২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সময়-অসময়

উই ওয়ান্ট জাস্টিস

উই ওয়ান্ট জাস্টিস - সংগৃহীত

সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে আলাপচারিতায় শুনলাম, গত সপ্তাহে (আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ) রাজধানীর অন্যতম স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রীরা সবাই পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর না লিখে প্রতিবাদস্বরূপ ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ লিখে উত্তরপত্র (পরীক্ষার খাতা) জমা দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে পরীক্ষার হল ত্যাগ করেছে। ঘটনাটি যাচাই করার সুযোগ হয়নি, তবে ‘নিরাপদ সড়কের’ দাবিতে আন্দোলনের সময় ছাত্রছাত্রীরা হাতের লেখা যে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেছিল তাতে ইংরেজিতে লেখা ছিল 'We Want Justice', যা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সংবাদে দেখেছি। ইংরেজি ১৩ বর্ণমালা বা তিন শব্দের এ বাক্যটি কি নতুন নাকি অধিকারবঞ্চিত জনতার দীর্ঘ দিনের দাবি? বাক্যটির বাস্তবায়নের জন্য দেশটিকে স্বাধীন করতে হলো দু’দুবার (১৯৪৭ ও ১৯৭১), তারপরও এই একই দাবি নিয়ে কোনো না কোনো সময়ে প্রকারান্তরে এই 'We Want Justice' দাবি নিয়েই জনগণকে মাঠে নামতে হচ্ছে এবং শাসকসহ কর্তৃক দমন-পীড়ন মাথায় নিয়েই কোনো সময় গাজি নতুবা শহীদ হয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছে।

‘যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ’ এ প্রবাদটি আমাদের দেশের জন্য শতভাগ সত্য। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের জয়লাভ করানোকেই যখন পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজ দায়িত্ব মনে করছিল, যা ছিল দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্যমান, নিজের ভোট যখন নিজে দিতে পারত না, অর্থও দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণে, যখন জনগণের ভোটাধিকার ভূলুষ্ঠিত, তখন আওয়ামী লীগ, জাসদ (ইনু), ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন), জামায়াতে ইসলামী, বামপন্থীসহ ২২টি দল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের বিল পাসের নিশ্চয়তা বিধান করেছিল।

আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের বিধান সংবিধান থেকে মুছে ফেলে, একচ্ছত্র ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে এখন ‘রাবণ’দের মুখে উল্টো সুর বইছে। এই উল্টো সুরের সাথে গলা মিলাচ্ছেন আমাদের দেশের হাইব্রিড বুদ্ধিজীবীরা যারা এখন বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন। কেউ উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতা বা কেউ সাংবাদিকতাকে রেখেছেন সাইনবোর্ড হিসেবে; কিন্তু কাজ করছেন জনস্বার্থের পরিপন্থী। সরকারের সব কাজের প্রশংসা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিগৃহীত করার পরও জেনেশুনে সরকারের সব অ্যাকশনের প্রশংসার পঞ্চমুখ হচ্ছেন জনগণের দাবিকে জলাঞ্জলি দিয়ে।

হাইব্রিড বুদ্ধিজীবীরা কথা বলছেন এখন খুব কৌশলে, যাতে সরকারের কাছ থেকে দালালির পারসেন্টেজ থেকে বঞ্চিত না হন, অন্য দিকে দালালরা এমনভাবে কথা বলেন তাদের দালালি জনগণ যাতে সব কিছু টের পেয়ে না যায়। বর্তমানে নিজেদের দালাল না বলে Middle Man হিসেবে তাদের অবস্থান তুলে ধরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা হচ্ছে। দালালি এখন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অবস্থায় করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রয়োজন অনুযায়ী, জ্ঞানের আলোকে বিকশিত করার জন্য নতুন নতুন বিষয়ের ওপর ডিগ্রি দেয়ার জন্য নতুন নতুন বিভাগ-ফ্যাকালটি চালু করছে। দালালি পৃথিবীজুড়ে লাভজনক ব্যবসায়, যা এখন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিষয়ভিত্তিক স্নাতক ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা যেতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। ভবিষ্যতে ‘দালালি’বিষয়ক পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার দাবি হয়তো অস্বাভাবিক হবে না।

এর উল্টো চিত্রও আছে। পেশাগত সাংবাদিক জীবনকে বাজি রেখে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন, জেলে যাচ্ছেন, শাসকদলের পিটুনি খাচ্ছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করছেন, রিমান্ডে যাচ্ছেন- এমনকি জীবন দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের কলম থেমে নেই। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ছবি আর সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে সরকারের পেটোয়াবাহিনী কর্তৃক আহত হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন, রিমান্ডে গিয়েছেন। সাংবাদিকেরা তাদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতার করার দাবি জানাচ্ছেন। তথ্যমন্ত্রী হামলাকারীদের গ্রেফতার করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু এ পর্যন্ত গ্রেফতারের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। তথ্যমন্ত্রীর চিঠি যদি আইওয়াশ না হয়ে থাকে এবং সরকারপন্থী সাংবাদিক নেতারা যদি লোকদেখানো ভূমিকা না নিয়ে থাকেন তবে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের অবশ্যই গ্রেফতার করার কথা। তবে সব নির্ভর করবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।

সরকার তাদের গণতন্ত্রের প্রতিভু হিসেবে পরিচয় দেয়ার যতই চেষ্টা করুক না কেন, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে স্বেচ্ছাচারিতা তকমা তারা ঘুচাতে পারছেন না। একটি জাতীয় পত্রিকায় ৮ আগস্ট দেখা যায় যে, সরকারের একজন প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী (সোহেল তাজ) স্বৈরাচারী শাসন কী, তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আটটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছেন, যথা- (১) যখন সাধারণ মানুষ তার মুক্তচিন্তা ব্যক্ত করতে ভয় পায়, (২) যখন দল, সরকার এবং রাষ্ট্র একাকার হয়ে যায় আর সরকারের সমালোচনা করলে সেটিকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, (৩) যখন দেশের প্রচলিত নানা আইন এবং নতুন নতুন আইন সৃষ্টি করে তার অপব্যবহার করে রিমান্ডে নেয়া এবং নির্যাতন করা হয়, (৪) বিনা বিচারে হত্যা ও গুম করে ফেলা হয়, (৫) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবহার করা হয়, (৬) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থাকে পেটোয়াবাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়, (৭) যখন সাধারণ নাগরিকসহ সবার কথাবার্তা, ফোনালাপ, সোস্যাল মিডিয়া পোস্ট মনিটর ও রেকর্ড করা হয় এবং (৮) যখন এসব বিষয় রিপোর্ট না করার জন্য সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিকদের গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে হুমকি দেয়া হয়।

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী (পদত্যাগ করেছেন, তা গৃহীত হয়েছে কি না জানা যায়নি) সোহেল তাজকে চিনি ২০০৪ সাল থেকে যখন আমরা দু’জনেই মহাখালীর (ঢাকা) স্পোর্স জোনের নিয়মিত সদস্য ছিলাম। সেখানে এক্সসারসাইজ করার সময়, কখনো পাশাপাশি ট্রেড মিলে দৌড়ানোর সময় কিংবা যেকোনো ইভেন্ট করার ফাঁকে ফাঁকে আলাপ হতো। নিজ দলীয় আনুগত্যের প্রশ্নে তার কোনো কমতি দেখিনি।


তবে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চলে গেছেন এবং স্বৈরাচারের উপাদানের ও স্বৈরশাসনের চেকলিস্ট উল্লেখ করেছেন যা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। রাষ্ট্র তার প্রতিটি নাগরিকের অভিভাবক, যা রাষ্ট্রীয় অর্থে লালিত প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে; কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারে না, মৌলিক অধিকারকে স্তব্ধ করতে পারে না। অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র বলতে ‘কয়েকটি পরিবার ও গ্রামের সমষ্টি, যার উদ্দেশ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি।’ এককালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মতে, ‘মানবজাতির অংশবিশেষকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধভাবে দেখা গেলে তাকে রাষ্ট্র বলা হয়’। সোহেল তাজ স্বৈরশাসনের যে চেকলিস্ট প্রদান করেছেন তা যদি সরকার মিলিয়ে দেখত বা সরকারসমর্থিত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পরীক্ষা করত সরকারপ্রধান উপলব্ধি করতে পারতেন যে, এ শাসনামলে কী পরিমাণ স্বৈরতন্ত্র ঢুকে রয়েছে গণতন্ত্রের নামে।

সরকার উন্নয়নের ‘শাক’ দিয়ে গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকারের ‘মাছ’ ঢাকছে। পদ্মা সেতু, ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্যাটেলাইট প্রভৃতি করে যতটুকু জনসমর্থন মিলছে, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে গণমানুষকে এর চেয়ে বেশি প্রতিপক্ষ বানানো হচ্ছে। সম্প্রতি যত আন্দোলন হয়েছে তা সরকার বনাম জনগণ; যদিও জোরগলায় সরকার বলছে যে, ডিজিটাল উন্নয়নের জোয়ারে বাংলাদেশ ভাসছে। অন্য দিকে মানুষ কথা বলতে পারছে না, নিজের ভোট নিজে দিতে পারছে না, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এত ডলার লোপাট হয়ে গেলেও একটি লোকও গ্রেফতার হচ্ছে না, সরকারি ব্যর্থতায় যত দুর্নীতি হচ্ছে তার তদন্ত শেষ হচ্ছে না- এমন অবস্থায় সরকারের উন্নয়নের ডামাঢোল জনগণ আর কত শুনতে চাইবে?

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement