২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইদলিবের যুদ্ধাবস্থা নিরসনে তুরস্কের ভূমিকা

ইদলিবে যুদ্ধ : কী করছে তুরস্ক? - ছবি : সংগৃহীত

বর্তমান বিশ্বের নজর কোনো না কোনো কারণে তুরস্কের ওপরেই থাকছে। বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা দেশটির দিকে বর্তমান বিশ্বের নজর ইদলিব সঙ্কট নিয়ে। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপ সাত বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। বিভিন্ন দেশ ও গোষ্ঠীর সমর্থনপ্রাপ্ত এসব বিদ্রোহীদের রাশিয়া ও ইরানকে সাথে নিয়ে সিরিয়া বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করছে। যদিও দীর্ঘ দিন থেকে চলমান এ গৃহযুদ্ধের ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়েছে। বর্তমানে সিরিয়ার আসাদ ও তার মিত্র বাহিনী দেশটির বেশির ভাগ এলাকা দখলে নিয়েছে। যার ফলে বিদ্রোহী বিভিন্ন গোষ্ঠী শেষ আশ্রয় হিসেবে ইদলিব প্রদেশে অবস্থান নিয়েছে।

ইদলিবের বেশির ভাগ এলাকা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। আলকায়েদা সমর্থিত জিহাদি গ্রুপ হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস, যাদের আগে বলা হতো আল-নুসরা ফ্রন্ট)। এইচটিএস ইদলিবের ৬০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া, ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা এনএলএফ ও ন্যাশনাল আর্মিসহ আরো কয়েকটি গ্রুপ এই এলাকায় সক্রিয়। ইদলিবের মোট জনসংখ্যা ৩০ লাখের অধিক, যাদের মধ্যে ১০ লাখই শিশু। এখানকার বেসামরিক নাগরিকদের অর্ধেকের বেশিই এসেছে একসময় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে।

যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে সিরিয়ার অন্যান্য এলাকার থেকে তারা পালিয়ে এসেছে অথবা তাদের এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। যদি বাশার বাহিনী এখানে বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালায় তাহলে বেসামরিক নাগরিকদের রক্তের বন্যা বইবে। বিদ্রোহীদের পর সরকারি বাহিনী হামলা চালালে আবারো লাখ লাখ সিরিয় নাগরিক তুরস্কে ঢুকে যাবে। তুরস্কে ৩০ লক্ষাধিক সিরিয় নাগরিক শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় যদি আবারো তুরস্কের সীমান্তসংলগ্ন অংশে হামলা হয় তাহলে আবারো আট লাখ সিরিয় নাগরিক উদ্বাস্তু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসঙ্ঘ। আর এসব কারণেই ইদলিবে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা না চালানোর জন্য আঙ্কারা থেকে বারবার বলা হচ্ছে।

ইদলিব প্রদেশের উত্তরে রয়েছে তুরস্কের সীমান্ত। আর দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি অংশজুড়ে রয়েছে আলেপ্পো থেকে হামা হয়ে রাজধানী দামেস্ক যাওয়ার মহাসড়ক। আর এর পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগরের উপকূলীয় শহর লাটাকিয়া। অবস্থানগত কারণে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ইদলিব যদি সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হাতে চলে আসে তাহলে সিরিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি ক্ষুদ্র অঞ্চল বাদে আর কোথাও বিদ্রোহীদের ঘাঁটি থাকবে না। এসব কারণেই আসাদ ও তার মিত্র বাহিনী ইদলিবে সামরিক অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই রাশিয়া ইদলিবের বিভিন্ন এলাকায় বোমা হামলা চালিয়েছে। যার ফলে বেসামরিক লোকেরা সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকা ছাড়তে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে তুরস্ক পশ্চিমা জোট এবং সিরিয়ার মিত্র রাশিয়া ও ইরানের সাথে কূটনীতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ইরানের তেহরানে তিন জাতির আলোচনায় ইদলিবের বিষয়টি মুখ্য আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান সিরিয়ার মিত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে আলোচনায় ইদলিবে হামলা না চালানোর ব্যাপারে কথা বলেছেন। হামলা চালানো হলেও শুধু এইচটিএস নিয়ন্ত্রাধীন এলাকায় হামলা চালানোর কথা বলেছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। কিন্তু রাশিয়া ও ইরান এরদোগানের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। এরপর এরদোগান ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে উপসম্পাদকীয় প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্ব মহলে দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। ইদলিবে আসন্ন হামলা বন্ধের জন্য বাশার আল-আসাদ ও বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানান। ইদলিবে হামলা না চালানোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি বাশার আল-আসাদকে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইদলিব সঙ্কট নিয়ে দু’বার বৈঠক করেছে। এরই মধ্যে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইদলিবে নির্বিচারে বোমা হামলাকে যুদ্ধাপরাধের সামিল বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

এই মুহূর্তে সবার দৃষ্টি তুরস্কের দিকে। কারণ তুরস্কই একমাত্র দেশ যে পশ্চিমা গোষ্ঠী এবং রাশিয়া ও ইরানের সাথে ইদলিবে হামলা থামিয়ে দেয়ার ব্যাপারে একযোগে আলোচনা চালাতে পারে। যার ফলে অনেক পর্যবেক্ষক ইদলিব সঙ্কটের ব্যাপারে তুরস্ককেই শেষ ভরসা মনে করছেন। ইদলিব সঙ্কট নিয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তুরস্ক পশ্চিমা সরকারগুলোর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে এই সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যায়। তুরস্কের কূটনীতিকেরা একই সাথে রাশিয়ার সাথে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। লাখ লাখ সিরিয় নাগরিক তাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বিগ্ন রয়েছেন। তারা এখন জীবন মৃত্যুর মধ্যখানে অবস্থান করছেন। যদি ইদলিব সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে না হয় তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা একমাত্র সময়ই বলে দিতে পারে।

তুর্কি কর্তৃপক্ষ বাশার আল-আসাদের ইদলিবে সামরিক হামলা বন্ধের ব্যাপারে কূটনীতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এরদোগান মনে করেন, ইদলিবে সামরিক হামলা চালানো হলে এর ফলাফল খুবই মারাত্মক হবে। সিরিয়া ও তার মিত্র বাহিনীর সাথে এই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন অবস্থানে থাকলেও জার্মানি ও ফ্রান্সের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। তিনি মনে করেন, কূটনীতিক প্রচেষ্টার ফলে ইদলিব পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হলেও তা সন্তোষজনক নয়। সিরিয়ার বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে তুরস্ক। তেহরান সামিটে এরদোগান বলেছেন, আমরা সিরিয়ায় আমাদের দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন করেছি। আফরিন ও জারবালুসে আমাদের পদক্ষেপ খুবই স্পষ্ট।

আমরা সেখানে সব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর পাশাপাশি ইদলিবেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। ইদলিবে তুরস্কের ১২টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, রাশিয়ার ১০টি ও ইরানের কয়েকটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে নিরাপরাধ বেসামরিক লোকদের সহায়তা করে আসছে।
জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে, সাম্প্রাতিক সময়ে আসাদ বাহিনী ও রাশিয়ান বিমানবাহিনীর বোমা হামলার ফলে ইদলিব থেকে ৪০ হাজার বেসামরিক লোকজন পালিয়েছে। পূর্ণ সামরিক অভিযান শুরু হলে এই পালিয়ে যাওয়ার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

তেহরানে তিন জাতির আলোচনায় ইদলিব সমস্যার সমাধান না হওয়ায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো তিনটি পয়েন্ট সামনে নিয়ে এসেছেন। এক. তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যকার সমাঝোতা না হওয়ার ফলে আস্তানা চুক্তি ভেঙে যাবে। দুই. তুরস্ক রাশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগ দেবে। তিন. এটা এখনো অস্পষ্ট যে, হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) ও অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সাথে কিভাবে যুদ্ধ করা হবে।

ওয়াশিংটন ও ইউরোপীয় দেশগুলো ইদলিবে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। তারা ইদলিব সমস্যা সমাধানে তুরস্কের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। তুরস্ক ইদলিবের সমস্যা সমাধান করতে সিরিয়া ও তার মিত্রবাহিনীর সাথে কোন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে, সেই দিকেই এখন সমগ্র বিশ্বের নজর।
farhanjnu12@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement