২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল - সংগৃহীত

যেকোনো রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ থাকে- নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি অঙ্গ, বিশেষ করে স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকা সভ্যসমাজেরও একটি বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রের শাসন-প্রশাসনসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নির্বাহ বা পরিচালনা করা নির্বাহী বিভাগের আওতায় পড়ে। আইন বিভাগের কর্মপরিধি সংসদে যেকোনো আইন প্রণয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অবশ্য সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় সংসদ সদস্যরা সংসদীয় কমিটি এবং সরকারের প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের কাজকর্ম নজরদারি করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। আর যেকোনো আইনি জটিলতা কিংবা বিবাদ-বিসম্বাদ নিষ্পত্তির জন্য বিচার বিভাগের আবশ্যকতা দেখা দেয়। বক্ষ্যমান নিবন্ধে শুধু বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ওপর আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

এই প্রসঙ্গে উপমহাদেশের বিচারব্যবস্থার পটভূমি ও বিবর্তনের ওপর একটু আলোকপাত করা যাক। ১৭৭২ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি জেলায় ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৭৮৭ সালে জেলা কালেক্টরকে ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল এবং জজের ক্ষমতা দেয়া হয়। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয় এবং তা কিছুকাল বহাল থাকে। ১৮২১ সালে লর্ড হেস্টিংস নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগকে আবার একত্র করলেও ১৮৩১ সালে ফৌজদারি আদালত এবং দেওয়ানি আদালত করা হয়। ব্রিটিশ আমলে এইভাবে বিচার বিভাগের বিবর্তন ঘটে। পাকি¯Íান আমলে ১৯৫৬ সালে প্রণীত প্রথম এবং ১৯৬২ সালে প্রণীত দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রের মৌলিক নীতি অধ্যায়ে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার নীতি বিধৃত ছিল। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন কোনো সরকারই নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করেনি। বাংলাদেশের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার কথা থাকলেও কোনো নির্বাচিত সরকারই তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থানের কারণে তা করেনি। মাসদার হোসেন মামলার মূল বিষয় (বিচারকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো) থেকে ফোকাস সরিয়ে সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের প্রতিবন্ধকতার কারণে সংবিধানের ১১৫, ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদের ইচ্ছেমাফিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে উচ্চ আদালত যে ১২ নির্দেশনা দেয়, তা পরোক্ষভাবে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার নির্দেশনারই নামান্তর। এর অনুসরণে ২০০৭ সালে ১ নভেম্বর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার বাস্তব রূপায়ন ঘটায়।


কিন্তু নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার উদ্দেশ্য কি অর্জিত হয়েছে? এখানে উলেøখ্য, আমাদের বিচারব্যবস্থার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো- পুলিশ সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ফলে পুলিশকে দলীয়করণ করা হয়েছে। পুলিশ নির্বাহী বিভাগের প্রত্যক্ষ্য  নিয়ন্ত্রণে থাকায় সরকারি দলের নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বিরোধী পক্ষ বা দলকে রিমান্ড নির্যাতনসহ নানা প্রকারের হয়রানি করে থাকেন। সদ্য অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া সিটি নির্বাচনগুলোতে তফসিল ঘোষণার পর সরকারি দলকে রাজনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেয়ার জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের পুলিশ যেভাবে গণগ্রেফতার করেছে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা তার কী বা কতটুকু প্রতিকার দিতে পেরেছেন?

বিচার বিভাগ পৃথক করার সুফল না পাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো- জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেদের নিয়োগ, পোস্টিং ও পদোন্নতি আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে রয়েছে। বিচার বিভাগ পৃথক করার আগে ম্যাজিস্ট্রেট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের (পূর্বতন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়) নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের মুখ্য যুক্তি ছিল যে, ম্যাজিস্ট্রেটরা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকায় বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিচার বিভাগ পৃথক করার ফলে বিশেষ করে জামিনের ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ কার্যত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হয়েছে। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে তাহা প্রযুক্ত হইবে এবং সংবিধানের ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই সংবিধানের বিধানাবলীসাপেক্ষ্যে বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং ম্যাজিস্ট্রেটেরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন’ মর্মে উল্লেখ আছে।

কিন্তু সরকারের Allocation of Business অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির উলিখিত দায়িত্বগুলো আইন মন্ত্রণালয় (আইন ও বিচার বিভাগ) পালন করে থাকে। সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয় না থাকায় এসব ক্ষেত্রে উক্ত কোর্টের পরামর্শ নেয়ার বিধান অনেকটা আনুষ্ঠানিকতা বলে জনমনে ধারণা জন্মেছে। ফলে অধস্তন আদালতের ওপর আইন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই রয়েছে এ কথা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না।

এ কারণে প্রাইজ পোস্টিং পাওয়ার এবং তথায় দীর্ঘকাল কর্মরত থাকার বাসনায় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটেরা আদালত বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের জামিন মঞ্জুর না করার একটা প্রধান কারণ বলে সংশ্লিষ্ট সবার ধারণা। আর আইন মন্ত্রণালয় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জামিন না দেয়ার জন্য নিম্ন আদালতকে নির্দেশ দেয় বলে গুঞ্জন শোনা যায়। ছোটখাটো নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রেও ম্যাজিস্ট্রেটরা জামিন দিতে সাহস সঞ্চার করেন না বলে প্রতীয়মান হয়।

২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অবরোধকালে এবং ২০১৫ সালে আগের বছরের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ও ভোটারবিহীন নির্বাচনবার্ষিকী পালন না করতে দেয়া এবং বেগম খালেদা জিয়াকে গুলশান অফিসে বন্দী করে রাখার প্রতিবাদে পালিত অবরোধের সময় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা আটক বিএনপির কোনো নেতাকর্মীদের জামিন দিয়েছেন এমন নজির মেলা ভার। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো- গুলশান অফিসে বন্দী থাকা অবস্থায় তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মতো ব্যক্তিত্বকে কুমিল্লায় বাস পোড়ানোর মামলায় রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে জড়ানো হলেও নিম্ন আদালত-কর্তৃক জামিন না দেয়া। আর নাশকতা করার কথিত ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের এ যাবৎ কোনো জরিপ না হওয়ায় এর সংখ্যা সম্পর্কে তার কোনো বক্তব্য কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা এবং মুক্তিযুদ্ধে কারো ভূমিকা যা-ই থাকুক না কেন, সংবিধান অনুযায়ী যদি তাকে মন্ত্রী বানানো হয় ও পতাকা বিধি অনুযায়ী জাতীয় পতাকা তাকে ব্যবহার করতে দেয়া হয় তাহলে তা কিভাবে পতাকার অবমাননা হয়, তা অনেকের কাছে বোধ্যগম্য নয়।

এ ছাড়া প্রকৃত জন্মতারিখ ও সার্টিফিকেটের জন্মতারিখ যে প্রায় সবারই (ব্রিটেনের রানীর প্রকৃত জন্মতারিখ ২১ এপ্রিল এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত জন্মতারিখ ৯ জুন) আলাদা এটা তো ওপেন সিক্রেট। আর তার জন্মদিন পালন করে তার ভক্ত-অনুরক্তরা। তার পরও নি¤œ আদালত তার বিরুদ্ধে সরাসরি করা মামলাগুলো তদন্তপ্রক্রিয়ায় না গিয়ে আমলে নিয়ে তাৎক্ষণিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে এবং জামিন নামঞ্জুর করে। এসব ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের ওপর সরকারের প্রভাব রয়েছে বলে জনমনে ধারণা জন্মেছে। এ প্রসঙ্গে মরহুম বিচারপতি এস এম মোরশেদের একটি বিখ্যাত উক্তি স্মর্তব্য :  No tyranny is worse than judicial arbitrariness and no misfortune is worse than judicial subservience.

আমার তো মনে হয় বিচার বিভাগ পৃথক করার আগে ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারকাজে অনেক বেশি স্বাধীন ছিলেন। তখন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ জামিনের ব্যাপারে কালেভদ্রে দু-একটা ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করলেও তা ছিল দল ও রাজনীতি-নিরপেক্ষ। তখন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জামিন দেয়ার বহু নজির আছে। সেই সৎসাহস তখন ম্যাজিস্ট্রেটদের ছিল, যা এখন দেখা যায় না। সুতরাং, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার সুফল এখনো অধরাই রয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তথা আইন মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব কমাতে পারলে এ ধরনের অবস্থার উন্নতি ঘটতে পারে। 


লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement