২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষক নিয়োগ ও বিস্তর অভিযোগ

শিক্ষক নিয়োগ ও বিস্তর অভিযোগ -

শিক্ষাকে বলা হয় ‘জাতির মেরুদণ্ড’। যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে জাতির ভিত। ভবনের ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, তাহলে তার টিকে থাকার ক্ষমতা কমে যায় এবং যেকোনো সময় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ধসে পড়তে পারে দুর্বল ভিতের ওপর নির্মিত ভবন। তাই প্রথমেই গুরুত্ব দেয়া হয় তার ভিতের ওপর। যেকোনো জাতির টিকে থাকতে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ছিটকে না পড়তে চাইলে প্রয়োজন, শিক্ষা। এ কারণেই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব প্রতিটি জাতির। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গন আগামী দিনের সমৃদ্ধ নাগরিকদের গড়ে তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত; যে শিক্ষা তাদের সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। আজকের শিশুরা প্রকৃত শিক্ষা পেলেই হতে পারবে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ নানান পেশাজীবী। শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, কবি ও সাংবাদিক তৈরি হবেন শিক্ষাঙ্গনেই। শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতির ক্ষেত্র। প্রায় সব দেশই সমাজের চাহিদা ও ভবিষ্যৎ সমাজকে সামনে রেখে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে।

বিশ্বে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বমানে উন্নীত করার কোনো বিকল্প নেই। মূলত ‘শিক্ষাই আলো, আর জ্ঞানই শক্তি’। সময়ের প্রয়োজনে সব কিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগা স্বাভাবিক। সব কিছুতেই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে আমাদের দেশেও। সে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায়। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা সেই ঔপনিবেশিক ধারার শৃঙ্খলেই আবদ্ধ। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সুনাগরিক তৈরি করতে বেশি সহায়ক হচ্ছে না। আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে এখনো বৈশ্বিক মানে ঢেলে সাজানো সম্ভব হয়নি। কারিকুলাম বিন্যস্ত হয়নি আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসাকে সামনে রেখে।

শিক্ষা খাতকে জাতীয় বাজেটে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়া হয়। শিক্ষার মান, দেশকে শতভাগ শিক্ষিতকরণ এবং শিক্ষার সাথে জড়িত শিক্ষকদের মানোন্নয়নের কথা চিন্তা করে সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে শিক্ষকদের বেতনভাতা ও মর্যাদা। এর পরও শিক্ষার্থীদের প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন এবং শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে হতাশাজনক চিত্র এসেছে জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের ফলে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, দায়িত্ব পালনে শিক্ষকরা প্রত্যাশা অনুযায়ী সফল নন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে যথাযথ প্রয়োগ করা হচ্ছে না প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। মাঠপর্যায়ের পরিদর্শনেও আছে অবহেলা। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতিসঙ্ঘের এসডিজি অর্জন, সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা, শিক্ষানীতি-২০১০ এবং সরকারের রূপকল্প-২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য গত আট বছরে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যেখানে ২০০ শিক্ষার্থী রয়েছে, শিক্ষক রয়েছেন পাঁচজন। শিক্ষকমণ্ডলী শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন পাঠ্যবই ও ব্ল্যাকবোর্ডের মাধ্যমে। এর বাইরে পাঠকে প্রাণবন্ত করতে মাঝে মধ্যে শ্রেণিকক্ষ ও বাইরে তারা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। পাঠকে শিক্ষার্থীর কাছে প্রিয় করে রাখতে তারা কিন্তু সনাতন কৌশলেই আটকে রয়েছেন। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ই-লার্নিং ব্যবস্থা আজো চালু করা সম্ভব হয়নি। এ পদ্ধতি মূলত সনাতনী পদ্ধতির বিপরীতে শিক্ষার্থীর পাঠকে আরো আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য করতে সহায়তা করে। শিক্ষকরা যেমন এখন শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত অনেক শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে সামলাতে হিমশিম খান। ই-লার্নিং শিক্ষকদের সে চাপ কিছুটা হলেও লাঘব করবে।

এই ই-লার্নিং শিক্ষাপদ্ধতি শিশুর সিলেবাসের বোঝা ও পরীক্ষাপদ্ধতিকেও সহজ করতে পারে। সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি শিশুকে মুখস্থ করার অভিশাপ থেকে রেহাই দেয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বাড়িয়েছে। বিদ্যালয়ে গিয়ে বড় পর্দায় পড়াশোনা করে বাড়িতে এসে সে যখন বই খুলে বসবে, তখন বইয়ের ভেতরে সব ছবি স্পষ্ট দেখতে পাবে। কমে আসবে মুখস্থ করার অহেতুক চাপ। কমে আসবে নোটবই ও প্রাইভেট টিউটর-নির্ভরতাও। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে। নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। কিন্তু শুধু বরাদ্দ বাড়া বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের মধ্য দিয়েই জাতির মেরুদণ্ড গঠনের প্রক্রিয়ার সফল সমাপ্তি হয় না। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের জন্য যুগোপযোগী পাঠ্যবই এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষক।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত অবস্থাও খুব বেশি সুবিধার নয়। শিক্ষার মানোন্নয়নে পরিবর্তন নিরূপণের যেসব নির্দেশক রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য বা যোগ্যতা। শিক্ষার মান উন্নয়নের চাবিকাঠি হচ্ছে, সর্বোত্তম শিক্ষক থেকে সর্বোত্তম শিক্ষা আদায় করে নেয়া। শিক্ষা ও শিক্ষাপদ্ধতির গুণগত মান কোনো অবস্থায় শিক্ষকদের গুণগত মান অতিক্রম করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব শিক্ষকদের যোগ্যতা ও পারদর্শিতার ওপর নির্ভর করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও যোগ্য ও পারদর্শী শিক্ষকের সংস্পর্শে এলে তাদের মেধা উন্নত হয়। ব্যানবেইস জানায়, ঢাকা জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় পাঠদানরত মোট শিক্ষক দুই লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩ জন। এর মধ্যে ৭১ হাজার ৭০২ জন শিক্ষক কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছেন। এ হিসাবে ঢাকা জেলায় প্রাথমিক পর্যায়ের ২৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিক্ষক এখনো অপ্রশিক্ষিত।

মফস্বলের অবস্থা কী হতে পারে তা এই পরিসংখ্যানেই অনুমেয়। প্রশিক্ষণহীন শিক্ষক পাঠদানে দুর্বল এবং বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করে থাকেন অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে এবং সেখানে শিক্ষক হিসেবে যারা রয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই যে প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করতে পারবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। এ দিকে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ভ্রান্ত নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে। নিয়োগকৃত শিক্ষকদের কারো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রিধারী নিশ্চিত করা হয়নি। আমাদের দেশে বিএ, এমএ এমনকি ডক্টরেট ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ দিয়ে মেধা ও অর্থের জাতীয় অপচয় হচ্ছে। অন্য দিকে শিশুদের ‘অখাদ্য ও কুখাদ্য’ খাওয়ানো হচ্ছে শিক্ষার নামে।

প্রযুক্তিজ্ঞানহীন শিক্ষকদের দিয়ে কোনো ই-লার্নিং চালু সম্ভব নয়। ই-লার্নিংয়ের জন্য প্রয়োজন বিস্তর গবেষণা। পর্যাপ্ত গবেষণা ছাড়াই এ শিক্ষাপদ্ধতিকে মাঝপথে ছেড়ে দিলে সেটি সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির মতোই অনেকাংশে অকার্যকর থাকবে। এ পদ্ধতি পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগে প্রয়োজন বিভিন্ন স্তরের গবেষণা।

এ কাজটি সুচারুভাবে করতে পারবেন আন্তর্জাতিক মানের চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রিধারী প্রযুক্তিবিদরা। আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার মধ্য দিয়েই মূলত বেরিয়ে আসবে কিভাবে ই-লার্নিং শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে। নয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দু-একটি ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর সরবরাহ করেই ‘প্রাথমিক বিদ্যালয় আইসিটির আওতায় চলে এসেছে’ বলে প্রচার চালানো হবে বিরাট বোকামি। শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। শিক্ষার গুণগত মান অনেকাংশেই নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর। এ জন্য শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়।

দেশ যখন টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে, সে লক্ষ্য পূরণের জন্য শিক্ষার প্রতিটি ধাপেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। ন্যূনতম চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রিধারী নিয়োগ করা নিশ্চিত করতে হবে। ছয় দশক আগে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গড়া প্রাইমারি শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫৬ থেকে বৃদ্ধি করে প্রতিটি উপজেলায় সরকারি-বেসরকারিভাবে একাধিক ইনস্টিটিউট অব প্রাইমারি টিচার্স প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

অপ্রতুল ১৮ মাসের ডিপ্লোমা কোর্স বাতিল করে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন কোর্স চালু করতে হবে। এর দায়িত্ব বিভাগীয় ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ডের ওপর ন্যস্ত করা যায়। আমরা চাইলে এখনই ইউরোপ-আমেরিকার মতো করে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরকে সাজাতে পারব না; কিন্তু আধুনিকায়নের কাজটি অবিলম্বে শুরু করতে হবে। একটি সুশিক্ষিত ও দক্ষ জাতি গড়তে হলে প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতেই হবে। তা শুরু করতে হবে প্রাথমিক স্তর থেকেই।
লেখকদ্বয় : সভাপতি ও মহাসচিব, ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল


আরো সংবাদ



premium cement