২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

জাতিসঙ্ঘের ৭৩তম অধিবেশন ও বাস্তবতা

জাতিসঙ্ঘের ৭৩তম অধিবেশন ও বাস্তবতা - ছবি : সংগ্রহ


বিশ্বায়নের এ যুগে পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর সবচেয়ে বড় সংগঠন হলো জাতিসঙ্ঘ। আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন রয়েছে। যেমন- ইইউ, কমনওয়েলথ, ওআইসি, সার্ক, আসিয়ান, ন্যাম, এইউ, জিসিসি, বিমসটেক, ডি-৮, জি-৭, ডব্লিউটিও, নাফটা, সিরডাপ, ইন্টারপোল প্রভৃতি। সংগঠনগুলো কোনো-না-কোনোভাবে জাতিসঙ্ঘের কাছে দায়বদ্ধ। তারা কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে কোনোভাবেই জাতিসঙ্ঘের নীতিমালা অগ্রাহ্য করতে পারে না।

বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান চিত্র এক ভয়াবহ দুর্যোগের প্রতিফলন। কোনো রাষ্ট্রই দীর্ঘস্থায়ী পারস্পরিক সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে পারছে না। এ চিত্র উঠে এসেছে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেসের বক্তব্যে। সাধারণ পরিষদের উদ্বোধনী ভাষণে মহাসচিব বলেন, বিশ্বব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা ও সংশয় সন্দেহের মুখে পড়ছে। যার ফলে এ ব্যবস্থা এক সময় ভেঙে পড়তে পারে। তিনি আরো বলেন, নিয়মনীতি ভিত্তিক বৈশ্বিক  শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যকার আস্থার সম্পর্ক ভেঙে পড়ার অবস্থায় এসে পৌঁছেছে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরো জটিল হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ক্রমেই আরো বেশি বিশৃঙ্খলায় পতিত হচ্ছে। এখন ক্ষমতার সম্পর্ক কম স্পষ্ট।

বিশ্বে মূল্যবোধের ক্ষয় হচ্ছে। গণতান্ত্রিক নীতিমালাও হয়ে পড়েছে অবরুদ্ধ। ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটার সাথে সাথে বৈরিতার ঝুঁকিও বাড়ছে। মানবাধিকারসংক্রান্ত বিষয় ভিত্তি হারাচ্ছে এবং স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের উত্থান ঘটছে। সবার মঙ্গলের জন্য সম্মিলিত ও কাণ্ডজ্ঞানভিত্তিক তৎপরতা গ্রহণের বিকল্প নেই। বিশে^ শান্তির উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক মানবিক নিয়মনীতির প্রতি উঠে যাচ্ছে শ্রদ্ধাবোধ।

কথাগুলো সাধারণ কোনো মানুষের নয়। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কর্তৃপক্ষের উচিত এগুলো গুরুত্বের সাথে নেয়া। কিন্তু এই কথাগুলো যদি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় না নেয়া হয়, তাহলে বিশ্বরাজনীতি ক্রমেই ভয়াবহ সঙ্কটের দিকে অগ্রসর হবে। তা কোনো রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে না, বরং এক ভয়াবহ সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যাবে বিশ্বব্যবস্থাকে।

বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো রোহিঙ্গা সমস্যা। এ ইস্যুতে পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসঙ্ঘ যে কাম্য ভূমিকা রাখতে পারছে না, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। এই ব্যর্থতা থেকেই উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচার। ওদের বিচার হতে হবে এটা কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু বিচারের নামে যদি দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিয়ে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ দিন বাংলাদেশে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই এর জন্য এক ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশ সরকারকে সেটা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসঙ্ঘ তথা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সফলতার মুখ দেখছে না। জাতিসঙ্ঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনের সংশ্লিষ্ট বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমন একটি জটিল ইস্যু যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী সফল হয় না, সেটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফল হলো দীর্ঘস্থায়ীভাবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে লালন পালন করতে হবে। আরো কঠিন বাস্তবতা হলো- এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রহীনতার দায় থেকে মুক্তি দিতে পারছে না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

ইরান ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশন নতুন মাত্রা পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ও ইরানের সরকারপ্রধান যেভাবে একে অন্যের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করেছেন, সেটা বর্তমান বিশৃঙ্খল বিশ্ব ব্যবস্থাকে আরো বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যাবে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সাথে ইরানের যে চুক্তি হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সেই চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অন্য পরাশক্তিগুলো ও জার্মনি ইরানের সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্য বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফলে এক দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন টালমাটাল বাস্তবতায় জাতিসঙ্ঘ যে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না, সেটাই প্রমাণিত হয়েছে মহাসচিবের বক্তব্যে। এ থেকে পরিত্রাণ না পাওয়া গেলে এর করুণ পরিণতি শুধু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোকেই ভোগ করতে হবে না, বরং এর প্রভাব সমগ্র পৃথিবীতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এর করালগ্রাস থেকে হয়তো কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্কটও নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইসরাইলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে অবস্থান নিয়েছে তাতে সঙ্কটের সমাধান তো হবেই না, বরং এক দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাতের দিকে এগোচ্ছে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্কট। এই ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে একক কর্তৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। ফিলিস্তিনের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে মুসলিম বিশ্ব। তথাপি এই দৃঢ় প্রত্যয় কত দিন অটুট থাকে ও কী কী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সুতরাং ফিলিস্তিন সঙ্কট যে খুব দ্রুত সমাধান হচ্ছে না, সেটি সহজেই প্রতীয়মান।

ভারতের এনআরসি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে কেউ কোনো টুঁ-শব্দটিও করেনি। যদি ভারতের রাজনীতিবিদদের কথা অনুযায়ী এনআরসি কার্যকর হয়, তাহলে বাংলাদেশ স্মরণকালের ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে পড়বে। সেই সঙ্কট থেকে উত্তরণ হয়তো একবিংশ শতাব্দীতে সম্ভব হবে না। সুতরাং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বহুপক্ষীয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ সঙ্কট যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ঘটনা ঘটে গেলে হা-হুতাশ করে লাভ হবে না। জাতিসঙ্ঘেরও এনআরসি বিষয়ে জোরালো অবস্থান নিতে হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাস রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট এক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইয়েমেনে এক ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে। যুদ্ধের তীব্রতা এতই প্রকট ছিল যে, শিশুরা এর বাইরে থাকতে পারেনি। আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী কয়েক বছরে ইয়েমেনে ৫০ লাখ শিশু অনাহারে মারা যাবে। প্রধানত সৌদি আরব নিজেদের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখার জন্য এবং পশ্চিমাদের কূটকৌশলের শিকার হয়ে ইয়েমেনে স্মরণকালের ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট তৈরি করেছে। জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে সংশ্লিষ্টরা ইয়েমেন সঙ্কট সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। জাতিসঙ্ঘের নীরব ভূমিকা জাতিরাষ্ট্রগুলোর জন্য অশনিসঙ্কেত।

সিরিয়া সঙ্কট দীর্ঘতর হচ্ছে। ইরান, তুরস্ক, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সিরিয়া সঙ্কটেরও যে শিগগিরই সমাধান হচ্ছে না, সেটা সহজেই অনুমেয়। জাতিসঙ্ঘ এই ভয়াবহ যুদ্ধের দায় এড়াতে পারে না।

পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে বা হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোকে। কিন্তু এ ভয়াবহ বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে পরিত্রাণের জন্য জাতিসঙ্ঘের ৭৩তম অধিবেশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। রাষ্ট্রগুলোর ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে কোনোভাবেই জাতিসঙ্ঘ দায় এড়াতে পারে না।

জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব মূল্যবোধের ক্ষয়ের কথা বলেছেন। গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের উত্থানের কথা বলেছেন। মানবাধিকারের ভিত্তি হারানোর কথা বলেছেন। বিষয়গুলো একক কোনো রাষ্ট্র ও সংগঠনের ব্যর্থতার ফলে সৃষ্টি হয়নি, বরং এটা সামগ্রিক ব্যর্থতার ফসল। ২০০৩ সালে কোনো মূল্যবোধের তোয়াক্কা না করে ইরাকে আগ্রাসন চালানোর ফলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূচনা হলো। আরব বসন্তের ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে যে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল, তা-ও আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর পেছনে রয়েছে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থপরতা। ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার সনদের বিষয়গুলোর চরমভাবে অবমাননাই করা হচ্ছে। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনা পৃথিবী থেকে উধাও হওয়ার উপক্রম হয়েছে। যারা নিজেদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক শক্তি বলে পরিচয় দিতে চান বা দিয়ে থাকেন, তাদের দেশেও গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসন ও মূল্যবোধের চরম সঙ্কটের ফলেই এ অবস্থা। পৃথিবীর ইতিহাসে নির্বাচিত স্বৈরাচারীদের চিত্র ইতিহাসের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গণতন্ত্রের ন্যূনতম মূল্যবোধের বিষয়গুলোও ওরা মানতে নারাজ।

এ স্বৈরাচারীরা বিভিন্ন কৌশলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা বিশ্বকে নিজেদের পক্ষে রাখার কূটকৌশল নিচ্ছে। সেই কূটকৌশল থেকে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো ও রাষ্ট্রগুলো বের হয়ে আসতে পারছে না। এটাই প্রতীয়মান হয়, জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব নিজের অসহায়ত্বের কথাই ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে সুকৌশলে বলে গেছেন। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোরও স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থা কেবল সেই রাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, পাশের রাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে। এ বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ না পাওয়া গেলে বিশ্ব কারো জন্যই নিরাপদ হবে না। সুতরাং আন্তর্জাতিক সংগঠন, রাষ্ট্র ও ব্যক্তিদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে, প্রত্যেক মানুষ সেই প্রত্যাশাই করে। জাতিসঙ্ঘকেই এ শুভবুদ্ধি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে হবে।
mahmuduljnu71@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
মাকে ভরণ-পোষণ না দেয়ায় শিক্ষক ছেলে গ্রেফতার প্রথম বাংলাদেশী আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত ঢাবির সব ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিরাপত্তা-বিষয়ক আলোচনা করতে উত্তর কোরিয়ায় রুশ গোয়েন্দা প্রধান বদলে যেতে পারে এসএসসি পরীক্ষার নাম সীমান্তে বাংলাদেশীদের মৃত্যু কমেছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাস্তি কমিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনে উদ্বেগ টিআইবির যখন দলকে আর সহযোগিতা করতে পারবো না তখন অবসরে যাবো : মেসি ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান আর নেই বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ খণ্ডালেন ওবায়দুল কাদের

সকল