২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুর্বল জাতিসঙ্ঘের প্রয়োজন কতটুকু?

দুর্বল জাতিসঙ্ঘের প্রয়োজন কতটুকু? - ছবি : সংগৃহীত

মিশনের তদন্তে উঠে এসেছে যে, এসব মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের প্রধান হোতা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং এবং সাথে আরো পাঁচজন জেনারেল। তাদের নাম রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে- ধর্ষণসহ বিভিন্ন পন্থায় যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে, যা সত্যিকার অর্থেই পশুসুলভ। রাখাইনের ১০টি গ্রামে সেনাসদস্যরা নিজেরাই ব্যাপক হারে গণধর্ষণ করেছে, যা জেনারেলদের প্রত্যক্ষ নির্দেশ ছাড়া অসম্ভব

জাতিসঙ্ঘের সনদে প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতাবলে সেক্রেটারি জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেস সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি চিঠি লেখেন। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের দু’টি স্থায়ী ও শক্তিশালী সদস্য চীন এবং রাশিয়ার তীব্র বিরোধিতার কারণে আজ পর্যন্ত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। এ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকবার সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, গণধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদির অকাট্য প্রমাণ পেশ করা সত্ত্বেও মিয়ানমারের সাথে চীন ও রাশিয়ার গভীর ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদের কোনো স্থায়ী সদস্য যদি কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে, সে প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা সমর্থন করলেও তা কার্যকর করা সম্ভব নয়। সে প্রস্তাব নাকচ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মাও সেতুং এবং লেনিনের দেশ আজ বিপন্ন মানবতার প্রতি তাদের নীতিগত প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে বসেছে। চীন নিজেই বিংশ শতাব্দীর একটি নির্যাতিত ও নিপীড়িত দেশ। প্রায় ২৭ মিলিয়ন চীনাকে বিংশ শতাব্দীতে হত্যার শিকার হতে হয়েছিল। এক বিংশ শতাব্দীতে এসে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ হতে সক্ষম হয়েছে।

তাতে বিশ্বের সমস্ত নিপীড়িত মানুষ গর্বিত এবং আনন্দিত। আজ রোহিঙ্গাদের ওপর এই অমানবিক ও বর্বর অত্যাচারের মর্মবেদনা চীনেরই সব চাইতে বেশি উপলব্ধি করা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারকে রক্ষা করার যে, চীনা অপপ্রয়াস, তাতে চীনের প্রতি সংবেদনশীল বিশ^ বিবেক মর্মাঘাত পেয়েছে। সেদিনের কথা, চীনের নেতা মাও সেতুং, নীতির ব্যাপারে তদানীন্তন বিশে^র শক্তিশালী দেশ ও সমাজতন্ত্রী হলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আপস করেননি। ১৯৬০ সালের পর থেকে চীন সীমান্তে সোভিয়েত রাশিয়া সৈন্য সমাবেশ করেছিল এবং তা প্রায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। বিংশ শতাব্দীতে নিগৃহীত চীনের প্রতি বিশ^ব্যাপী জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সহানুভূতি রয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাদের ওপর এ নির্মম অত্যাচারের পর চীনের যে ভূমিকা, তা বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত করেছে। দুঃখের বিষয় আজ চীন এবং রাশিয়া এক সাথে আদর্শচ্যুত হয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এসব কর্মকাণ্ডকে জাতিগত নিধন (Ethnic Cleansing) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। জাতিগত নিধনের অপরাধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যদের যদি বিচার না হয়, জাতিসঙ্ঘই বিশ্ববাসীর কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়বে এবং তার ফলে বিশ্বব্যবস্থার প্রতি যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হবে, তাতে মানবজাতির ভয়াবহ অকল্যাণ হতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্ব নেতারা এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো অং সান সুকিকেও এ গণহত্যার জন্য দায়ী করেছেন। কারণ সরকারপ্রধান হিসেবে রোহিঙ্গাদের ওপর এ ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, নারী নির্যাতন এবং মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে তার কোনো পদক্ষেপ নেয়ার প্রমাণ নেই। বরং তার নেতৃত্বে সরকারের বেসামরিক অংশ এ গণহত্যায় অহরহ উসকানি দেয়ার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল গুতেরেস গত জুলাইয়ের শেষের দিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অকথ্য নির্যাতন, গণহত্যা ও ধর্ষণের একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক বিবরণী পেশ করেছেন। সফরের দুই মাস আগে নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো নিজেরাই পরিদর্শন করেছিল এবং তারা নিউ ইয়র্কে ফিরে গিয়ে ৯ মে বিবৃতি দেন। তাতে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী সব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ওই প্রতিনিধিদলে চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিরা ছিলেন। কিন্তু এরপর দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। জাতিসঙ্ঘের সর্বাধিক শক্তিশালী ফোরাম নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা মানবতাবিরোধী জঘন্যতম অপরাধের ব্যাপারে যদি- ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ নীতি গ্রহণ করে, সে ক্ষেত্রে বিশ্ববাসী এই জাতিসঙ্ঘের প্রতি কতটুকু আস্থা রাখতে পারে তা ভাবার বিষয়।

এর আগে রুয়ান্ডা এবং বসনিয়াতে সঙ্ঘটিত গণহত্যার ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে আফ্রিকার রুয়ান্ডায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতুরা প্রায় আট লাখ সংখ্যালগিষ্ঠ তুতসিদের হত্যা করেছিল। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ এ ব্যাপারে কোনো শাস্তি দিতে সক্ষম হয়নি। আবার ১৯৯৫ সালে আট হাজার বসনিয়ান মুসলমানের ওপর গণহত্যা চালানো হলো, কিন্তু তাতেও জাতিসঙ্ঘ কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোতে যদি কোনো মৌলিক পরিবর্তন না আসে তাহলে এ দুর্বল আর মেরুদণ্ডহীন জাতিসঙ্ঘের দ্বারা বিশ্বে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে শক্তিহীন এই জাতিসঙ্ঘের কিইবা প্রয়োজন? যা হোক, জাতিসঙ্ঘের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল মিয়ানমারে গণহত্যায় লিপ্ত, ঘাতকদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তার সীমিত ক্ষমতা নিয়েও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল তিন সদস্যের একটি মিশন গঠন করেছিল। জাতিসঙ্ঘের এই মিশনের প্রধান করা হয় ইন্দোনেশিয়ার প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল মার্জুকি দারুসমাকে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ব্যাপক তদন্তের পর তারা রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন, যা বিশে^র সর্বমহলে একটি স্বচ্ছ, ব্যাপক (Comprehensive) এবং সত্যনিষ্ঠ রিপোর্ট বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ পর অভিযুক্ত মিয়ানমারের জেনারেলদের ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থার কথা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও প্রকাশিত হয়েছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে ব্যাপক সাক্ষাৎকার এবং স্যাটেলাইট ফুটেজের সাহায্যে মিশনের সদস্যরা একটি ব্যাপক তদন্তের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী সব অপরাধের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। অগণিত শিশু হত্যা, দাসত্ব, গ্রামের পর গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা বিস্তারিতভাবে করেছেন বর্ণনা। মিশনের তদন্তে উঠে এসেছে যে, এসব মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের প্রধান হোতা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং এবং সাথে আরো পাঁচজন জেনারেল। তাদের নাম রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে- ধর্ষণসহ বিভিন্ন পন্থায় যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে, যা সত্যিকার অর্থেই পশুসুলভ। রাখাইনের ১০টি গ্রামে সেনাসদস্যরা নিজেরাই ব্যাপক হারে গণধর্ষণ করেছে, যা জেনারেলদের প্রত্যক্ষ নির্দেশ ছাড়া অসম্ভব। এক সাথে ৪০ জন নারীকেও ধর্ষণ করার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement
কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেভাবেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে : কৃষিমন্ত্রী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪ ভান্ডারিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে দর্শনার্থীদের ঢল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু

সকল