২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার কেন?

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার কেন? -

একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সুসংহত করে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে অধীন সব নাগরিকের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস প্রয়োজন। তেমনি নাগরিকদের শতভাগ মর্যাদাসহ রাষ্ট্রের ওপর তাদের অধিকার নিশ্চিত করাও একই কারণে জরুরি। এর ব্যত্যয় যাতে না ঘটে তার জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়। আইন প্রণয়নের মূলভিত্তি দেশের নাগরিকদের বা জনগণের সম্মতি। পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষভাবে জনগণের সম্মতিতে আইন প্রণীত হয় বলে আইনপ্রণেতাদের জনপ্রতিনিধি বলা হয়। দেখা যাচ্ছে- যেকোনো আইন রাষ্ট্র দ্বারা প্রণয়ন করা হয় না। আইন প্রণীত হয় জনগণ অথবা তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা। রাষ্ট্র কোনো জনপ্রতিনিধি নিয়োগ করতে পারে না। তাদের নির্বাচিত করে জনগণ। এখানেই রাষ্ট্রের নাগরিক বা জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের গুরুত্ব বিদ্যমান। এ সুযোগ যে রাষ্ট্রে বা দেশে যত বেশি, সে দেশকে তত বেশি গণতান্ত্রিক বলা হয়। জনগণ সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগ বা প্রতিনিধি নির্বাচন করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধিকার না পেলে গণতান্ত্রিক বলা যায় কী করে? গণতন্ত্র প্রয়োজন অবশ্যই মানুষের মর্যাদা আর অধিকার রক্ষার জন্য। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের সমান সুযোগ নিশ্চিত হতে পারে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। সত্যিকার অর্থে, সমান সুযোগ বা সমতা না থাকলে গণতন্ত্র থাকে না। আবার গণতন্ত্র না থাকলে গণমানুষের মর্যাদাও থাকতে পারে না।

সব গণতান্ত্রিক দেশের ক্ষমতার উৎস দেশের জনগণ। জনগণকে পাশ কাটিয়ে ছলচাতুরির মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া অবৈধ ও অন্যায়। জনগণই নির্ধারণ করতে পারে বৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার বিষয়। জোর দিয়ে বলা যায়, কারো পক্ষে ক্ষমতায় থাকা বা আসা নির্ভর করে জনগণের ওপরই। যে পন্থা বা পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা বা আসার বিষয়টি জনগণ নির্ধারণ করে, সেটাই নির্বাচন। নির্বাচন এমনই গুরুত্বপূর্ণ যার সাথে দেশ, নাগরিক ও দেশ পরিচালনার বিষয় জড়িত। দেশের উন্নতি-অবনতি, দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্যও নির্বাচন একটি ফ্যাক্টর। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যময় হওয়াতে সমগ্র জাতির কাছে হয়ে উঠেছে অগ্রাধিকারের বিষয়। জাতি মনে করে, নির্বাচনের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রতিনিধি পাঠাবে স্থানীয় কিংবা জাতীয়পর্যায়ে। ওখানে কোনো ভয়-ভীতি, শঙ্কা বা বাধা দেয়া বৈধ হবে না।

সম্পূর্ণ স্বাধীন, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পছন্দ অনুযায়ী সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার সুযোগ থাকতে হবে। এ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। জাতির আকাক্সক্ষানুযায়ী সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই কমিশনের দায়িত্ব। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচেছ- নির্বাচন পরিচালনায় সরকার বা প্রশাসনের সহযোগিতা। সরকার যদি প্রশাসনকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না দেয়, তা হলে কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করার সময়ে কী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে? জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার, পুলিশ সুপার, ইউএনও এবং ওসিরা দলীয় লোক কিংবা সরকার সমর্থক হলে নিরপেক্ষতা থাকে না। তখন নির্বাচন হবে গুরুতর প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা তারাই রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার এবং ভোটের দিন নানা দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত থাকেন। এ কারণে প্রয়োজন নির্বাচনের সময়ে এমন একটি সরকার, যারা হবেন, নিরপেক্ষ, সাহসী এবং সৎ। ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর বর্তমান নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রথম আলোতে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ‘সিইসি, ইসি ও প্রসঙ্গ কথা’ শিরোনামের লেখাটি মূলত ২৩ নভেম্বর ২০১৭ প্রথম আলোতে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের ‘আমরা কবে সাবালক হবো?’

প্রবন্ধের জবাব

তিনি প্রবন্ধের তৃতীয়াংশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সংবিধান সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের বাইরে কোনো চিন্তা করতে পারে না এবং কোনো আইন বা সংবিধান সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের হাত বেঁধে দিলে তা সংবিধানসম্মত নয়।’ বর্তমানে আমাদের সংবিধানে যদি এমন কোনো বিধান সন্নিবেশিত থাকে, যে কারণে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করা যায় না, তা হলে তাকে কিভাবে গ্রহণ করা হবে? ১৯৫৪ সালের বিখ্যাত নির্বাচনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের দেয়া নির্বাচনী ইশতেহারের ২০ নম্বর দফাতে বলা হয়েছিল, ‘আইন সভা বা মন্ত্রিসভার মেয়াদ কোনো অবস্থাতেই বর্ধিত করা হবে না। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ছয় মাস আগেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে।’ এত বড় মাপের রাজনীতিবিদরাও ৬৪ বছর আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, জাতীয় সংসদ এবং মন্ত্রিসভা বহাল রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অন্তত এ দেশে সম্ভব নয়।

কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু কারো প্রতি যদি আইনের অপপ্রয়োগ হয় কিংবা ব্যত্যয় ঘটে অথবা জুলুম করা হয়, তা হলে এর নিরসন করা হবে কিভাবে? আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন। নির্বাচনকালে কেউ দুষ্টুমি বা অপকর্ম করবে না অথবা আইনবহির্ভূত কাজ করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে না- তার নিশ্চয়তা দেবে কে? আইন প্রণয়নকারী সংস্থা, নাকি প্রয়োগকারী সংস্থা? এসব সংস্থার নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার জন্যই প্রয়োজন সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে নির্বাচন দেয়া। একটি উন্নতমানের, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সমতল ক্ষেত্র বিদ্যমান থাকা। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর এবং সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করার ব্যবস্থা থাকায় সমতল ক্ষেত্র হওয়ার সম্ভাবনা নির্বাসিত হয়ে গেছে। এটি বর্তমান সরকারের মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ২০১২ সালের ২৫ জুন সংসদে দেয়া বাজেট বক্তৃতায়ও তুলে ধরেছিলেন। সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) অনুচ্ছেদ বলবৎ থাকলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনা করা কোনো নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। একই ধরনের মত প্রকাশ করেছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেনও। ২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তার কার্যালয়ে শেষ কর্মদিবসে বলেন, ‘বিদ্যমান অবস্থায় রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান খুবই কঠিন।’
লেখক : রাজনৈতিক সংগঠক


আরো সংবাদ



premium cement