২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাসযোগ্য বসতি কত দূরে?

বাসযোগ্য বসতি কত দূরে? - ছবি : সংগ্রহ

ঢাকা এক অদ্ভুত রাজধানী শহর। দেশের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ ঢাকায় জড়ো হচ্ছে। একসময় ঢাকা শহর ফাঁকা থাকলেও এখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। নদীমাতৃক দেশের রাজধানী নদীবেষ্টিত নগরী ভেনিস হওয়ার কথা থাকলেও সে নগরী এখন বসবাসের অযোগ্য নগরী হিসেবে বিশ্বস্বীকৃত। যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রকাশিত তালিকায় দেখা গেছে, বিশ্বের ১৪০টি দেশের ওপর করা জরিপে সবচেয়ে অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা শহরের অবস্থান ১৩৯তম।

বাসযোগ্য শহরের তালিকায় সবার ওপরে ভিয়েনা। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ভাষ্য মতে, ভিয়েনা শহরের প্রতি বর্গকিলোমিটারে চার হাজার লোক বাস করে। আর ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫ হাজার লোক বাস করে। বসবাসের অযোগ্য হওয়ার পার্থক্য এখানেই। ক্ষমতার রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য যত কূটকৌশল করা হয়, তার সিকি পরিমাণ যদি ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হতো; তাহলে বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকার স্থান দ্বিতীয় হতো না। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার পরই ঢাকার স্থান। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে রাজধানীবাসীর নাগরিক-সুবিধা বাড়ানোর জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দু’ভাগ করেছিল; কিন্তু নাগরিকসুবিধা ন্যূনতম বাড়েনি, বরং দিন দিন ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে। অথচ ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা বক্তব্য-বিবৃতি ও টিভি টকশোতে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিচ্ছেন। উন্নয়ন হয়নি এটা বলছি না, তবে উন্নয়নের চেয়ে লুটপাট হাজার গুণ বেশি হচ্ছে। উন্নয়নের ভেলকিবাজির গল্প রূপকথার গল্পকে হার মানালেও একই রাস্তা বারবার খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা যায়নি। যানজট, ধুলোবালু, ধোঁয়া, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ ও মশার যন্ত্রণায় নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও পরিত্রাণের উপায় নেই। ঢাকায় পথচারীদের চলাচলের জন্য যতটুকু সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা সেটুকুও নেই। যতটুকু আছে- সেখানেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা অবৈধভাবে হাটবাজার ও দোকানপাট গড়ে নিজেদের পকেট ভারী করছেন।

একটি স্বাধীন ও সভ্য দেশের রাজধানী যখন বসবাসের বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে তখন সহজে অনুমেয় হয়, দেশটিতে আইন আছে বটে, কিন্তু আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। যে সমাজ ও রাষ্ট্রে শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চা হয়, সেখানে জনগণের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়। ঢাকার ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য যতটা না জনগণ দায়ী, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি দায়ী ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি। রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা প্রায়ই বলে থাকেন, জনগণের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য রাজনীতি করেন। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যারাই ক্ষমতার মসনদে বসেছে, তারাই জনগণের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করেছে। তা না হলে ঢাকা বাসযোগ্যতা হারাবে কেন?

উন্নয়ন ভালো, কিন্তু ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন কারো জন্য মঙ্গলজনক নয়। যেমনটি ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন নীতির বিষয় সম্পর্কে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস অনুমান করে বলেছিলেন- ভাইসব, তোমরা প্রাচুর্য ও সম্পদ আহরণের জন্য এত কঠোর পরিশ্রম করছো, ইট-পাথর উল্টিয়ে আছড়ে দেখছো, কিন্তু যাদের জন্য তোমাদের সমস্ত জীবনের কঠোর শ্রমের ফল রেখে যাচ্ছো, সেই সন্তানদের যথার্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য কতটুকু পরিকল্পিত নগরায়ন সৃষ্টি করে যাচ্ছো। ঢাকার ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন নীতির দিকে তাকালে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের অনুমানের শতভাগ মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। বসবাসের অযোগ্যতা বিচারে ঢাকার পরই যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার অবস্থান। সিরিয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। কারণ সেখানে এখনো গৃহযুদ্ধ বিরাজ করছে। আমাদের দেশে তো কোনো গৃহযুদ্ধ বিরাজ করছে না, তাহলে কেন সিরিয়ার ভাগ্যহত জনগণের মতো আমাদের বাস-অযোগ্য নগরীতে বসবাস করতে হবে। বসবাসের অযোগ্য তালিকায় তো আর এমনি এমনি চলে আসেনি। সরকার এ দায় এড়াতে পারে না।

আমরা সবাই উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর থাকি। অথচ সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করার সাহস রাখি না। সবাই নিজেকে নিয়ে ভাবি। অন্যের ওপর যখন অবিচার বা জুলুম চলে তখন তা দেখেও না দেখার ভান করি। কিন্তু যখন নিজের ওপর জুলুম চলে তখন আরশের মালিকের কাছে ফরিয়াদ করি। ঢাকার সমস্যার কথা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। ঢাকার প্রধান সমস্যা হচ্ছে- পরিবেশদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, জলাবদ্ধতা, যানজট ও গণশৌচাগারের অভাব। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূল্যবান সময় জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। যানজটের কারণে বছরে ৮১ লাখ ৫০ হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সময় নষ্ট হচ্ছে ৪০ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। যানজটের কারণে বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০১৫ সালে ৮০ হাজার মানুষ পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখে মারা গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যত আলোচনা হয় পরিবেশদূষণ নিয়ে ততটা হয় না। অথচ পরিবেশদূষণের কারণে ঢাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৪৪ কোটি ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির ৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের মোট মৃত্যুর ২৮ শতাংশের জন্য পরিবেশদূষণ দায়ী। এ হার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। বিবিসির এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ঢাকার বায়ুদূষণের কারণে ৯ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। বাড়ছে হাঁপানি ও নিউমোনিয়া। পরিবেশ অধিদফতরের ভাষ্য মতে, ঢাকার বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকায় বছরে ১৫ হাজার শিশুর মৃত্যুর হচ্ছে। বায়ুদূষণের শিকার শুধু ঢাকাবাসী তা কিন্তু নয়, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। তারপরও পরিবেশদূষণ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।

বিপদ-আপদ, দুর্ঘটনা, ভূমিকম্প, সুনামি ইত্যাদির ওপর কারো হাত নেই এ কথা ঠিক। কিন্তু একটু সচেতন হলে মনুষ্য সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা কঠিন তা কিন্তু নয়, ঢাকাকে বাঁচাতে হলে ঢাকা শহর থেকে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, ক্লিনিক, রিকশা, অবৈধ গাড়ি, অপরিকল্পিত দালানকোঠা ও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হাসপাতাল ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে।

ঢাকার শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, যানজট, জলাবদ্ধতা, মশা ও মশাবাহিত রোগ, গণপরিবহনের অপ্রতুলতা, ধোঁয়া ও ধুলোয় কার্যত অচল হয়ে পড়ছে রাজধানী ঢাকা। এই দুর্ভোগ এক দিন, সপ্তাহ বা মাসের নয়। এ অবস্থা চলছে বছরের পর বছর। ক্ষমতাসীনেরা উন্নয়নের বেলুন আকাশে উড়ালেও রাজধানী ঢাকার বসবাসযোগ্যতার খুব একটা উন্নয়ন হয়নি। ঢাকা এখনো পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরগুলোর একটি। ঢাকার সমস্যাগুলো কোনো অলৌকিক ঘটনা কিংবা রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারলে শুধু ঢাকা নয়, অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। সরকার অপরিকল্পিত নগরায়নের শিকার সাধারণ নগরবাসীকে দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করার প্রয়াসে কার্যকর উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।


আরো সংবাদ



premium cement