২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’

‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ - ছবি : সংগৃহীত

বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে প্রথমে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। ক্রমে এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসে। ক্রমেই এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এলাকা থেকে এলাকায়, জেলা থেকে জেলায়। সম্পৃক্ত হয় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সমর্থন জানিয়েছেন ড. আনিসুজ্জামানের মতো গুণী ব্যক্তি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এ দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।

আমাদের সন্তানেরা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বিক্ষোভ করছে। দাবি তুলেছে সমস্বরে ‘We want justice.’

তাদের দাবি- এই নিষ্ঠুর হত্যা, এই মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে পরিহাস করা নৌমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং দোষীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা। প্রায় সপ্তাহ ধরে ছাত্রছাত্রীরা দাবি আদায়ে আন্দোলন করছে। রাস্তা অবরোধ করছে, কিন্তু সরকার নিশ্চুপ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। অজুহাত, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পিছিয়ে যায়নি। প্রশ্ন হলো- নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে কারা? পুলিশ নাকি পরিবহন শ্রমিক? নাকি ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা? কারা হন্তারক হতে পারে এই কোমলমতি শিশু-কিশোরদের? সরকার জানে না? কয়েকজন মন্ত্রী দাবির যৌক্তিকতা মেনে তা মানার আশ্বাস দিয়ে ঘরে ফিরে যেতে বলেছেন শিক্ষার্থীদের। র‌্যাব, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাবধান বাণী উচ্চারণের আড়ালে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রচ্ছন্ন হুমকি দিচ্ছেন; যাতে তারা মাঠ ছেড়ে দেন। অভিভাবকদের অনুরোধ জানাচ্ছেন তাদের সন্তানদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে। তারা নাশকতার আশঙ্কা করছেন। কোনো কুচক্রী মহল এই আন্দোলনের সুযোগে সরকার পতনের চক্রান্তে লিপ্ত হতে পারে বলে তারা অনুমান করছেন।

আশ্চর্য! সপ্তাহব্যাপী ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ করছে। তারা রাজপথেই আছে সারা দিন। স্কুল এবং সর্বোচ্চ উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র এরা। কই! কোনো বিশৃঙ্খলা তো হয়নি। তারা তো গাড়ি ভাঙচুর করেনি। কোনো পরিবহন শ্রমিকের ওপর চড়াও হয়নি। আওয়ামী লীগ দেখানো আন্দোলনের পথ, রাজপথে পিটিয়ে হত্যা, সে পথে তারা তো যায়নি; বরং নৌমন্ত্রীর উসকানিতে শ্রমিকেরা ছাত্রদের ওপর চড়াও হয়েছে। ছাত্রের গায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেছে পুলিশের সামনেই। এই ছেলেরা একটি ভয়ঙ্কর সত্য সবার সামনে উদঘাটন করে দেখিয়ে দিয়েছে। লক্ষাধিক বাস-ট্রাকের ফিটনেট সনদ নেই। লাইসেন্সধারী চালক নেই ১৬ লাখ গাড়িতে। আবার যাদের আছে, তাও হয় মেয়াদোত্তীর্ণ না হয় দুই নম্বরি লাইসেন্স, অদক্ষ-অপরিণত বয়সের ড্রাইভারের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দিয়েছেন মালিক। আর এই মালিক কারা? বেশির ভাগই সরকারি দলের নেতা। ভূত তো সর্ষেতেই। আর সরকারি পরিবহন বা মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ির ড্রাইভাররা তো কাউকেই তোয়াক্কা করেন না। বিনা কাগজে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে, উল্টো পথে গিয়ে প্রতিনিয়ত আইন ভাঙছেন। এদের কাছে অসহায় ট্রাফিক পুলিশ।

তবে এটা মনে করা বোধহয় ভুল হবে, মাত্র দু’জন সহপাঠীর মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণে এ ক্ষোভ। তারা দেখেছে, মাত্র ক’দিন আগে সাইফুল নামে ছাত্রটি যে বাসের যাত্রী ছিল এবং যার ধাক্কায় সে আহত হয়েছিল সেই বাসের ড্রাইভার-কন্ডাক্টর মিলে তাকে নদীতে ফেলে হত্যা করেছে নির্মমভাবে ও নির্বিকারচিত্তে। গাড়িচাপায় প্রায়ই নিহত হয় স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীসহ অসংখ্য মানুষ। বাসে নিগৃহীত হয় তরুণী, হারায় সম্ভ্রম, কখনো জীবন। কিছু দিন সহপাঠীরা প্রতিবাদ করে, রাস্তা বন্ধ, গাড়ি ভাঙচুর, সরকারের আশ্বাস, তারপর সব আগের মতোই। কোনো শাস্তিই হয় না দোষীদের। শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য, ছাত্রলীগ নামধারী মাস্তানদের মাস্তানি, শিক্ষক লাঞ্ছনা, প্রশ্ন ফাঁস, বইয়ের বোঝা, শিক্ষার ব্যয় বৃদ্ধি (পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বেড়ে যায় যাতায়াত খরচ)। সব মিলে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, যেকোনো সময় চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পুঞ্জীভূত অবরুদ্ধ ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। একটি স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করেছে।
মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং ওবায়দুল কাদের এ আন্দোলন যৌক্তিক বলে স্বীকার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে রাজীব ও দিয়ার মা-বাবাকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে সমবেদনা জানিয়েছেন। প্রত্যেক পরিবারকে ২০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র অনুদান দিয়েছেন।

দোষীদের শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন। নিহতেরা যে কলেজের ছাত্র সেই রমিজ উদ্দীন কলেজকে পাঁচটি বাস দিয়েছেন। কলেজের সামনে আন্ডারপাস করার ঘোষণা দিয়েছেন। স্পিডব্রেকার থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে, থাকবে আলাদা ট্রাফিক। থাকবে ছাত্রবান্ধব আরো অনেক কিছু। নিহতদের বাবা-মা অত্যন্ত ব্যথিত ও বিপন্ন মুখচ্ছবি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ঘরে ফিরে যেতে আহ্বান জানিয়েছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রেখেছেন। আস্থা আমরাও রাখি। জানি তিনি অত্যন্ত মমতাময়ী, শাস্তিদানে কঠোর। কিন্তু পরিবহন বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার জন্য যিনি দায়ী, সেই শাজাহান খানের কী হবে? তার বিষয়ে তো প্রধানমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য নেই। অনেকের অন্যতম দাবি শাজাহান খানের পদত্যাগ। তিনি বলেছেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না। কী ঔদ্ধত্য! আমরা জানি, ‘খুঁটির জোরে ভেড়া কুঁদে’। খান সাহেবের সেই খুঁটি কে বা কী? তিনি কি প্রধামন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান? আন্দোলন যখন ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করছে, বিভিন্ন দল, প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে, তখন শাজাহান খানের এই ঔদ্ধত্য ভাবার বিষয়। অর্থ কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ আমরা দেখেছি। শাজাহান খান কি ভুলে গেছেন?

এ পর্যন্ত সরকার ধৈর্যের সাথে প্রশংসনীয়ভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করে আসছে, কিন্তু সরকার শিগগিরই কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্তে আসছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ। শনিবার থেকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নামতে পারে, এমন আভাস পাওয়া গেছে। আমাদের শঙ্কা এখানেই। তারা নাশকতার আশঙ্কা করছেন। নাশকতা দমনে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য তারা দায়ী হবেন না ঘোষণা দিয়েছেন। ভয় হয়, আবার না প্রাণহানি হয়। কারণ, তারা তো একটাই ভাষা জানেন। অস্ত্রের ভাষা।

প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে এই শিশু-কিশোরদের প্রতিপক্ষ ভাববেন না। ওরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে। ন্যায়বিচার দাবি করছে। যেমন করেছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। যেমন করেছিলেন বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ। যেমন করেছিলেন আপনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্কুলের ছাত্র থাকাকালে প্রতিবাদী ছিলেন। তাদের আন্দোলনের ফসল তো আজকের বাংলাদেশ। ব্যাঙাচিই তো একদিন ব্যাঙ হবে। ওরাই নেতা হবে। গড়ে তুলবে দুর্নীতিমুক্ত জনগণের বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী, অনুগ্রহ করে দাবি মেনে নিন। আমাদের প্রিয় সন্তানেরা ফিরে যাক ক্যাম্পাসে, স্বস্তি পাক তাদের বাবা-মা। রক্ষা পাক দেশ।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী

 


আরো সংবাদ



premium cement
জামালপুরে সাব রেজিস্ট্রারকে হত্যার হুমকি মামলায় আ’লীগ নেতা গ্রেফতার গাজায় অনাহার যুদ্ধাপরাধ হতে পারে : জাতিসঙ্ঘ ‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ

সকল