১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তাদের ভুলবেন না

তাদের ভুলবেন না - ছবি : সংগৃহীত

আমি তৎক্ষণাৎ ড. শিরিন মাজারির নাম উচ্চারণ করলাম এবং বললাম, তিনি মানবাধিকার মন্ত্রী। তিনি সম্প্রতি আমেনা মাসউদ জানজুয়াকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, গুমকে থামানোর জন্য বিধিবদ্ধ আইন প্রণয়ন করা হবে। শুই মেঙ্গ আমার কাছে ড. শিরিন মাজারির ফোন নম্বর চাইলেন। আমি নম্বর দিলাম। এরপর তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সম্ভবত আমি পাকিস্তানের ভিসা পাবো না। আমি কিছুক্ষণ নীরব থাকলাম

তিনি গত চার বছর ধরে নিখোঁজ। কেউ জানে না, তিনি জীবিত আছেন কি না। তার স্ত্রীকে বলা হয়েছে, আপনার স্বামীকে ভুলে যান। কিন্তু স্ত্রী তার স্বামীকে ভোলার জন্য প্রস্তুত নন। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকব, চুপ থাকব না। আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমার স্বামী চার বছর ধরে নিখোঁজ। আপনারা তাকে ভুলবেন না। স্বামীর গুম হওয়া নিয়ে প্রতিবাদকারী এ সাহসী নারীর নাম শুই মেঙ্গ। তার স্বামী সোমবাথ সোমফোনকে ২০১২ সালে লাওসে স্থানীয় পুলিশ চেকপোস্টে আটকে দেয় এবং গ্রেফতার করে। সোমবাথের গ্রেফতারির ভিডিও ফিল্ম বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও লাওস সরকার এটি মানতে প্রস্তুত নয় যে, সোমবাথ সরকারি হেফাজতে রয়েছে।

২৯ সেপ্টেম্বর বেলজিয়ামের জেন্ট শহরে এশিয়া ইউরোপ পিপলস ফোরামের দ্বাদশ বৈঠকে ৪৪টি দেশের সাড়ে তিন শ'র বেশি প্রতিনিধির সামনে শুই মেঙ্গ নিজ দেশের মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে দিলেন। আমার মনে হলো, এ কাহিনী আমি আগেও কয়েকবার শুনেছি। ২০০৩ সালে এমনই একটি কাহিনী ইমরান খান ড. আফিয়া সিদ্দিকির জোরপূর্বক গুমের ব্যাপারে শুনিয়েছিলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংস্থা কয়েক বছর পর্যন্ত আফিয়া সিদ্দিকির গ্রেফতার সম্পর্কে অস্বীকার করে গেছে। এ রকম কাহিনী আমি আমেনা মাসউদ জানজুয়ার মুখেও শুনেছি, যার স্বামী মাসউদ জানজুয়াকে ২০০৫ সালে গুম করা হয়।

আমার চোখের সামনে আখতার মিঙ্গালের চেহারাও ঘুরপাক খাচ্ছিল। তার দল সম্প্রতি তেহরিকে ইনসাফের সাথে ছয় দফার এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ইমরান খানকে সমর্থন জানায়। ওই ছয় দফার সর্বপ্রথম দফা হচ্ছে- গুম করা ব্যক্তিদের ফেরানো সম্পর্কিত। দলটির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যেসব হারানো ব্যক্তির তালিকা দেয়া হয়েছে তাদের মধ্য থেকে প্রায় দুই শ’ ব্যক্তি মুখ বন্ধ রেখে নিজেদের ঘরে পৌঁছে গেছে। তবে আখতার মিঙ্গাল বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে বেলুচিস্তান থেকে আরো পঞ্চাশজন লোক নিখোঁজ হয়েছে। তাদের সবার কাহিনী সোমবাথের কাহিনীর সাথে মিলে যায়। সোমবাথ কোনো রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন সমাজকর্মী। তিনি এশিয়া ইউরোপ পিপলস ফোরামের সাথে ২০১২ সালে লাওসে মানবাধিকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। এ ফোরাম এশিয়া ও ইউরোপের উন্নয়নকামী রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মীর কণ্ঠস্বর। লাওসের কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে উন্নয়নকামীদের কৃত সমালোচনা সহ্য করা হয় না।

সোমবাথকে গুম করে দেয়া হয়। সোমবাথের স্ত্রী শুই মেঙ্গের উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে আমি ছাড়াও সিনেটর মুশাহিদ হুসাইন সাইয়িদও ছিলেন, যাকে ফারুক তারেক এইপিএফ’র এ কনফারেন্সে আমন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক বিদ্রোহীদের তালিকায় যুক্ত করে দিয়েছেন। শুই মেঙ্গের বক্তৃতার সময় বারবার তালি মারা ব্যক্তিদের মধ্যে শাহলা রশিদকেও দেখা গেছে। শাহলা রশিদ সম্পর্কেও কিছু শুনুন।

শাহলা রশিদ শ্রীনগরের অধিবাসী। তিনি নতুন দিল্লির জওয়াহের লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। বর্তমানে পিএইচডি করছেন। তিনি এইপিএফ’র এ কনফারেন্সে বেশ গর্বের সাথে নিজেকে এমন এক কাশ্মিরি নারীরূপে পরিচয় করিয়ে দেন, যাকে বিজেপির সমর্থকেরা গাদ্দার অভিহিত করেছে। কেননা শাহলা কাশ্মিরি স্বাধীনতাকামী আফজাল গুরুর ফাঁসির বিরুদ্ধে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। শাহলা এ কনফারেন্সে স্পষ্টভাবে বলেন, আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের কোনো অভিযোগই প্রমাণ হয়নি। আফজাল গুরুকে ফাঁসিতে ঝোলানো স্পষ্ট অবিচার ছিল। সুতরাং আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলাম। লাওসের সমাজকর্মী সোমবাথের গুম হওয়ার ঘটনা শাহলা রশিদের জন্য নতুন কিছু ছিল না। কেননা কাশ্মিরে এ রকম একটি নয়, হাজার হাজার কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শুই মেঙ্গ যখন তার স্বামীর বিষয়ে কথা বলছিলেন, তখন কনফারেন্সের স্টেজে একটি খালি চেয়ার রাখা হয়েছিল। এ খালি চেয়ার আমাদেরকে সোমবাথের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। শুই মেঙ্গ খালি চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলেন, তিনি আজ এ চেয়ারে উপস্থিত নেই, তবে আপনাদের তার কথা মনে রাখতে হবে এবং বিশ্বকে বলতে হবে, সোমবাথের মতো লোকদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই অপহরণ করে থাকে। কেননা কাউকে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত গুম করে রাখা শুধু রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব। নিজেদের লোকদের গুম করে রাষ্ট্র নিজের শক্তির নয়, বরং দুর্বলতার স্বীকারোক্তি প্রকাশ করে। কেননা যে রাষ্ট্র আদালতে কারো অপরাধ প্রমাণ করতে পারে না, সে অযোগ্য হয়ে থাকে। আর অযোগ্য লোকদের নিজেদের শক্তি প্রকাশের বেশ শখ হয়ে থাকে, কেননা তারা ভেতর থেকে নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়। শুই মেঙ্গ তার বক্তৃতা শেষ করলে জেন্ট ইউনিভার্সিটির কনভেনশন সেন্টারে উপস্থিত কয়েক শ’ মানুষ কয়েক মিনিট পর্যন্ত দাঁড়িয়ে তার জন্য করতালি দেয়।

বক্তৃতা শেষ করে শুই মেঙ্গ আমার কাছে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমেনা মাসউদ জানজুয়াকে চেন? আমি জবাবে বললাম, আপনার বক্তৃতা শোনার সময় আমেনা মাসউদ জানজুয়ার কথা ভাবছিলাম। আমরা আমাদের এ মজলুম বোনের কাহিনী কয়েক বছর ধরে শুনছি, কিন্তু তাকে সুবিচার পাইয়ে দিতে পারিনি। শুই মেঙ্গ বেশ গর্বের সাথে বললেন, আমেনার সাথে আমার দেখা হয়েছে। সে আমার বোন। আমি যেখানেই যাই, আমেনাকে অবশ্যই স্মরণ করি। শুই মেঙ্গ বেশ দৃঢ়তার সাথে বললেন, আমেনা আমার শক্তি, আর আমি তার শক্তি। কনফারেন্সের চা-বিরতির সময় জানতে পারলাম, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও সিরিয়া থেকে তুরস্ক পর্যন্ত দেশ থেকে আসা বেশির ভাগ প্রতিনিধি আমেনা মাসউদ জানজুয়ার নাম সম্পর্কে অবহিত আছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভাবা উচিত, আমেনা মাসউদ জানজুয়ার এ জনপ্রিয়তা রাষ্ট্রের সম্মান বৃদ্ধি করেছে, না কমিয়ে দিয়েছে? পাকিস্তানের আদালতকেও এটি ভাবা উচিত, যে দেশে গুমের ঘটনা ক্রমেই ঘটে চলেছে, সেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার দাবিকে কে বিশ্বাস করবে?

আমি তৎক্ষণাত ড. শিরিন মাজারির নাম উচ্চারণ করলাম এবং বললাম, তিনি মানবাধিকার মন্ত্রী। তিনি সম্প্রতি আমেনা মাসউদ জানজুয়াকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন, গুমকে থামানোর জন্য বিধিবদ্ধ আইন প্রণয়ন করা হবে। শুই মেঙ্গ আমার কাছে ড. শিরিন মাজারির ফোন নম্বর চাইলেন। আমি নম্বর দিলাম। এরপর তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সম্ভবত আমি পাকিস্তানের ভিসা পাবো না। আমি কিছুক্ষণ নীরব থাকলাম। এরপর বললাম, আপনি ভিসা পান আর না পান, ড. শিরিন মাজারির এ মুহূর্তে এ সমস্যার সমাধান করা উচিত। কেননা আমেনা মাসউদ জানজুয়া গুম করার বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক কণ্ঠে পরিণত হয়েছেন। আর তিনি তার স্বামীসহ কোনো নিখোঁজ ব্যক্তিকে কখনোই ভুলবেন না।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement