২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাশ্মির চ্যালেঞ্জ

কাশ্মির চ্যালেঞ্জ - ফাইল ছবি

ভারত পাকিস্তানের সাথে আলোচনা বাতিল করে দিয়েছে। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনার সাথে সাথে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী করে ভারত আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করেছে। পাকিস্তানি এবং ভারতীয়রা পরস্পরের ব্যাপারে যে অভিযোগ করে থাকে, সেই বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার পথেই ফিরে গেছে। দুঃখজনকভাবে, সত্যকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যাই হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, তিনি সাদামাটাভাবে জানতে চান সত্যকে। অন্যথায়, তার পূর্বসূরিদের মতো তাকে পরিকল্পিতভাবে হঠাৎ বেকায়দায় ফেলা হবে। পাকিস্তান সংলাপ চায়। ভারত জানিয়েছে, পাকিস্তানকে অবশ্যই প্রথমে ‘আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস’ বন্ধ করতে হবে। মোদি প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়ার পর তার মন পরিবর্তন করলেন কেন? তিনি কি মনে করেন ইমরান খান সমর্থন করবেন বর্বরতা বা নৃশংসতাকে? অথবা তিনি কি অপ্রাসঙ্গিক বা অবান্তর?

কাশ্মিরের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারত কি সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করবে? বিষয়টির ব্যাপারে একটি আইনগত ও রাজনৈতিক বাস্তবতা রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ ১৯৪৮-৪৯ সালেই কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ দৃঢ়তার সাথে পুনর্ব্যক্ত করেছে, ‘মানুষকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সশস্ত্রবাহিনীকে ব্যবহার না করাই হচ্ছে রাষ্ট্রের কর্তব্য।’ অবৈধ সামরিক দখলদারিত্ব এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রতিরোধ সন্ত্রাস নয়।

১৯৮২ সালে জাতিসঙ্ঘ পুনরায় নিশ্চিত করেছে- স্বাধীনতা, আঞ্চলিক সংহতি, জাতীয় ঐক্যের জন্য গণমানুষের সংগ্রাম বৈধ। ঔপনিবেশিক অথবা বিদেশী আধিপত্য ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামসহ গ্রহণযোগ্য সব উপায়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া বৈধ।’

জম্মু ও কাশ্মির ‘ভারতীয় ইউনিয়নের অংশ’ বলে ভারত যে দাবি করছে, জাতিসঙ্ঘ সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। কাশ্মির একটা বিরোধপূর্ণ ভূখণ্ড। কাশ্মিরি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার জম্মু ও কাশ্মিরের ভারতীয় দখলদাররা জোরপূর্বক অস্বীকার করে আসছে। ভারত গণভোটের শর্তাবলি পূরণ না করার জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ করছে। যদি এটাই হয়, তা জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের অধিকারকে খর্ব করতে পারবে না। প্রকৃত ব্যাপার হলো- অধ্যায় ৬-এর অধীনে কাশ্মির বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। এই বিরোধের বিষয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং এর বাস্তবায়ন ছাড়া জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এবং পক্ষগুলোর আর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সিমলা চুক্তিও কাশ্মিরিদের অধিকারের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেনি।

যাই হোক না কেন, ভারত রাজনৈতিকভাবে আলোচিত একটি বিষয়ও মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অধিকন্তু, ভারতের অধিকৃত কাশ্মিরে মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাশ্মির সঙ্কট সমাধানের জন্য ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে প্রস্তুত নয়। কাশ্মির নিয়ে বিরোধের কারণে পরমাণু শক্তির অধিকারী এই দুই দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টি মীমাংসার জন্য কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বহীনতারই প্রকাশ ঘটেছে। এর মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই জাতিসঙ্ঘের কাঠামোগত অদক্ষতার বিষয়টিই ফুটে ওঠে। অথচ জাতিসঙ্ঘের প্রাথমিক উদ্দেশ্যই হচ্ছে শান্তি রক্ষা করা, যেন যুদ্ধ ও ধ্বংসাত্মক সঙ্ঘাতের হুমকি দূর হয়ে যায়।

বৈধ স্বাধীনতাসংগ্রামসহ যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্যাতনসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেআইনি এবং অগ্রহণযোগ্য। নির্দোষ বেসামরিক লোকদের অধিকার অলঙ্ঘনীয়। এক দলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিয়ে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা ভুক্তভোগীসহ অন্যদের বিচার করা যাবে না। অবৈধ সামরিক দখলদারিত্ব এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম প্রতিরোধ সন্ত্রাস নয়। মোট কথা, রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না। কেবল জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের চ্যাপ্টার ৭-এর প্রস্তাবগুলো বাধ্যতামূলক। এটা অবিশ্বাস্য যে, ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ জম্মু ও কাশ্মিরের ব্যাপারে ৭ নম্বর প্রস্তাব পাস করেছে। পাকিস্তানের বন্ধুদের কেউ এ ধরনের বিষয় সমর্থন করতে পারে না।

জাতিসঙ্ঘের প্রধান ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো জম্মু ও কাশ্মিরসহ দুই দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসার জন্য ভারতকে অব্যাহতভাবে উৎসাহিত করতে এবং বোঝাতে পারে। যা নিয়ে সংলাপ করার জন্য জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব পাস করেছে, ভারত হয়তো তাতে সম্মত হতে পারে। অতীতে ভারত এটা করেছে।

প্রধান ইস্যুগুলো নিয়ে কয়েক দফা ব্যর্থ আলোচনার পর একটি অথবা কয়েকটি ঘটনায় এই আলোচনা ভেঙে গেছে। উত্তেজনা বাড়ছে। সঙ্ঘাতের ঘটনা ঘটছে। সামরিক শক্তির ঘটছে উত্থান।

পাকিস্তানের কি ভারতের সাথে সংলাপকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা উচিত? প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের উপদেশ প্রত্যাখ্যান করে সঠিক কাজ করেছেন। তবে ভারত অনিচ্ছুক হলে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সংলাপের অনুরোধ জানানোর প্রয়োজন নেই। পাকিস্তানকে অবশ্যই তার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে হবে। যদি তা ঘটে, ভারত দ্রুত অথবা দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে পারবে, কাশ্মিরি জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনকে তাদের পক্ষে স্থায়ীভাবে নস্যাৎ করে দেয়া সম্ভব নয়। তারা পাকিস্তানকে তাদের অসামর্থ্যরে জন্য দোষারোপ করেও সফল হতে পারবে না।

অপর দিকে, পাকিস্তানের উচিত তাদের কাশ্মির ইস্যুতে অ্যাডভোকেসি এবং কূটনীতিকে আরো উন্নত ও জোরদার করা। দু’দেশের মধ্যকার সব সমস্যার সমাধানের জন্য ভারতের সাথে সংলাপ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব দ্রুত বা দেরিতে হলেও মনে হয়, গ্রহণ করা হবে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ হলো, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেয়ে হুমকির সৃষ্টি করতে পারে।

অবশ্য মোদি আপাতত ইমরান খানকে ‘অসৎ কর্মসূচির’ ‘সত্যিকারের চেহারা’ হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগকে এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারবেন বলে আশাবাদী। মোদির ‘ইউটার্ন’ বর্বরতা দ্বারা প্রভাবিত বলে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেটা কতটুকু সঠিক, তা স্পষ্ট নয়।

২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে মোদির বিরুদ্ধে একটি বড় দুর্নীতিসংক্রান্ত কেলেঙ্কারি সামনে আনা হয়েছে। সাধারণ ধারণা হলো, পাকিস্তানবিরোধী প্রভাবশালী একটি লবি এই তৎপরতার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে। যাই হোক না কেন, এটা কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন বাস্তবতাকে নিরুৎসাহিত এবং উভয় দেশের উগ্রপন্থীদের উৎসাহিত করেছে।

কাশ্মিরের ব্যাপারে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক অবস্থান পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। আর কাশ্মিরিদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর জন্য ভারতকে অনুমতি দিয়ে অসাবধানতাবশত কাশ্মিরিদের ক্ষতি যাতে না করা হয়, সে ব্যাপারে নিজের নিশ্চিত করতে হবে। পাকিস্তানকে অবশ্যই সততার সাথে তার জনগণকে জানাতে হবে, ভারতের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নীতিগতভাবে একটি সমঝোতার পথে সঙ্কট সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। তবে এই সমঝোতা বা নিষ্পত্তি কাশ্মিরি জনগণের মতামতের ভিত্তিতে হতে হবে।

ভারত বিশ্বাসযোগ্যভাবে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে ‘সন্ত্রাসবাদে’ সহায়তা করছে বলে পাকিস্তানকে দোষারোপ করতে না পারলে তারা তাদের নির্যাতনকেও ‘সন্ত্রাস দমন’ হিসেবে বা বর্ণনা করতে পারবে না। তারা চিরদিনের জন্য কাশ্মিরে তাদের বর্বরতা চালিয়ে যেতে পারবে না। পাকিস্তানের কল্পনাশ্রয়ী ও দক্ষ কূটনীতি এবং উচ্চ মাত্রার নেতৃত্ব প্রয়োজন। পাকিস্তানকে এটাও স্পষ্ট করতে হবেÑ তারা ‘রেডলাইন’ অতিক্রম করবে না এবং ‘গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের’ ব্যাপারে কোনো আপস করবে না।

পরমাণু শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের জন্য একবিংশ শতাব্দীর একটি বার্তা হলো- সহযোগিতা অথবা ধ্বংস। সমুদ্র ক্রমান্বয়ে স্ফীত হয়ে উঠছে। ভূমি, পানি এবং কর্মসংস্থান থাকবে না। জনগণ পেরে উঠবে না। বৃদ্ধি পাচ্ছে সব ধরনের চাপ। যুক্তি এবং আধুনিকায়ন আত্মধ্বংসে পর্যবসিত হচ্ছে। এ ধরনের ধ্বংসাত্মকপ্রবণতাকে পাল্টে দিতে সহায়তা করলে কাশ্মির সঙ্কট সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং ইরাক ও সুদানে জাতিসঙ্ঘ মিশন প্রধান
ডন পত্রিকা থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement