখক : গ্রন্থকার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক
E-mail: harunrashid@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেভাবেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে : কৃষিমন্ত্রী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪ ভান্ডারিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে দর্শনার্থীদের ঢল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু

সকল