২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পশ্চিমা বিশ্ব এখনো সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার রূপরেখা দিতে পারে

পশ্চিমা বিশ্ব এখনো সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার রূপরেখা দিতে পারে -

সিরিয়া সঙ্কটের সাত বছরে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি ওলটপালট হয়ে গেছে। কিন্তু মনে হয়, সামনে সবচেয়ে খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের অন্যপথে আচড় খাওয়া বা পাল্টে যাওয়ার ব্যাপারে অনুমোদন দেয়া ঠিক হবে না। কারণ, আমরা জানিÑ জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ চলতি মাসেই সিরিয়া প্রশ্নে বৈঠকে বসছে।

জুন মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সেনাবাহিনী সিরিয়ার সেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হামলা চালায় যেখানে গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল। সপ্তাহের মধ্যে তারা জর্দানে যোগাযোগের সীমান্ত তথা বর্ডার ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তীব্র প্রয়োজনের সময় হাজার হাজার সিরীয় নাগরিকের কাছে সহায়তা পৌঁছানোর জন্য সাহায্য সংস্থাগুলো এ বর্ডার ক্রসিং ব্যবহার করে থাকে।

আমার সংগঠন আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটি (ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি) তাদের সিরীয় সংগঠনগুলোর অংশীদারি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আড়াই লাখেরও বেশি সিরীয় নাগরিককে স্বাস্থ্যসহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এ সংগঠনটিই সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে বৃহত্তম স্বাস্থ্যসহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান।

এখন আমাদের অসহায় ওইসব মানুষের প্রয়োজনে সাড়া দেয়ার জন্য সেখানে যেতে দেয়া হচ্ছে না। যেসব মানুষকে আমরা সহায়তা দিয়েছি, তারা এখন কেমন আছেন; তাদের ভাগ্যে কী ঘটছে- তা আমরা জানি না। সিরিয়া সরকার দামেস্কের পূর্ব অংশে অবস্থিত গৌতা পুনর্দখলের পর সেখানকার অবস্থার আলোকে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়ায় মানুষের মধ্যে কিছুটা আস্থা ফিরে এসেছে।

এমনকি মানবিক কাজে অংশীদাররাও সিরিয়ার অভ্যন্তরে সেবা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অনুমতি পেলেও বহু এলাকা, যেগুলো এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে, সেখানে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দিতে আসাদ সরকারের অনুমোদন পায়নি।

মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা এবং অন্য সেবা পাওয়ার আবশ্যকতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সিরীয় সরকার দ্বারা পুনর্দখলের জন্য সেখানে বর্বর হামলা করা হয়েছে- সেই বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে হাজার হাজার সিরীয় নাগরিক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে একদিনের মধ্যেই রিক্তহস্ত হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন। আসাদ সরকার ওই এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য পুনরায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করার কারণে সেখানকার মানুষ প্রতিশোধমূলক হামলার আশঙ্কায় অত্যন্ত আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। জোরপূর্বক তাদের সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা, মানবিক সহায়তা প্রদানে অস্বীকৃতি এবং মহিলা ও তরুণীদের যৌন হয়রানির ভয়ে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত।

সাহায্য সংস্থাগুলোকে বিতাড়িত করা এবং মানবিক সাহায্য সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মীদের ক্রস বর্ডার তথা সীমান্তে প্রবেশাধিকার হরণ করে নেয়ার কারণে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদকে সিরিয়ার বেসামরিক লোকদের রক্ষা করার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ এবং সেখানে যথাযথভাবে সাহায্য সহায়তা পৌঁছে দেয়ার জন্য সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার দাবি জানান উচিত। যেকোনো অপরাধ করলেই আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় অপরাধীদের পরিপূর্ণ জবাবদিহিতা অবশ্যই রেকর্ড করতে হবে।

মানবিক কর্মে নিয়োজিত কর্মী এবং মানবিক সহায়তা গ্রহণকারী- উভয়কে এখন অবশ্যই যেকোনো পরিণতির মুখোমুখি হওয়া থেকে নিরাপদ থাকতে হবে- কারণ তারা এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে বসবাস করছেন। উল্লেখ্য, তারা আগে কয়েক বছর বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন।

এখন অবশ্যই পালাক্রমে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ইদলিবের দিকে সমানভাবে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ, এটা হচ্ছে ওই এলাকা যেখানে নতুনভাবে সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কথিত সমঝোতা চুক্তির আওতায় সারা দেশ থেকে সশস্ত্র বিরোধী গ্রুপগুলোকে সেখানে বিতাড়িত করা হয়েছে। সেখান থেকে তারা আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অবস্থান গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিদ্রোহী এবং আসাদ সরকারের মধ্যে রয়েছেন ২৬ লাখ বেসামরিক লোক- যাদের অর্ধেকই যুদ্ধের কারণে তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বেঁচে থাকার জন্য ইতোমধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার লোকের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। গৌতার পূর্বাঞ্চলে আতঙ্কজনক পরিস্থিতির কারণে সেখান থেকে ৭০ হাজার লোক পালিয়ে গেছেন। অথচ তারা সেখানে অবরোধের মধ্যেই পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসছিলেন।

সিরীয় যুদ্ধে রাশিয়া নিজেকে একজন কেন্দ্রীয় তথা প্রধান খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। গত মাসের শেষের দিকে রাশিয়ার সোচিতে তুরস্ক ও ইরান আলোচনায় মিলিত হয়েছিল। তারা সেখানে ইদলিব পরিস্থিতির অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন করে সামরিক হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে বেসামরিক লোকদের রক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ ধরনের অবস্থায় পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা জাতিসঙ্ঘকে বাইরে রেখে এগোতে চান। জাতিসঙ্ঘের শান্তিপ্রক্রিয়াকেও তারা সাইডলাইনে রাখতে চাচ্ছেন।

জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদকে তাদের তৎপরতা ও কার্যক্রমের ব্যাপারে পুনরায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তথা শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বেসামরিক লোকদের রক্ষা করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে বিশেষত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে (পি-৩) সোচ্চার ভূমিকা পালন করে তাদের প্রভাবকে কাজে লাগাতে হবে। পি-৩ কে অবশ্যই দাবি করতে হবে- প্রথমত, যেসব পক্ষ সঙ্ঘাতে জড়িত, তাদের পরিকল্পিত যেকোনো হামলা স্থগিত রাখতে হবে এবং জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনাকে পুনরায় সক্রিয় করতে হবে।

সিরিয়ান আইন অথবা মানবাধিকার আইনে এলাকার বিস্তৃতি বা সম্প্রসারণ বন্ধ বা হ্রাস করা এবং সমঝোতা চুক্তিকে রক্ষা করার কোনো রক্ষাকবচ নেই। এ দীর্ঘ বে-আইনি যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছেন সিরিয়ার নাগরিকেরা। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের যেকোনো লঙ্ঘনে বাধা দেয়ার জন্য ইদলিবে তুর্কি সামরিক বাহিনীর ১২টি পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি অবশ্যই জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তাদের কাছে খুলে দিতে হবে। তুরস্ককে তাদের সীমান্ত দিয়ে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিপূর্ণভাবে মানবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মানবাধিকার কর্মীদের প্রবেশ করার অনুমতি দিতে হবে অবশ্যই।

তৃতীয়ত, যেকোনো ধরনের যুদ্ধ বেধে গেলে অবশ্যই নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার পথ থাকতে হবে। বেসামরিক লোকেরা তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য যেন পালিয়ে যেতে পারেন, সে জন্য তুরস্কের ভেতর দিয়ে একটি উন্মুক্ত সীমান্ত থাকতে হবে।

যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য আসাদ এবং রুশ সরকার তাদের নিয়মবিধি অনুযায়ী খেলতে চান। এর মাধ্যমে তারা সিরিয়ার পুনর্গঠনের জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে অর্থ ব্যয় করাতে চাচ্ছেন। তাদের এ মোহ ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এটা অবশ্যই স্পষ্ট করতে হবে যে, জেনেভায় আলাপ-আলোচনার ফলে একটি ব্যাপক, যথাযথ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া এবং সিরিয়ার নাগরিকদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি ব্যতীত যুদ্ধপরবর্তী সিরিয়ার পুনর্গঠনে সহায়তা করার জন্য পশ্চিমা অর্থ সহায়তার বিষয়টি টেবিলেই আটকা পড়ে থাকবে।

যেখানে পশ্চিমা অর্থের সুবিধা আছে, এ সাথে পশ্চিমা উপস্থিতিও থাকতে হবে। সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল বর্তমানে কুর্দিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আসাদ সরকারের হামলার বিরুদ্ধে দুই হাজার মার্কিন সেনা সেখানে একটি বীমা নীতি সরবরাহ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এ সুবিধার দিকটিও অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। তিনি সম্প্রতি সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে অনুমাননির্ভর যে কথা বলেছেন, সেটা করা চলবে না। সিরিয়াবাসীকে তাদের প্রেসিডেন্টের মন্দ পরিণতি থেকে অব্যাহতির জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে। আসাদ গত কয়েক বছরের চেয়ে এখন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। কেউ একজনকে এটা শিক্ষা দেয়ার জন্য দাঁড়াতে হবে যে, যুদ্ধে জয়লাভ করা আর শান্তিপ্রতিষ্ঠা একই বিষয় নয়।
লেখক : ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement