২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
এক দিকে চীন অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র-জাপান

কী করবে শ্রীলঙ্কা

এক দিকে চীন অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র-জাপান : কী করবে শ্রীলঙ্কা - ছবি : সংগ্রহ

এক দিকে চীন, অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-ভারত। দুই পক্ষের চাপে স্যান্ডউইচ হয়ে পড়ছে দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কা। ভারত মহাসাগরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকা দেশটি কি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে, নাকি চাপের কাছে হাল ছেড়ে দেবে? মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে বিষয়টি। দুই পক্ষ থেকেই সাহায্য-সহায়তা বিপুলবেগে আসছে। শ্রীলঙ্কাও উভয় পক্ষের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, কাউকেই নাখোশ করার ইচ্ছা তাদের নেই।

হেলোংজিয়াং প্রভিন্সিয়াল অ্যাকাডেমি অব সোস্যাল সায়েন্সের ইনস্টিটিউট অব নর্থইস্ট এশিয়ার পরিচালক দা ঝিগাং এ প্রসঙ্গে বলেন, শ্রীলঙ্কার অবস্থান আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। এটি ইস্ট-ওয়েস্ট শিপিং রুটে অবস্থিত। এখান দিয়ে প্রতি বছর পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বাণিজ্য হয়ে থাকে।

তা ছাড়া দেশটি চীনা বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। চীন এ দেশের বন্দর ও অন্য অবকাঠামোগুলোয় ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। এমন প্রেক্ষাপটেই প্রতিরক্ষা খাতে শ্রীলঙ্কার সাথে সহযোগিতার উদ্যোগ জোরদার করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান।

সাহায্য-সহযোগিতার কিছু নমুনা দেখা যাক। শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করার জন্য দেশটিকে ১১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের দু’টি টহল নৌকা দিয়েছে জাপান। এর এক সপ্তাহ আগে শ্রীলঙ্কার নৌশক্তি বাড়াতে কলম্বোকে ৩৯ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।

শ্রীলঙ্কায় জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইতসুনোরি ওনোদেরার সফরের সময় টোকিওর সামরিক সহায়তার কথা ঘোষণা করা হয়। ওনোদেরা প্রথম জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে জাপান সফর করেন।

এএফপি জানিয়েছে, জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বন্দরনগরী হাম্বানতোতা সফর করেছেন। ওই বন্দরটি চীনের কাছে শ্রীলঙ্কা ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়েছে। এটি বিশ্বের ব্যস্ততম শিপিং রুটে অবস্থিত। এ ছাড়া এটি বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এই বন্দর চীনকে ভারত মহাসাগরে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রাখবে।

ত্রিঙ্কোমালি বন্দরে ভারতের সহায়তায় জাপান বন্দরটি উন্নয়ন কাজ করছে। কলম্বোয় শ্রীলঙ্কা বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে মিলে চীন একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার সাথে যৌথ উদ্যোগে জাপানি একটি কোম্পানি সেখানে একটি ড্রাইডকও ব্যবস্থাপনা করছে।

তবে চীনা উপস্থিতির ফলে যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-ভারতের মধ্যে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, শ্রীলঙ্কা তা দূর করার চেষ্টা করছে। তারা জানাচ্ছে, হাম্বানতোতায় চীনের সামরিক কোনো কার্যক্রম চলবে না। এটি কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হবে। কিন্তু ভারতের আশঙ্কা তাতে দূর হয়নি। তাদের আশঙ্কা, বন্দরটি চীনা নৌবাহিনীর নতুন সরবরাহ ঘাঁটিতে পরিণত হবে।

আশঙ্কা দূর করার জন্যই জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে সম্প্রতি হাম্বানতোতা বন্দর সফর করানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কা নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান অ্যাডমিরাল কলম্বাজে দি সিটিজেন সানডেকে বলেন, বিশ্ব ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে আশ্বস্ত করতে হবে, হাম্বানতোতা বন্দরটি কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশেই ব্যবহৃত হবে, সামরিক উদ্দেশে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।

তিনি বলেন, ইজারা চুক্তি অনুযায়ী চীনা নৌবাহিনীর জাহাজ যদি বন্দরে ভিড়তে চায়, তবে তা অন্য দেশে অনুসৃত প্রক্রিয়াই মেনে চলতে হবে। নৌবাহিনীর জাহাজ ভেড়ার অনুমতি পুরোপুরি শ্রীলঙ্কার হাতে। নিরাপত্তার পুরো বিষয়টি থাকবে শ্রীলঙ্কা নৌবাহিনীর হাতে।
তিনি আরো বলেন, শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব হচ্ছে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষা করা। একই সাথে ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর নিরাপত্তা উদ্বেগও দূর করতে হবে।

তিনি বলেন, চীন ৯৯ বছরের জন্য হাম্বানতোতা বন্দরের ৭০ ভাগের মালিকানা লাভ করেছে। তারা তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে তা ব্যবহার করতে পারে বলে ভয় রয়েছে। চীন যাতে চুক্তির বরখেলাপ করতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পদক্ষেপ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। ওবামা আমলের এশিয়া-প্যাসিফিক শক্তির নতুন ভারসাম্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে নতুন করে বিন্যস্ত হয়েছে। এই পরিকল্পনায় জাপানও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-জাপান জোটের অন্যতম লক্ষ্য হলো ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ানো, উত্তর-পূর্ব এশিয়া ও পুরো এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের নিরাপত্তা জোরদার করা এবং চীনকে সংযত করা।

ওই চীনা বিশেষজ্ঞের মতে, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র যদিও শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তাদের লক্ষ্য আরো বড়। তারা ভূ-রাজনৈতিক জরুরি প্রয়োজনে ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকাগুলোয় তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। এ কারণে তারা শ্রীলঙ্কার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাচ্ছে। এটি ভূ-কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মস্কোর ইনস্টিটিউট অব দ্য ফার ইস্টের গবেষক ভ্যালেরি কিস্টানভ বলেন, এ অঞ্চলে চীনা প্রভাব বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হলো- জাপানের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ। তিনি দার সাথে সুর মিলিয়ে বলেন, ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের প্রধান লক্ষ্য হলো চীনকে সংযত করা। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান উভয়ে চায়, তাদের সাথে নতুন নতুন দেশ যোগ দিক। শ্রীলঙ্কা হলো তাদের এমন সম্ভাব্য দেশ।

তার মতে, শ্রীলঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র-জাপান সামরিক সহায়তা আসলে বেইজিংয়ের ওপর চাপ দেয়া এবং এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান নৌ-কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করা।
অন্য দিকে, বেইজিং চাচ্ছে শ্রীলঙ্কার সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করতে। চীন গত আগস্টে দেশটির নৌবাহিনীকে একটি ফ্রিগেট উপহার দিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এ ছাড়া, শ্রীলঙ্কার সৈন্যদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে চীন। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় চীনা সামরিক সরবরাহের মধ্যে ছিল ফেইনু-৬ এমএএনপিএডিএএস, এমএ৬০ ও ওয়াই-১২ সামরিক পরিবহন বিমান, টাইপ ০৬২ টহল যান। চীন সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় একটি সামরিক বিমান রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রও খুলেছে।


উদ্বেগের নেপথ্যে
চীন তার লাগোয়া দক্ষিণ চীন সাগরে যা করেছে, একই কাজের পুনরাবৃত্তি ভারত মহাসাগরে করতে পারে বলে জাপান খুবই উদ্বিগ্ন।

নিক্কিরি এশিয়ান রিভিউয়ের এশিয়া আঞ্চলিক সংবাদদাতা সাইমন রগনিন ১৩ জুন লিখেছেন, ২০১৩ সাল থেকে দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ ও শৈলশ্রেণী সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে। তারা এসব স্থানে রানওয়ে, ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার, ব্যারাক, যোগাযোগ স্থাপনা বসাচ্ছে। বিতর্কিত প্যারাসেল আইল্যান্ডে বোমারু বিমান মোতায়েন করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
তিনি বলেন, এসব ঘটনা অনেককে চিন্তায় ফেলেছে, বেইজিং কি বিতর্কিত সমুদ্র এলাকায় তার অপ্রতিরোধ্য নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে? ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও ভিয়েতনামও দক্ষিণ চীন সাগর এবং এর দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা দাবি করছে।

তিনি বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লেনগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারা মানে বাণিজ্যিক ও সামরিক দিক থেকে বিপুল সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা।

চীনের আগ্রাসী অবস্থানকে মেনে নিতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ম্যাটিস সাংগ্রি-লা ডায়ালগকে বলেছেন, ভীতি প্রদর্শন ও চাপ সৃষ্টির জন্য দক্ষিণ চীন সাগরকে সামরিকায়নের জন্য চীনকে ফল ভোগ করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement