২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

খান সাহেব, সমালোচনা শোনার জন্য প্রস্তুত হোন

খান সাহেব, সমালোচনা শোনার জন্য প্রস্তুত হোন - সংগৃহীত

তিনি যখন স্কুলে পড়তেন তখন প্রায় সময়ে এ স্বপ্ন দেখতেন, পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দলে টেস্ট ম্যাচের জন্য মাঠে নামবেন। হঠাৎ জানা গেলো, দলের একজন খেলোয়াড় অসুস্থ হয়ে গেছেন আর ওই অসুস্থ খেলোয়াড়ের স্থানে তাকে দলে শামিল করা হয়েছে। পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দলে শামিল হওয়ার স্বপ্ন দেখা ওই ছেলের নাম ‘ইমরান খান’। তাকে তার মা শওকত খানম বুঝিয়েছিলেন, এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন। শর্টকাটে অর্জিত সফলতা স্থায়ী হয় না।

মা তার একমাত্র ছেলেকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বোঝানোর জন্য বলেছিলেন- সৎ মানুষ জান্নাতে যাবেন, আর মিথ্যাবাদীকে দোজখের আগুনে পোড়ানো হবে। শিশু ইমরান খান সরলতার সাথে মাকে জিজ্ঞেস করতেন, জান্নাতে কি তিনি ক্রিকেট খেলতে পারবেন? মা হেসে বলতেন, জান্নাতে সবকিছু পাওয়া যাবে। তবে সর্বদা শুধুই সত্য বলবে।’ শওকত খানমের দেখানো পথে চলে ইমরান খান একদিন পাকিস্তান ক্রিকেট দলে যোগ দেন।

এরপর সে দিনও আসে, যখন ইমরান খানের নেতৃত্বে ওই ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ জয় করেছে। ইমরান খান যখন বিশ্বকাপ জয়লাভ করেন, তখন তার মা শওকত খানম এ পৃথিবীতে নেই। তিনি ১৯৮৫ সালে ক্যান্সারে ইন্তেকাল করেছেন। ইমরান খান তার নামে ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ইমরান খান দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে অনুদান সংগ্রহের অভিযান চালান। ওই অভিযানের সময় বহু মানুষ তাকে রাজনীতিতে আসার পরামর্শ দেয়। ১৯৯৪ সালে শওকত খানম হাসপাতাল চালু হলো। ১৯৯৫ সালে মুসলিম টাউন, লাহোরে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

ওই সমাবেশে ইমরান খান শরিক হন। ওই সমাবেশে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোচনা হচ্ছিল। আমি অনুভব করলাম, ওই নতুন দলের চেহারা তো হবেন ইমরান খান, কিন্তু এর মাস্টারমাইন্ড হবেন হামিদ গুল। আমি ইমরান খানকে পরামর্শ দিলাম, উত্তম হবে আপনার হাসপাতালের দিকে মনোযোগ দেয়া। এক বছর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর সাথে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থাকার সময়ে জানলাম, ইমরান খান নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে ফেলেছেন। দামেস্ক থেকে ফেরার সময় বেনজীর আমার কাছে জানতে চাইলেন, ইমরান খানের ভবিষ্যৎ কী? আমি বললাম, তিনি পরিশ্রমী মানুষ। তাড়াহুড়া করবেন না। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি আপনাদের মারাত্মক প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবেন। তেহরিকে ইনসাফ গঠনের কিছু দিন পর বেনজীর ভুট্টোর সরকারকে বরখাস্ত করা হয়। নওয়াজ শরিফ ইমরান খানকে মুসলিম লীগে (এন) যোগদানের প্রস্তাব করেন। ইমরান অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি নওয়াজ শরিফ ও হামিদ গুল থেকে দূরে অবস্থান করেন।

১৯৯৬ সাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত ইমরান খান অনেক রাজনৈতিক ভুল করেছেন। তবে তিনি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার কারণে তিনি অজানা অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন। ১৯৮৮ সালে জেনারেল জিয়াউল হক মুহাম্মদ খান জুনেজুর সরকার ভেঙে দিলে জেনারেল জিয়াউল হক ইমরান খানকে তার নতুন দলে শামিল করার সিদ্ধান্ত নেন। জেনারেল জিয়ার ছেলে ড. আনওয়ারুল হক ইমরান খানের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি তার বাবার পয়গাম পৌঁছাতে গিয়ে বলেন, তিনি রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। তার ধারণা, আজ পাকিস্তানের আপনাকে প্রয়োজন।’ ইমরান খান অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অপারগতা প্রকাশ করে জানান, তিনি নিজেকে সরকারের মন্ত্রী হওয়ার যোগ্য মনে করেন না। ২০০২ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ নির্বাচনের আগে ইমরান খানকে বলেন, তিনি মুসলিম লিগ (কিউ) এবং এমকিউএম-এর এক যৌথ সরকার গঠন করবেন।

তিনি চাচ্ছেন, তেহরিকে ইনসাফ পার্টি যেন ওই যৌথ সরকারে শামিল হয়। ইমরান রাজি হননি। ওই সময় আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল ইহসানুল হক ও মেজর জেনারেল ইহতেশাম জমির ইমরান খানকে রাজি করাতে বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ইমরান খান রাজি হননি। জেনারেল মোশাররফ বলেছিলেন, যদি আপনি রাজি না হন, তাহলে নির্বাচনে আপনার দল হেরে যাবে। ইমরান খান বলেন- নিঃসন্দেহে দল হেরে যাবে, তবুও আমি দুর্নীতিবাজ লোকদের সাথে সরকারে শামিল হতে পারব না।’ এরপর রেগে গিয়ে তিনি গুজরাটে চৌধুরী ভ্রাতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ভাষণও প্রদান করেন।

২০০২ সালের নির্বাচনে ইমরান খান বহু কষ্টে তার মিয়ানওয়ালির আসন রক্ষা করেন। এ সময়টা এতটাই কষ্টের ছিল যে, তার কাছে ইসলামাবাদে দলের অফিসের ভাড়া আদায়ের অর্থ পর্যন্ত ছিল না। এ অফিস বন্ধ হয়ে যায়। ইমরান খান পার্লামেন্ট ভবনে একটি অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে ওখানে অফিস স্থানান্তর করেন। ওই সময় তার প্রথম স্ত্রী জেমিমা তাকে জিজ্ঞেস করেন, আর কত দিন এমন রাজনীতি করবে, যেখানে সফলতার সম্ভাবনার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না? ‘জেমিমার সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, এ রাজনীতি ইমরানকে তার পরিবার থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। ওই সময় ইমরান খানের সাথে কয়েকবার তার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হয়েছে। তার সফলতার প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস ছিল।

তিনি বলতেন, একদিন আমি সফলতা অর্জন করব। আর পাকিস্তানকে বদলে দেবো।’ তিনি দৃঢ়ভাবে পারভেজ মোশাররফের বিরোধিতা শুরু করেন। একবার (এমকিউএম নেতা) আলতাফ হোসাইন নয়াদিলিøতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন। ইমরান খান জিও নিউজে ক্যাপিটাল টকে আলতাফ হোসাইনের সমালোচনা করলে তথ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আমার জীবনকে আজাবে ঠেলে দেন। এমকিউএম সীতা হোয়াইটের ব্যাপারে হইচই শুরু করে এবং নির্বাচন কমিশনে ইমরান খানের বিরুদ্ধে উদ্ধৃতি পেশ করে। এরপর যখন ১২ মে, ২০০৭ সালে করাচিতে গণহত্যা হলো, তখন ইমরান খান ক্যাপিটাল টকে এমকিউএমকে গণহত্যার জন্য দায়ী করলেন।

একটু ভাবুন, এমকিউএম একজন সেনাপ্রধানের জোটে ছিল। ইমরান খান ওই সেনাপ্রধানের জোটকে সমর্থনকারীর সমালোচনা করে আমাদেরকেও বিপদে ফেললেন, নিজেকেও বিপদে ফেললেন। এরপর মোশাররফ জরুরি অবস্থা জারি করে আমাকেসহ পাঁচজন টিভি ব্যক্তিত্বকে স্ক্রিন থেকে গায়েব করে ফেললেন। উকিল ও সাংবাদিকরা মোশাররফের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে আমি পথের ওপর ক্যাপিটাল টক করতাম আর ইমরান খান আমার রোড শোতে শরিক হয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতার অধিকার নিয়ে স্লোগান দিতেন। তিনিও চাপে পড়েননি, আমরাও চাপে পড়িনি।

২২ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের পর আজ ইমরান খান নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। জেমিমা স্বীকার করেছেন, ইমরান তার অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তাকে ২০০২ সালে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছেন। ইমরান এ সফলতা ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জন করেছেন। তাড়াহুড়া করেননি। কিছু সমঝোতা অবশ্যই করেছেন এবং নির্বাচনে অনিয়মের আওয়াজও উঠেছে, কিন্তু এ আওয়াজ তো ইমরান খানও করছেন। অনিয়মের আওয়াজ মিডিয়ার ওপর চাপ দিলে বন্ধ হবে না। অনিয়ম নিয়ে মিডিয়ায় শক্ত প্রমাণসহ আলোচনা করা উচিত। আমি ২০১৩ সালের নির্বাচনে অনিয়মের প্রমাণ ক্যাপিটাল টকে দেখালে মুসলিম লিগের (এন) লোকেরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে যখন আমরা অনিয়ম নিয়ে আলোচনা করছি, তখন তেহরিকে ইনসাফের অসন্তুষ্ট না হওয়া উচিত।

আজ অনেক বিশ্লেষক পাকিস্তানের মিডিয়ার ওপর চাপ ও সেন্সরশিপের অভিযোগ করছেন। আমি তো কয়েক বছর ধরে এ অঘোষিত সেন্সরশিপের কথা বলে আসছি। অথচ যে মিডিয়ার স্বাধীনতার প্রবক্তা প্রথম আমার কথাকে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিয়েছেন, আজ তিনিই সবচেয়ে বেশি চিৎকার করছেন। ইমরান খানের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তিনি মিডিয়ার ওপর সেন্সরশিপের প্রভাব দূর করবেন। মিডিয়াকে ওই স্বাধীনতা প্রদান করবেন, মোশাররফের সময় তিনি যার সমর্থন করতেন।

যারা আজ ইমরানকে ভালো-মন্দ বলছে, তাদেরকে বলতে দিন। ইমরান খান তার ভালো কর্মের দ্বারা তাদের মুখ বন্ধ করে দেবেন। ইমরান খান সত্য প্রকাশকারী ও ইতিবাচক সমালোচনাকারীদের কদর করবেন। এ আশা করবেন না, তার সাংবাদিক বন্ধু তার সমালোচনা করবেন না। আমরা ভালো কাজের প্রশংসা করব। তবে ভুলগুলোর অবশ্যই সমালোচনা হবে। কেননা, আমাদের মায়েরাও আমাদের এটাই শিখিয়েছিলেন, সর্বদা সত্য এবং শুধুই সত্য বলবে।’ আমাদের ওই পাকিস্তান গড়তে হবে, শওকত খানম যেমন পাকিস্তান দেখতে চেয়েছিলেন। 

পাকিস্তানের দৈনিক জং থেকে
ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement
নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর

সকল