১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণপরিবহন : স্বেচ্ছাচার আর অনিয়মই যেখানে নিয়ম

গণপরিবহন : স্বেচ্ছাচার আর অনিয়মই যেখানে নিয়ম - ছবি : সংগ্রহ

তিনি একদিকে স্বনামধন্য মন্ত্রী, অন্য দিকে শীর্ষ পরিবহন শ্রমিক নেতা। সুতরাং গণপরিবহন খাতে চলমান অরাজকতা, চাঁদাবাজি এবং জনগণের পকেট ফাঁকা করার নিত্যনতুন কলাকৌশল উদ্ভাবনসহ সব অনিয়ম ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের দায় অনেকটা তার ওপরও বর্তায়। এ সেক্টরের লোকেরা খুশি হন, হাততালি দেন সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনে।

সুতরাং শ্রমিক নেতা হিসেবে তিনি যখন কোনো বক্তব্য দেন, তা হয়তো মন্ত্রী হিসেবে দেন না। ভারতের মহারাষ্ট্রে সড়ক দুর্ঘটনায় এত জনের মৃত্যুতেও কোনো হইচই নেই, অথচ বাংলাদেশে সামান্য কোনো ঘটনা ঘটলেই হইচই শুরু হয়ে যায়- হাস্যোজ্জ্বল বদনে একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার এ মূল্যায়ন যত অবাঞ্ছিত হোক, একজন শ্রমিক নেতার পক্ষেই হয়তো সম্ভব।

লঞ্চ দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় ‘পদত্যাগ করবেন কিনা’, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রীর সাফ জবাব, ‘লঞ্চ কি আমি চালিয়েছি যে, পদত্যাগ করব?’ অথচ সেই লঞ্চটির ফিটনেস তো ছিলই না, বরং যাত্রী বহন করা হচ্ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। যার বিবেচনায় ‘মানুষ ও কুকুর চিনতে পারা’ই ড্রাইভার হওয়ার যোগ্যতা হিসেবে যথেষ্ট, তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করে লাভ কী? এর পরও দুঃখজনক বাস্তবতা হলোÑ কুকুর চেনার বেলায় কদাচিত ভুল না হলেও মানুষ চেনার বেলায় প্রতিনিয়তই ভুল হচ্ছে। কিন্তু কেন? মন্ত্রী আছেন, সবকিছু কি ঠেকাবেন তিনি? দুর্ঘটনার প্রতিকারের পরিবর্তে ‘অতীতেও দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে’ এ ধরনের উক্তিও এ দেশের মানুষকে হজম করতে হয়। দিল্লিতে অহরহ বাসে ও ট্রেনে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে বলে বাংলাদেশের জন্য এটাও কি দৃষ্টান্ত হতে পারে?

মজলুম হওয়ার জন্য শক্তি লাগে না, আর শক্তি ছাড়া জালিম হওয়া যায় না। এমনকি চোর-ডাকাতও না। ‘শেয়ার মার্কেট ডাকাত’দের নাম পরিচয় জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী স্রেফ বলেছিলেন, ‘ওদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। ওদের ক্ষমতা অনেক’। একই ক্ষমতা তত্ত্ব রিজার্ভ চুরি, স্বর্ণ চুরির বেলায় প্রযোজ্য নয়Ñ এমনটি হয়তো এখনো বলা যাচ্ছে না। পরিবহন সেক্টরের বেলায় এই ‘ক্ষমতা তত্ত্ব’ বোধ করি আরো বেশি সত্য। নগর পরিবহনের প্রায় শতভাগ হঠাৎ করেই ‘সিটিং’ হয়ে গেল, যা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও নেই। এ সুবাদে পাঁচ টাকার ভাড়া ১০ টাকা, এমনকি ২০ টাকায়ও উঠে গেল। যাত্রীদের তো কোনো ‘সমিতি’ নেই। একমাত্র ভরসা গণমাধ্যম।

দেশের এমন কোনো মিডিয়া বা পত্রপত্রিকা নেই; যাতে পরিবহন সেক্টরের এ জুলুম ও অরাজকতা নিয়ে কমবেশি লেখা হয়নি। একপর্যায় ‘সিটিং সার্ভিস’ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি হলেও মাত্র দু’দিন পরই তা প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। অথচ সিদ্ধান্তটি গণবিরোধী ও বেআইনি ছিল না। এখানেও সেই ‘ক্ষমতা তত্ত্ব’ই প্রাধান্য পেয়েছে? আইনানুগ প্রতিবাদের সব ভাষা ব্যবহারের পরও তা বহাল আছে। ৫-১০ ভাগ ‘সিটিং-গেইটলক’ হয়তো দরকার আছে। কিন্তু যাত্রীদের প্রয়োজন ও চাহিদার বিরুদ্ধে শতভাগ সিটিং কেন? আর ভাড়া স্তর নির্ধারণের মালিক-মুখতারও কি পরিবহন সমিতিগুলোই? তাই মনে হয় পরিবহন সমিতিগুলো যেন ‘সরকারের মধ্যেই আরেকটা সরকার’। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরও গাড়ির ফিটনেস নেই এবং কাগজপত্র তামাদি দীর্ঘ দিন থেকে। এসব আইনের শাসনের আলামত?

ঢাকার কুর্মিটোলার ঘটনায় ছাত্র-জনতার হাতে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এটা দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কিনা গভীরভাবে ভেবে দেখা। ঢাকার আব্দুল্লাহপুর থেকে গাবতলী ও মোহাম্মদপুর রুটে বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির গাড়ি চালু আছে। জনগণের পকেট হাতিয়ে নেয়ার উপায় উদ্ভাবনে এরা একধাপ এগিয়ে। ‘সিটিং সার্ভিস’ বিবেচনায় আবদুল্লাহপুর থেকে গাবতলী বা শিশুমেলা ৩০ টাকা ভাড়া। তবে এদের কূটকৌশল সত্যিই অনন্য। কুড়িল পর্যন্ত সিটিং থাকলেও তারপর আর সিটিং থাকে না।

অথচ ভাড়া দিতে হয় সিটিংয়েরই। আবার কুড়িল থেকে গাবতলী বা শিশুমেলা ২০ টাকা সিটিং ভাড়া বেশি মনে না হলেও টাউন সার্ভিসে এতটা দীর্ঘ পথে একক যাত্রী খুব কমই থাকেন। সুতরাং একই সিট প্রতি ট্রিপে তিন-চারবার বিক্রি হচ্ছে। এই হিসাবে গড়পড়তা প্রতি সিট দুইবার বিক্রয় হলেও আবদুল্লাপুর থেকে গাবতলী সিটপ্রতি ভাড়া আদায় হচ্ছে ৩০ী২= ৬০ টাকা। তার ওপর, দাঁড়ানো যাত্রী তো আছেই। অথচ ভাড়া গুনতে হয় সিটিংয়ের। এই দুই রুটে যাত্রীর তুলনায় বাসের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ (সম্ভবত কাঁচা টাকার গন্ধই এর কারণ)। এ দিকে, যাত্রীস্বল্পতায় এই বাসগুলো কুড়িল পর্যন্ত আসতে যে সময় নেয়; ততক্ষণে অন্য বাসগুলো রামপুরা বা মগবাজার পার হয়ে যায় অনায়াসেই। সুতরাং সময় বাঁচাতে কুড়িল পার হওয়ার পরই এরা মরিয়া হয়ে ছুটতে থাকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে।

রাজধানীর অন্যান্য রুটের অবস্থাও কমবেশি একই রকম। কমলাপুর থেকে মতিঝিল দুই-তিন বছর আগেও দুই টাকার বেশি নেয়া হতো না দূরত্ব বিবেচনায়। এখন ভাড়া ১০ টাকা। কোনো কোনো পরিবহনে ২০-৩০ টাকার নিচে ভাড়া নেই। ‘তুরাগ’ মিনিবাসগুলো শতভাগই সিটিং লেখা বটে, কিন্তু আদতে সিটিং নয় একটিও। ওদিকে ‘ভিআইপি’ নামের কাউন্টার সার্ভিস বাসগুলো অদ্ভুত নিয়ম কানুন নিজেরাই করে নিয়েছে। এই রুটে আজো অন্য কোনো সংস্থার বাস কেন নেই? ‘ক্ষমতা তত্ত্ব’ এখানেও কাজ করছে কিনা তা দেখার ক্ষমতাও বোধ হয় নেই কারো।

পথচারী, ছাত্র-জনতার ওপর বাস তুলে দেয়ার ঘটনা এবার প্রথম নয়। তবে এবার অন্তত সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু আরো যে হাজারো ঘটনা সেগুলোর কেন সুষ্ঠু বিচার হবে না? সুষ্ঠু বিচার কি আন্দোলনের ওপর নির্ভরশীল নাকি অপরাধের মাত্রার ওপর তা নির্ভর করে? একই আইনে দু’রকম বিচার কী করে সম্ভব? আদালত হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দান ও আহতদের চিকিৎসা খরচ বহনের নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশ যথাযথভাবে কার্যকর হোক এটা সবার প্রত্যাশা। তবে সব ধরনের দুর্ঘটনায় হতাহতদের কল্যাণে ইনসাফভিত্তিক একটি বিধিবদ্ধ স্থায়ী ব্যবস্থা থাকা জরুরি। যেমনটি জরুরি সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায্য বিচারের পদক্ষেপ। আর সবচেয়ে বড় কথা, পরিবহন সেক্টরকে ইনডেমনিটি না দিয়ে আইন ও শৃঙ্খলার আওতায় অবিলম্বে নিয়ে আসা। কয়েক শ’ পরিবহন মালিকের কাছে কোটি নগরবাসী জিম্মি হয়ে থাকবে, তা কোনো মতেই কাম্য নয়।

পরিবহন সমিতিগুলো মানুষের মৃত্যু ও পকেট লুটের ইনডেমনিটি রক্ষায় আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। তাদের এই হুমকির সাথে আপস করা মানে, চলমান অরাজক পরিস্থিতিকেই মেনে নেয়া। এটা যেন কোনোক্রমেই না হয়। একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবেলায় সর্বপ্রকার প্রয়াস অব্যাহত রাখা চাই।


আরো সংবাদ



premium cement