১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিমসটেক : চাই প্রযুক্তি দক্ষতায় মনোনিবেশ

বিমসটেক সম্মেলনের মঞ্চে নেতৃবৃন্দ - ছবি : এএফপি

নতুন বিশ্বব্যবস্থায় যে কাঠামো গড়ে উঠছে, তাতে করে আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক সংস্থার প্রয়োজন বাড়ছে। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের ফলে প্রতিরক্ষা সংস্থার গুরুত্ব অনেকাংশে হ্র্রাস পেয়েছে এবং তার স্থলে অর্থনৈতিক আঞ্চলিক সংস্থা গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে কোনো দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা এবং প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর জন্য আঞ্চলিক জোটগুলোই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে গঠিত হয়েছে আসিয়ান, অ্যাপেক, সার্ক প্রভৃতি আঞ্চলিক সংস্থা।
বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ৬ জুন ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া-থাইল্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন বা বিসটেক (BISTEC)। ডিসেম্বরে মিয়ানমার এই সংস্থায় যোগ দিলে M  যোগ করে নতুন নাম রাখা হয় বিমসটেক (BIMSTEC)। ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালের প্রথম দিকে নেপাল ও ভুটান এই সংস্থায় যোগ দেয়। তখন বিমসটেকের নাম বারবার পরিবর্তিত হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ৩১ জুলাই ২০০৪-সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলনে সংস্থার নাম পরিবর্তন না করে নামের অর্থের পরিবর্তন করা হয়। পাঁচটি দেশের আদ্যাক্ষরের বদলে নতুন নামকরণ হয়-Bay of Bengal (B) Initiative (I) for Multi (M) Sectoral (S) Technical (T) and Economic (E) Co-operation (C)-এতে সংক্ষিপ্ত নাম বিমসটেক (BIMSTEC) অপরিবর্তিতই থাকে। আগে মূলত অর্থনৈতিক বিষয়টির কথা উল্লেখ করা হলেও এখন এর তৎপরতা বহুমুখী।

এই সংস্থার সদস্য পদে আগ্রহী রাষ্ট্রগুলোর আঞ্চলিক অবস্থান ও বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য ও পরিবহনের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যারা অবদান রাখছেন, তারাই কেবল সদস্যপদ গ্রহণের জন্য বিমসটেকের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করতে পারবেন। বিমসটেকের সব সদস্যের অনুমোদনক্রমে নতুন কোনো সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান এ সাতটি দেশ বিমসটেকের সদস্য। তাদের মিলিত আয়তন ৫০ লাখ বর্গকিলোমিটার এবং এ অঞ্চলের লোকসংখ্যা ১৩০ কোটি। কিন্তু দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যের আদান-প্রদানের পরিমাণ মাত্র ৭৩০ কোটি মার্কিন ডলার, যা মোট বাণিজ্যের শতকরা চার ভাগ মাত্র।

গত ২০ বছরে বিমসটেকের চারটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিমসটেকের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলোÑ দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার চিহ্নিত ক্ষেত্রগুলো বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, পর্যটন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, পরিবহন ও যোগাযোগ, ওষুধ, বস্ত্র, চামড়া, কৃষি প্রভৃতি খাতে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প গ্রহণ করা। ২০ বছর আগে যাত্রা শুরু করলেও সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এখনো কার্যকর অর্থনৈতিক ভূমিকা গড়ে ওঠেনি। বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে আদিবাসীরূপে পরিচিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গুরুত্ব লক্ষণীয়। নিজস্ব রীতি, সংস্কৃতি যাপনের ধারা আঁকড়ে তাদের বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকা। বিমসটেকের দেশগুলোতে প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। তারা বিমসটেকের জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ হলেও মোট দারিদ্র্য হারের ১৫ শতাংশ।

সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ভূমি ও চাষাবাদব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও মৌলিক অধিকার তথা আর্থসামাজিক উন্নয়ন ছাড়া বিমসটেকের সফলতা এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে।
কর্মসংস্থানমুখী ডিপ্লোমা শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদেরও সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। বিমসটেকের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ কিশোর-কিশোরী। তারা বিভিন্নভাবে অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে পড়েছে।

একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবার তৈরি হচ্ছে। আবাসন সঙ্কট বাড়ছে। বস্তিবাসী ও বেকারত্ব বাড়ছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশিক্ষা বাড়ছে। সমাজজীবনে বাড়ছে হতাশা, নৈরাজ্য ও অপসংস্কৃতি। চুরি, ছিনতাইসহ অপরাধ বাড়ছে। জোরপূর্বক শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবারে আবেগ, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে। হতাশাগ্রস্ত কিশোর ও তরুণরা অসৎ পথে পা বাড়াচ্ছে।

বাবা-মা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি অবাধ্যতার ফলে পারিবারিক শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। জনগণের আর্থসামাজিক বিঘœ ঘটছে। শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার ফলে নারী শিক্ষার অবনতি ঘটে এবং বাল্যবিয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। মাদকাসক্তি ও যৌন অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। শিশু কিশোরদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হওয়ার ফলে দেশ, জাতি ও সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।

বিমসটেকের সদস্য দেশগুলোতে এসব অপরাধ আরো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। দারিদ্র্য, যৌতুক, অশিক্ষা, সামাজিক রীতিনীতি, কুসংস্কার বাল্যবিয়ের পুরনো কারণ হলেও এখন তা নতুন রূপে হচ্ছে। পারিপার্শ্বিকতার ভয়ানক ছোবল ইভটিজিং, যৌন হয়রানি ও নারীদের নিরাপত্তাহীনতাও প্রকট আকার ধারণ করছে। অনেকের মতে কর্মে প্রবেশের প্রযুক্তিমুখী শিক্ষা দিয়ে কর্মে নিয়োগ দিলে বাল্যবিয়ে এবং অপরাধপ্রবণতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

বিমসটেকের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সংশ্লিষ্ট দু’টি রাষ্ট্রে রোহিঙ্গা সঙ্কট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। এটি বিশ্বের মারাত্মক মানবিক সঙ্কটগুলোর একটি। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা, যাদের বেশির ভাগই মুসলিম, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বর্বর নিপীড়ন ও জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানকে জাতিগত নিধনের উদাহরণ বলেছে খোদ জাতিসঙ্ঘ।

আঞ্চলিক সংস্থা গঠনের মূলত দু’টি উদ্দেশ্য থাকে : পারস্পরিক সহায়তা এবং কোনো সদস্য দেশ বিপদে পড়লে অন্যান্য দেশের এগিয়ে আসা। এটি আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আসিয়ানের ক্ষেত্রে দেখেছি।

রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ এখন গভীর সঙ্কটে। কিন্তু এ ব্যাপারে সহযোগিতা সংস্থা বিমসটেকের কোনো ভূমিকা লক্ষ করা যাচ্ছে না। শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই শিশু। শিশুর সুশিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে ওঠার জন্য এবং তাদের মনন ও মেধা বিকাশের জন্য প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সমাজ বা রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা উচিত। বিমসটেক সদস্য দেশগুলোর প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রিধারীদের নিয়োগনীতি অনুসরণ না করার কারণে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য পূর্ণ হচ্ছে না।

শিক্ষা সম্পদের ওপর নির্ভরশীল নয়। প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ যথেষ্ট আছে। পানি, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, পাথর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এবং পর্যটকদের জন্য বরাবরই আকর্ষণীয়। পর্যটনশিল্পকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করা যায়। এ ক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের চাহিদামাফিক পর্যটনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কমপক্ষে ডিপ্লোমা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। কোনো অঞ্চল বা কোনো দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি হলো মানবসম্পদের উন্নয়ন। সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে মানবসম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে কোনো দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব।

কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনা করেই বিশেষ কোনো দিবসের উৎপত্তি ঘটে, যা প্রতি বছর নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে ডিপ্লোমাকে গুরুত্ব দিয়ে ২৫ নভেম্বর পালন করা হয় বিশ্ব ডিপ্লোমা শিক্ষা দিবস। বিমসটেকের সাতটি দেশে আঞ্চলিক ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হলে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে ১০টি সরকারি-বেসরকারিভাবে কৃষি, ভেটেরিনারি, লেদার, পলিটেকনিক, টেক্সটাইল, মেডিক্যাল টেকনোলজি, নার্সিং, ইনস্টিটিউট অব প্রাইমারি টিচার্স, মেডিক্যাল ও ডেন্টাল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হতে পারে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা তখন নিজ বাড়িতে থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা শিক্ষার সুযোগ পাবে।

কৃষি ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করে এক ফসলি জমিকে দু-ফসলি, দু-ফসলি জমিকে তিন ফসলি, তিন ফসলি জমিকে চার ফসলি জমিতে পরিণত করে দ্বিগুণের বেশি ফসল উৎপন্ন করতে পারবে। ভেটেরিনারি ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা পশু, পোলট্র্রি ও দুগ্ধশিল্পে বিপ্লব ঘটাবে। লেদার, পলিটেকনিক ও টেক্সটাইল ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা লেদারশিল্পকে পরিণত করবে বহুমাত্রিক শিল্পে। মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, নার্সিং, মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ডেন্টাল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রমুখ নিজ গ্রামে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাব গড়ে তুলবেন। তখন প্রত্যেক মানুষ রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা স্বল্পমূল্যে-বিনামূল্যে আধুনিক চিকিৎসা পান। ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রিধারীরা প্রাইমারি স্কুলে আধুনিক প্রযুক্তির সংযোগ ঘটাবেন। যেখানে প্রাইমারি স্কুল নেই, সেখানে এটা প্রতিষ্ঠা করবেন। প্রতিটি গ্রাম কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি শিক্ষায় স্বয়ংসম্পন্ন হবে। প্রতি উপজেলায় ১০টি ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ফলে উপজেলা শহরগুলো শিক্ষানগরীতে পরিণত হওয়া সম্ভব।

বিমসটেকের সদস্যভুক্ত সাতটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানের শিক্ষাপ্রেমীদের বিশ্ব ডিপ্লোমা শিক্ষা দিবসের সেøøাগান গ্রাম উন্নয়নে বিভাগীয় ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড যথার্থ মূল্যায়নের আহ্বান জানাই। এ বিষয়টি যত বেশি, যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন বিমসটেকের ১৩০ কোটি মানুষ তত দ্রুত এর সুফল ভোগ করবেন।
লেখকদ্বয় : সভাপতি ও মহাসচিব, ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ
khanaranjanroy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement