বাজপেয়ির স্বপ্ন
- হামিদ মীর
- ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২০:০০, আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৫৩
তিনি ছিলেন স্বপ্নবাজ মানুষ। কেননা, তিনি ছিলেন একজন কবি। কবি ও রাজনীতিবিদ অটল বিহারি বাজপেয়ি সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা ইতিবাচক ছিল না। চার দশক আগে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর If I Am Assassinated গ্রন্থে আমি তার সম্বন্ধে কয়েকটি লাইন পড়ি। ভুট্টো এ গ্রন্থটি রাওয়ালপিন্ডি সেন্ট্রাল জেলে বসে লিখেছিলেন। এ গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি ১৯৭৮ সালে ভুট্টোর আইনজীবী গোপনে লন্ডন নিয়ে যান এবং এটি ভারত থেকে প্রকাশ করা হয়। ১৯৭৮ সেই সাল, যে বছর অটল বিহারি বাজপেয়ি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথম পাকিস্তান সফর করেন, ওই সময় জেনারেল জিয়াউল হক ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং ভুট্টো তখন নীরবে-নিভৃতে কারাগারে বসে বই লিখছিলেন। বহু বিশ্বনেতা পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসকের কাছে ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড স্থগিতের আবেদন করেছিলেন, তবে বাজপেয়ি তার পাকিস্তান সফরে ভুট্টো সম্বন্ধে কোনো কথাই বলেননি। ভুট্টো তার গ্রন্থে বাজপেয়ির সমালোচনা করেন এবং তাকে একজন মুসলিমবিরোধী নেতা বলে আখ্যায়িত করেন, যিনি চীন-পাকিস্তানের সংযোগস্থল কারাকোরাম মহাসড়ক নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ১৯৯৮ সালের কথা, যখন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির নির্দেশে ভারত পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, আমি ওইসব পাকিস্তানির একজন, যে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কাছে তাগিদ দিলাম বাজপেয়িকে অনুসরণ করুন এবং দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক সমতা তৈরি করুন।
বাজপেয়ির সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ লাহোরে। ওই সময় তিনি পাকিস্তানে বাসে চেপে এসেছিলেন। তার দ্বিতীয় পাকিস্তান সফর পুরো পাকিস্তানকে রোমাঞ্চিত করেছিল। লাহোর দুর্গে তার সম্মানে এক বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। বাজপেয়ি যখন পৌঁছেন তখন আমাকেসহ বহু সাংবাদিক, লেখক, কবি ও গায়কের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। তিনি তার চেহারায় মিষ্টি হাসি দিয়ে আমার সাথে করমর্দন করেন। হাতটি তার চেহারার মতো কোমল ছিল। তিনি আমাদের সবাইকে তার ভাষণ দিয়ে যে ধারণা দিলেন, তাতে বোঝা গেল- তিনি এর মাধ্যমে আমাদের শান্তির বার্তা দিলেন। তিনি বিজেপির মধ্যপন্থীরূপে আবির্ভূত হলেন। নওয়াজ শরিফ বাজপেয়িকে বিশাল সম্মাননা দিলেন এবং বললেন, তিনি পাকিস্তানে নির্বাচনে জয়ী হবেন। দুর্ভাগ্য, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কারগিল যুদ্ধ শুরু হয় এবং নওয়াজ শরিফ ও বাজপেয়ির যৌথ সমন্বয়ে তৈরি সুনাম ভেঙে খান খান হয়ে যায়। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে ক্ষমতায় এলেন এবং একটি ভারতীয় বিমান হাইজ্যাক হয় ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে। প্রতিবেশী দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানের সাথে দূরত্ব কমিয়ে আনতে বাজপেয়ির পক্ষ থেকে ২০০১ সালের আগ্রা সম্মেলন ছিল আরেকটি প্রচেষ্টা। তবে ওই সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে আমি তাজমহলের সামনে হতাশ হৃদয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবং কিছু উগ্রপন্থী হিন্দুর পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান শুনছিলাম।
২০০৩ সালে বাজপেয়ি শ্রীনগর সফর করেন এবং বলেন, ‘বন্দুক সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারে না, বরং ভ্রাতৃত্ববোধে এটি সম্ভব।’ আমি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহার সাক্ষাৎকার নিতে চেষ্টা করি। আমি ইসলামাবাদের ভারতীয় হাইকমিশন থেকে ভিসা লাভ করি এবং কলম্বো হয়ে নয়াদিল্লি পৌঁছি। যশোবন্ত সিনহার সাথে আমার সাক্ষাৎকারটি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে জমাটবদ্ধ সম্পর্কের বরফ গলাতে শুরু করে। আমাকে ভারতের বহু দফতর ব্যক্তিগতভাবে জানায়, প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির ইচ্ছাতেই যশোবন্ত সিনহার সাথে আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণের অনুমতি প্রদান করা হয়।
বাজপেয়ির সাথে আমার দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ ঘটে ২০০৪ সালে, তার তৃতীয় পাকিস্তান সফরে। তিনি ইসলামাবাদে হোটেল সেরেনাতে অবস্থান করছিলেন। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী শওকত আজিজ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অভ্যর্থনার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। শওকত আজিজ আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। আমি তার মাধ্যমে অটল বিহারি বাজপেয়ি সম্পর্কে অনেক তথ্য লাভ করি। তিনি আমাকে বলেন, ‘বাজপেয়ির মেজাজ বেশ ভালো।’ বাজপেয়ি শওকত আজিজকে তার 21 Poems গ্রন্থ লতা মুঙ্গেশকরের গানের একটি সিডিসহ উপহার দেন। শওকত আজিজও তাকে নূরজাহান, নুসরাত ফতেহ আলি খান, মেহেদি হাসান, গুলাম আলি, ইকবাল বানু ও নায়রা নূরের সিডি উপহার দেন। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ও অটল বিহারি বাজপেয়ি ওই সফরে বিখ্যাত ইসলামাবাদ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। এক সন্ধ্যায় আমি শওকত আজিজকে আমার টিভি টকশোতে বাজপেয়ি সম্পর্কে কথা বলতে আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি বাজপেয়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। শওকত আজিজ বাজপেয়ির সাথে তার হোটেলে দুই ঘণ্টা ধরে অস্ট্রেলিয়া-ইন্ডিয়া ক্রিকেট খেলা দেখেন। তিনি দেখেন ক্রিকেট সম্বন্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জানাশোনা তার চেয়েও বেশি। বাজপেয়ি যখন পাকিস্তান ত্যাগ করেন, তখন তিনি স্পষ্টত মোশাররফকে বলেন, ‘শওকত আজিজ তার ভালো যত্ন নিয়েছেন এবং তিনি আপনার ভবিষ্যৎ তারকা।’ কয়েক মাসের মধ্যেই মোশাররফ জাফরুল্লাহ জামালিকে সরিয়ে দেন এবং শওকত আজিজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।
অটল বিহারি বাজপেয়ি জানতেন, বহু পাকিস্তানি ও হিন্দুস্তানির দ্বিতীয় ভালোবাসা হচ্ছে ক্রিকেট। তার বাস কূটনীতি ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যর্থ হয়, তবে তিনি ২০০৪ সালের মার্চে ক্রিকেট কূটনীতি সফলভাবে সূচনা করেন। আমার এখনো মনে আছে, পাকিস্তান আসার আগে বাজপেয়ি ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ক্যাপ্টেন সৌরভ গাঙ্গুলিকে বলেন, ‘খেলাও জিতবে, হৃদয়ও জিতবে।’ তিনি পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে তার স্তরকে উন্নত করতে চেষ্টা করেন। কাশ্মির সঙ্কট বিষয়ে তার তিন দফা নীতি পাকিস্তানিদের এ বার্তা দেয় যে, তিনি পাকিস্তানিদের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি বলেন, মানবতা ও গণতন্ত্র কাশ্মির-জাতীয়তাবাদসহ সব সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একমাত্র ব্যক্তি নন, যিনি বাজপেয়ির দুঃখজনক মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠান। অনেক পাকিস্তানি ও কাশ্মিরি নেতাও বাজপেয়ির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। কাশ্মিরি নেতা মীর ওয়াইজ উমর ফারুক টুইট বার্তায় জানান, ‘বাজপেয়ির মৃত্যুবার্তা শুনে তিনি শোকাহত। বাজপেয়ি ছিলেন একজন দুর্লভ ভারতীয় নেতা, যিনি সংবিধানের সীমার বাইরে মানবতার বিস্তৃত পরিসরে কাশ্মির সমস্যার বিষয়ে মানবতাবাদী নেতা ছিলেন।’ মিরওয়াইজের সাথে যে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারে, তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বাজপেয়ি হাতেগোনা কয়েকজন ভারতীয় নেতার একজন, যিনি শ্রীনগরের মানুষের কাছে সমাদৃত। পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে যখন চুক্তি হয়, তখন বাজপেয়ি তার বিরুদ্ধে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু আজ আমেরিকা ভারতের সাথে চুক্তি সম্পাদন করছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানি ও হিন্দুস্তানির পছন্দসই বাজপেয়ির লালিত স্বপ্নগুলোকে পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। বাজপেয়ি এ জগৎ ছেড়ে চলে গেছেন, তবে তার স্বপ্ন ও কবিতা এখনো আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। তিনি পাকিস্তানের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও ইমরান খান সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন। এটাই হবে তাকে শ্রদ্ধা জানানোর উত্তম পন্থা। আসুন, আমরা নতুন প্রচেষ্টা শুরু করি। আসুন, আমরা অবশেষে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ শুরু করি। যদি বাজপেয়ি ২০০৪ সালে এটা পেরে থাকেন, তাহলে ২০১৮ সালে মোদি এটা পারবেন না কেন?
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর : ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা