২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মধ্যপ্রাচ্যের গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব নিরসন করা যেতে পারে

মধ্যপ্রাচ্যের গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব নিরসন করা যেতে পারে - ছবি : সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যে গোষ্ঠীতন্ত্র বা গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতকে শত শত বছরের পুরনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ফল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়ে থাকে, শত শত বছরের পুরনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে এসব সঙ্ঘাত লেগে রয়েছে। এটি প্রায় সময়ে বলা হয় যে, ‘ওই অঞ্চলে গোষ্ঠীতন্ত্রের শিকড় এত গভীরে যে, সেটিকে পরাজিত করা সম্ভব হবে না। আমাদের ওটা নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত নয়।’

মিডিয়া, নীতি প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের একটি বড় অংশ এই মত পোষণ করে থাকেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার মতো ক্ষমতার উচ্চমার্গে যারা অবস্থান করেন, তারাও এ ধরনের চিন্তা করে থাকেন। ওবামা ২০১৬ সালের স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; সেটি একটি প্রজন্মের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের অবসান ঘটিয়ে অনাগত স্বর্ণযুগে ফিরে যাবে।’ বাস্তবতা হলো, মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি ও শিয়া মুসলিমদের গোষ্ঠীগত সঙ্ঘাত একটি আধুনিক ও সংশোধনবাদী রাজনৈতিক ঘটনা। এটি হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে আধুনিককালের ঘটনাপ্রবাহ এবং সমস্যাগুলোর একটি প্রতিক্রিয়া। অনুসন্ধান করে এর মূল ভিত্তি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে রাষ্ট্র গঠনের ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এ ছাড়াও ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের চেয়েও বরং শত শত বছরের পুরনো ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজনকেই এর কারণ হিসেবে পাওয়া যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো- ২০০৩ সালের ‘সিরীয় বিপ্লব’, ইয়েমেনের যুদ্ধ এবং চলমান অন্যান্য ইস্যু।

গোষ্ঠীতন্ত্রের মূল ভিত্তি
১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসে প্রথম একটি ধর্মভিত্তিক সরকারকে ক্ষমতায় আসীন করা হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের জনগণের জীবনে ধর্মীয় উপস্থিতি থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষ সরকারই দেশ শাসন করছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ধর্মীয় সরকার তথা ধর্মীয় শাসন প্রধান কোনো ফ্যাক্টর নয়। বস্তুত ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়তো প্যান-আরব মতবাদের ধ্বংসস্তূপের ওপর রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানের পথ নির্দেশ করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক ইসলামের যে আন্দোলন তখন দানা বেঁধে উঠেছিল, ইরানি বিপ্লবের আগে তা কখনো মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও ক্ষমতা অর্জনের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি।

ইসলামি বিপ্লব কেবল মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রধান দেশের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ক্ষমতায় স্থলাভিষিক্ত করেনি, বরং এই বিপ্লবের কারণে গোষ্ঠীগত উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়েছে। ওই বিপ্লবকে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোতে ‘রফতানি’ করার উদ্যোগ নেয়ায় উত্তেজনা ও সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ১৯৮০-এর দশকে ইরান ও ইরাকের মধ্যে দীর্ঘ আট বছরব্যাপী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর জয়লাভে ব্যর্থ হয়ে ইরান সংযত ও বিনয়ীভাব ধারণ করে এবং অল্প সময়ের জন্য অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের মাধ্যমে ইরানের সম্প্রসারণবাদের বিরোধী শক্তি ও নেতা সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তেহরানের জন্য একটি নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচিত হলো। তেহরান আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমি পর্যন্ত শিয়া মতবাদের বিস্তৃতি ঘটানোর সুযোগ লাভ করে।

আরব বসন্তের প্রেক্ষাপটে প্রথমে ইরাকে এবং পরে সিরিয়ায় শিয়া মতবাদের পুনরুজ্জীবন এবং গোষ্ঠীগত রাজনীতির বিস্তৃতির ফলে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট (আইএসআইএল) এবং অন্যান্য চরমপন্থী সুন্নি গ্রুপের উত্থান ঘটে। ইসলামিক স্টেট শিয়া ক্ষমতা ও ইরানের সম্প্রসারণবাদী নীতির বিরুদ্ধে নিজেদের ‘সুন্নি ইসলামের চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

সিরিয়া ও ইরাকে সুন্নি বিদ্রোহী ও ইসলামিক স্টেটের পাল্টা হিসেবে ইরান শিয়া মিলিশিয়া গঠন করে। উপসাগরীয় দেশগুলো সুন্নি গ্রুপগুলোকে সমর্থন দিয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে দুইপক্ষের মধ্যে প্রক্সি-যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং উভয়পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

রাষ্ট্রের ব্যর্থতা
মধ্যপ্রাচ্যে রাষ্ট্র গঠনে ব্যর্থতা, বিশেষত রাষ্ট্র বাইরের হুমকি মোকাবেলা এবং পর্যাপ্ত সরকারি সেবা প্রদান ও নাগরিকদের নাগরিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থতার মতো প্রধান প্রধান কাজ সম্পাদনে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে সশস্ত্র অরাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীগত অভিনেতারা রঙ্গমঞ্চে এসে উপস্থিত হয়।

ইরাকের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে আইনের শাসনের মাধ্যমে সেটিকে পুনঃস্থাপনে ব্যর্থতার কারণে দেশটিতে গোষ্ঠীতন্ত্রের উত্থান ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে, ইরাকে আগ্রাসন-পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয়, যাতে গোষ্ঠীগত ফাটল প্রতিফলিত ও জোরদার হয়।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো গোষ্ঠীগত ও জাতিগোষ্ঠী ভিত্তিতে বিভাজন করা হয়- যাতে বিজয়ী ও পরাজিতদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের পালাক্রমে বদল ঘটে। বিশেষত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকীর অধীন দাওয়া পার্টির গোষ্ঠীগত নীতি ইরাকের সব নাগরিকের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের সব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।

বাশার আল আসাদের সরকার ২০১১ সালের প্রতিবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য সিরিয়ায় ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করেছিল। সাথে সাথে এসব কঠোর পদক্ষেপের প্রতি ইরান ও ইরাকের সমর্থন গোষ্ঠীগত আঞ্চলিক উত্তেজনার জন্ম দেয়। এই বিক্ষুব্ধ ও অশান্ত সময়ে সিরিয়া একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়; যেখানে সরকার জনগণের জন্য যথাযথ সেবা দিতে ব্যর্থ এবং আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিচয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। সিরীয় সরকার আর কোনো সরকারি সেবা অথবা নিরাপত্তা দিতে পারে না এবং তার ভূখণ্ডের বিশাল একটি এলাকার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এ পরিস্থিতিতে সেখানে গোষ্ঠীগত মিলিশিয়াদের উত্থান ঘটে এবং তারা বেসামরিক লোকদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

সহিংসতার একটি দূষিত চক্রে আবদ্ধ হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে বাধা বা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়েছে। সিরিয়ার গোষ্ঠীগত গ্রুপগুলো নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য বাইরের সমর্থনের প্রত্যাশী হয়ে ওঠে। এতে স্থানীয়দের সাথে দূরত্ব এবং আঞ্চলিক সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়।
শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র বা সরকারের অনুপস্থিতির ফলে জাতীয় সীমান্ত বরাবর আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়কে হেয় করা হয় এবং গোষ্ঠীতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

সমাধান
আমরা যদি গোষ্ঠীতন্ত্রকে পরাভূত করতে চাই, আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতকে ধর্মীয় অথবা আদর্শিক বৈশিষ্ট্যমূলকভাবে ব্যবহার অথবা ইসলামের আদিযুগের উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে গোষ্ঠীগত সঙ্ঘাতকে আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা বন্ধ করতে হবে। এর পরিবর্তে আমাদের অবশ্যই এসব সমস্যাকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত সঙ্ঘাত হিসেবে উপলব্ধি করতে হবে- যাতে সেগুলো সমাধান করা যায়।

বিভিন্ন শক্তি যাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হলো ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জন করা, তারা ব্যাপক জনমত তৈরি করার জন্য ধর্ম এবং গোষ্ঠী বা উপদলকে ব্যবহার করে। তাদের বিরোধিতা বা মোকাবেলা করার একমাত্র পথ হলো শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলা, যেখানে মানবাধিকার ও আইনের শাসন সমুন্নত থাকবে। কিন্তু শক্তি ব্যবহারের একচ্ছত্র অধিকারও বজায় রাখা যাবে। এর অর্থ কিন্তু রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ফিরে আসা নয়।

শক্তিশালী জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে অবশ্যই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে কোনো দেশ এসে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। গণতান্ত্রিক অনুশীলন অবশ্যই করতে হবে এবং জাতীয় সরকার অবশ্যই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতে হবে। সঙ্ঘাত নিরসনে এবং সামষ্টিক নিরাপত্তামূলক সরকার গড়ে তুলতে গণতন্ত্র অধিকতর সক্ষম।
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement
‘সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না’ ফরিদপুরে বেইলি ব্রিজ অপসারণ করে স্থায়ী ব্রিজ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন ঈশ্বরদীতে তাপমাত্রা ৪১.২ ডিগ্রি বাংলাদেশকে এভিয়েশন হাব হিসেবে গড়তে সহযোগিতা করতে চায় যুক্তরাজ্য অশ্লীল নৃত্য পরিবেশনের অভিযোগে ৫ জন‌ আটক ঈশ্বরদীতে বৃষ্টির জন্য ইসতেসকার নামাজ তীব্র তাপদাহে খাবার স্যালাইন ও শরবত বিতরণ করল একতা বন্ধু উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গলাচিপায় পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম হলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে : ইসি শিশু সন্তান অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, সৎ বাবাসহ গ্রেফতার ২ উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুবককে কুপিয়ে হত্যা

সকল