২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

একটি আন্দোলন : মুক্তির পথ দেখাবে কি?

একটি আন্দোলন : মুক্তির পথ দেখাবে কি? - ছবি : সংগ্রহ

আন্দোলন-সংগ্রাম আর বাংলাদেশ যেন পরিপূরক শব্দ। জন্ম থেকেই ভূখণ্ডটিকে আন্দোলন, সংগ্রাম, বিদ্রোহ, যুদ্ধের মধ্য দিয়েই পথ চলতে হচ্ছে। জিয়াউদ্দীন বারানীর ‘বুলগাকপুর’ আজো শান্ত হতে পারেনি। ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজন একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে, we want justice স্লোগানকে ধারণ করে বাংলাদেশের স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোররা এবার যে আন্দোলনে নেমেছে, তা দেশের ইতিহাসে তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল। এই আন্দোলনকে কেউ কেউ দেশটির জন্য ‘আরব বসন্ত’, আবার কেউ কেউ স্পার্টাকাসের আন্দোলনের সাথে তুলনা করেছেন। স্পার্টাকাস ছিলেন একজন রোমান ক্রীতদাস। মানব ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে মুক্তির পথ-প্রদর্শক হিসেবে যুগ যুগ ধরে এই বীরকে মানুষ স্মরণ রাখবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে। ১১১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই বীর প্রাচীন রোমের থ্রেসে জন্মগ্রহণ করেন।

পৃথিবী তখন সমাজ বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায় তথা দাসপ্রথা ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার কাল অতিক্রম করছিল। তরুণ বয়সে স্পার্টাকাস যোগ দেন রোমান সেনাবাহিনীতে। তবে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর তাকে ‘ডাকাত দলের সাথে যোগাযোগ’ থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ফলে তাকে ক্রীতদাসের ভাগ্য বরণ করতে হলো। সে সময় রোমে ক্রীতদাসদের বাছাই করে বিভিন্ন যুদ্ধকৌশল প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ যোদ্ধায় পরিণত করা হতো। দাস মালিকদের বিনোদনের জন্য গ্ল্যাডিয়েটরদের ‘মল্লযুদ্ধ’ খেলায় অংশ নিতে হতো। এই জীবন হরণের খেলায় গ্ল্যাডিয়েটররা বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার জন্য প্রতিপক্ষকে হত্যা করত। খেলা শেষ হতো একমাত্র জীবিত গ্ল্যাডিয়েটরকে বিজয়ী ঘোষণা করার মাধ্যমে। স্পার্টাকাসও পরিণত হন গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধায়। এমন নৃশংসতা ও পাশবিকতার সাথে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। একসময় তিনি গ্ল্যাডিয়েটরদের ঐক্যবদ্ধ করে বিদ্রোহ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৩ অব্দের দিকে স্পার্টাকাস তার বাহিনী নিয়ে বিসুভিয়াস পর্বতমালার পাদদেশে পালিয়ে যান এবং একটি ছোট সেনাবাহিনী গঠন করেন। এখানে অবস্থানকালে চার দিকে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহের কথা ছড়িয়ে পড়ে।

এ সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিকামী ক্রীতদাসেরা পালিয়ে এসে দলে দলে এই বাহিনীতে যোগদান করতে থাকে। একসময় তাদের দমন করার উদ্দেশ্যে শক্তিশালী রোমান সেনাবাহিনী তাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু স্পার্টাকাসের কৌশলের কাছে রোমান সেনাবাহিনী বারবার পরাজিত হতে থাকে। এক বছরের মধ্যে স্পার্টাকাসের বাহিনীতে যুক্ত হয়েছিল ৪০ হাজারেরও বেশি সেনা। একাধিক যুদ্ধে জয়লাভ করার ফলে তার বাহিনী সমৃদ্ধ হতে থাকে অশ্ব ও বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্রে। স্পার্টাকাস স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন শোষণ-নির্যাতনমুক্ত রাষ্ট্র গঠন করার। তিনি এবং তার বাহিনী পরিকল্পনা করলেন মেসিনা প্রণালি হয়ে জলপথ পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগরে শ্যামল দ্বীপ সিসিলিতে দাসদের জন্য একটি ‘স্বপ্নভূমি’ প্রতিষ্ঠার। সে জন্য স্পার্টাকাসের প্রয়োজন ছিল বেশ কিছু জাহাজ ও সুদক্ষ নাবিকের। অল্প সময়ের মধ্যে এত কিছু জোগাড় করার দুঃসাধ্য সাধনের স্বপ্ন দেখায় সিসিলির জলদস্যুরা। বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভকৃত অর্থের বিনিময়ে, এই জলদস্যুদের কাছ থেকে স্পার্টাকাস জাহাজ ও নাবিক সংগ্রহ করতে চুক্তিবদ্ধ হলেন।

কিন্তু অর্থ পেলেও জাহাজ আর নাবিক তারা সরবরাহ করেনি। এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে স্পার্টাকাস শক্তিহীন এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। শক্তিহীন স্পার্টাকাস বাহিনী রোমান সাম্রাজ্যের আবদ্ধ ভূমিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এটাকেই মোক্ষম সুযোগ হিসেবে রোমের নিষ্ঠুর শাসক ও সেনাবাহিনী। রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর সেনানায়ক মার্কাস লিসিনিয়াস ক্রেসাসের নেতৃত্বে স্পার্টাকাসের বাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়। এই যুদ্ধ ‘তৃতীয় সারভিল যুদ্ধ’ বা ‘গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হন রিক্ত, নিঃস্ব স্পার্টাকাস। মৃত্যু হয় একটি বড় স্বপ্নের। যুদ্ধের ময়দানে সেদিন হয়তো ব্যক্তি স্পার্টাকাসকে পরাজিত করতে পেরেছিল জলদস্যুদের বিশ্বাস ঘাতকতা আর ক্রেসাসের সম্মিলিত ও সংগঠিত আক্রমণ। কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কের তিলক সেদিন আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। দাসপ্রথাকে স্পার্টাকাস সেদিন বিদায় করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু এই প্রথার ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে মানব সভ্যতার জন্য সোনালি প্রভাতের বীজ বপন করতে তিনি সফল হয়েছিলেন। এই আন্দোলন ছিল পরবর্তী সময়ে দাসপ্রথা উচ্ছেদ প্রয়াসে প্রধান প্রাণশক্তি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই রাষ্ট্রীয় সংগঠনের প্রতিটি বিভাগকে অনিয়ম আর দুর্নীতির দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হতে হয়েছে। অনিয়মের দুর্ভেদ্য জালে দেশটি এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, যেন তা ‘দুর্নীতি’ নামক অদৃশ্য প্রভুর দাসত্ব করে চলেছে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে- রাষ্ট্রের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের নানান অনিয়মের চিত্র। সম্প্রতি ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে গাড়ির চালক কর্তৃক একটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর আবদুল করিম ও একাদশ শ্রেণীর দিয়া খানম ওরফে মিম নামের দু’জন শিক্ষার্থীকে দুর্ঘটনার নামে ‘হত্যা’ করা হলে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে দেশব্যাপী শুরু হয় এক সামাজিক জাগরণমূলক আন্দোলন। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে এ পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম দেশটি প্রত্যক্ষ করেছে, তার মধ্যে এই আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। খুদে শিক্ষার্থীরা সড়কপথের অনিয়ম ও দুর্নীতিকে সমগ্র জাতির সামনে এমনভাবে উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে যে, আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শিহরণ জাগানো। তারা জাতিকে দেখিয়ে দিয়েছে- সড়কে প্রশাসনের বেশির ভাগ সদস্যই অনিয়মের সাথে জড়িত। যাদের ওপর আইন প্রণয়ন, প্রয়োগ ও বিচারের ভার অর্পিত, তারাই অনিয়মকে লালন ও ধারণ করে চলেছেন দিনের পর দিন। খুদে শিক্ষার্থীরা আরো দেখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে আইন মানাতে হয়।

সাথে সাথে সড়কের আবর্জনাকেও পরিচ্ছন্ন করে দেখিয়েছে এই সোনার সন্তানেরা। তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, শুধু এ হাত দিয়েই ‘সোনার বাংলা’ গড়া সম্ভব। সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ প্রয়োজন, ভেজাল মানুষ দিয়ে যা একেবারেই অসম্ভব। মাত্র ক’দিনের নবজাগরণের মাধ্যমে তারা সড়কের বিবিধ অনিয়মের চিত্র সামনে নিয়ে এসে রাষ্ট্রের অন্য সব বিভাগের অনিয়ম সম্পর্কেও ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু তারুণ্যের এই জয়যাত্রাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে দুর্নীতির ক্রীতদাসেরা। অসুস্থ, বিবেকবর্জিত, আধমরাদের লোভের কাছে তরুণদের এই আন্দোলন অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। স্পার্টাকাসের আন্দোলন যেমন দাসপ্রভুরা থামিয়ে দিয়েছিল, তেমনি খুদে শিক্ষার্থীদের অনন্য মহতী উদ্যোগকে আমরা দুর্নীতির দালাল ভিন্ন রঙে রাঙিয়ে ম্লান করে দিয়েছে। স্পার্টাকাসের আন্দোলনের মতো এই আন্দোলন দমিয়ে রাখা যাবে না। দুর্নীতি নামের অসৎ প্রভুর ক্রীতদাসদের হাত থেকে প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করার নিরন্তর প্রচেষ্টা সফল হবেই।
লেখক : প্রভাষক, সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজ


আরো সংবাদ



premium cement