২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পাশ্চাত্যের আধিপত্য নস্যাতে চীনা প্রকল্প

প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প -

প্রজেক্টটির নাম বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। সংক্ষেপে বিআরআই। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের এই প্রকল্পকে অনেকে ‘গেম চেঞ্জারও’ বলছেন। কেউ কেউ একে নতুন সিল্ক রোড নামেও অভিহিত করছেন। ইউরেশিয়াজুড়ে উচ্চগতির রেললাইন কিংবা মহাসড়ক, পাইপলাইন বা বন্দর কানেকটিভিটির গোলকধাঁধার চেয়ে অনেক বড় কিছু। অন্তত ৬৫টি অংশগ্রহণকারী দেশ, বিশ্বের ৬২ শতাংশ জনসাধারণ ও ৩১ শতাংশ জিডিপির সমন্বয়ে গড়া চীনা একটি জোটের প্রতিনিধিত্ব করছে এই নতুন সিল্ক রোড।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নামে পরিচিত এ উদ্যোগটি একটি ‘রাস্তা’ বা প্রাচীন সিল্ক রোডের সমাহার নয়। সাগর আর স্থলÑ উভয় পথেই এটি এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ আর ল্যাটিন আমেরিকাকে একই সুতোয় বাঁধবে। এটি আগামী তিন দশক ধরে চীনা পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকবে।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার যোগাযোগ কৌশল থেকে শুরু করে অবকাঠামো, অর্থব্যবস্থা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কিতি সব বিষয় মোকাবিলা করে বিআরআই চীনের রাজনৈতিক দর্শন জোরদার করার লক্ষ্যে প্রণীত।

প্রকল্পগুলো এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট আকার লাভ না করলেও কয়েকটি ইতোমধ্যেই ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। উদাহরণ হিসেবে চীন-কাজাখস্তান সীমান্তের খোরগোস স্থলবন্দর থেকে আলমাতি (কাজাখস্তান), তাসখন্দ, সমরকন্দ ও বুখারা (উজবেকিস্তান), তুর্কমেননাবাত (তুর্কমেনিস্তান) থেকে ইরানের মাশাদ ও তেহরান পর্যন্ত বিস্তৃত নতুন রেললাইনের কথা বলা যায়।
বিশ্বে চীন একমাত্র দেশ যার বাণিজ্য ও বিনিয়োগে প্রায় বৈশ্বিক কৌশল প্রণয়ন করেছে। ওয়াশিংটন যেটাকে আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা বলছে, বিআরআইয়ের মাধ্যমে কার্যত সেটিই রূপায়ন করছে চীন। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবেই বিআরআইয়ের ধারণাকেই গ্রহণ করে নেবে।

ফলে অ্যাঙ্গো-আমেরিকান দৃষ্টিকোণ থেকে এর সমালোচনা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ কারণেই বিআরআইকে নব্য-উপনিবেশবাদ ও ঋণ ফাঁদ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটি মালয়েশিয়ায় ‘মারা’ পড়েছে, শিগগিরই পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাতেও মারা পড়বে। আবার মালদ্বীপও পিছিয়ে আসতে পারে।

অথচ বাস্তবতা হলো- মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বিআরআইকে সুযোগ হিসেবে দেখছেন। কারণ এটি ইউরেশিয়ার সাথে সংযুক্ত হওয়ায় প্রতিটি নগরীরই থাকবে এ থেকে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাতে। বিআরআইয়ের দরকার কেবল প্রতিটি জাতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ চাহিদা নির্ধারণ করা। পাকিস্তানের ইমরান খান শুরুতে দ্বিধায় থাকলেও এখন তিনি জোরালোভাবে এর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শ্রীলঙ্কাও তেমন পিছিয়ে নেই।

ব্র্যান্ডের সম্প্রসারণ
বিআরআই এখন চীনা ব্র্যান্ডে মিশে গেছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙ যে গর্ব নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে ‘চীনা স্বপ্ন’ দেখছেন, বিআরআই সেটিকেই এগিয়ে নেয়ার একটি ব্র্যান্ড।

বেইজিংয়ের নেতৃত্ব দ্রুত কিছু বিআরআই শিক্ষা গ্রহণ করবে। কয়েকটি নির্বাচিত অবকাঠামো প্রকল্পকে মানসম্পন্ন করে গড়ে তোলার দিকে মনোযোগী হতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তানি কূটনীতিকরা মনে করছেন, সিপিইসি তথা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর এ ধরনেরই একটি প্রকল্প।

বেইজিংকে বিআরআইয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জনসাধারণের জন্য বাস্তব উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে, আর তা করতে হবে আরো স্বচ্ছভাবে। এ কারণে এশিয়া অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংককে (এআইআইবি) আরো ঘনিষ্ঠভাবে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাথে কাজ করতে হবে।

বিআরআইয়ের সমালোচনার আসল কারণ এটি পাশ্চাত্যের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক প্রাধান্যের অবসান ঘটাতে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত সাবেক সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রদূত কিশোর মাহবুবানি তার সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ ‘হ্যাজ দি ওয়েস্ট লস্ট ইট’-এ লিখেছেন, আইনের শাসনভিত্তিক নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হবে প্রাচ্যে। এতে আন্তর্জাতিক আইন অবশ্যই বদলে যাবে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্য কাঠামোতে চীন ও ভারতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
দাম্ভিক পাশ্চাত্যের পক্ষে কনফুসিয়ান বা হিন্দু জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ নয়। এর ফলেই আত্ম-পরাজয়ের বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে আমেরিকা। তারা নানাভাবে চীনা নেতৃত্বকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

উচ্চগতি ও গভীরতার ক্ষেত্র
সম্প্রতি পল ভিরিলিও বলেছেন, সম্পদ ও ক্ষমতার বণ্টনের অনিবার্য উপাদান হলো গতি। প্রতিটি ঐতিহাসিকপর্যায়ে পরিবহনের প্রধান মাধ্যমটিই সমাজ সংগঠনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রাচীন গ্রিস (এখানে জনপ্রিয় একটি কথা প্রচলিত ছিলÑ যে জাহাজ ভাসাবে, সেই নগরী শাসন করবে) থেকে সামন্তবাদের ভিত্তি ঘোড়ায় চড়া ও পুঁজিবাদের বিস্ফোরণের সময় রেললাইনের রাজত্ব পর্যন্ত এ কথা প্রযোজ্য। গতির সাথে চীনের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। তার নিজস্ব অর্থনৈতিক জাদুর কোনো ঐতিহাসিক নজির নেই। বিআরআই এখন হয়তো মন্থর গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, ভবিষ্যতে তা চীনের উচ্চগতির রেলের আবেশ ছড়িয়ে দেবে।

চীন নিজে ২০টি মেগা-নগর গঠন করছে। প্রতিটিতেই থাকবে কোটি কোটি লোক। পার্ল রিভার ডেল্টা শেনজেন ইতোমধ্যেই চীনের চতুর্থ অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক সব প্যাটেন্টের প্রায় অর্ধেক নিবন্ধিত হয়।

১৮ বিলিয়ন ডলারের ৫৫ কিলোমিটার লম্বা হংকং-ম্যাকাউ-ঝুহাই সেতুটি এখন ১৮০ মিনিটে হংকংয়ের চেক ল্যাক কক বিমানবন্দর থেকে শেনঝেনে চলে যায়। এটি গুয়াংঝু, ঝুনশান, ঝুহাই হয়ে শেষ পর্যন্ত ম্যাকাউ পৌঁছে। গ্রেট বে এরিয়া ১০টি নগরীকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে।
বেইজিংয়ে রয়েছে সাতটি রিং রোড। সর্বশেষটি জি৯৫ উদ্বোধন করা হয়েছে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে।

চীন একটি সভ্যতা-রাষ্ট্র হলেও বিআরআই হয়তো এর সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছে। ভিরিলিও জোর দিয়ে বলেছেন, বিশ্ব সমতল (এমনটিই দেখায়) হয়ে গেলে এর ক্ষেত্রের গভীরতা হারায়, আর মানুষ তার কর্মতৎপরতা ও চিন্তার গভীরতা হারিয়ে ফেলে। ফলে মানুষ হয়ে যায় দুই মাত্রিক। তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তবে বিআরআই যদি উচ্চগতির কানেকটিভিটির ওপর জোর দেয়, মানুষকে যদি তিন মাত্রিক করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে, কেবল ইউরেসিয়ান নয়, কার্যত বিশ্বের গভীরতা কোথায় যাবে?

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement