১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণতন্ত্রের দেশ ভারত ও গণ-উন্মত্ততার ইতিকথা

গণতন্ত্রের দেশ ভারত ও গণ-উন্মত্ততার ইতিকথা - ছবি : সংগৃহীত

উন্মত্ত জনতার সহিংসতার যে বিপদ, এর সবচেয়ে মর্মান্তিক বিবরণগুলোর একটি দিয়েছিলেন প্রখ্যাত মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন। ১৯০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরিতে সংঘটিত বর্ণবাদী এই গণ-আদালতি হত্যাযজ্ঞের বয়ান তিনি তার জীবদ্দশায় কোথাও প্রকাশ করে যাননি। তবে মার্ক টোয়েন বলে গেছেন, এ ধরনের ঘটনায় আমেরিকা বা ইউএসএ পরিণত হতে পারে ইউএসএল-এতে। এই ইউএসএল বলতে তিনি বুঝিয়েছেন বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞের যুক্তরাষ্ট্র।

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র ওই ঘটনার শতাধিক বছর পর একই ধরনের শঙ্কার ছায়াতলে এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সম্প্রতি ওহফরধ-ংঢ়বহফ একটি রিপোর্ট বের করেছে মিডিয়ার কয়েকটি খবর বিশ্লেষণ করে। এর উপসংহারে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে গরু নিয়ে ২০টি সন্ত্রাসী হামলার খবর পাওয়া গেছে। আগের বছরের তুলনায় এটি ৭৫ শতাংশ বেশি। ২০১০-এর পর সে বছরেই সর্বাধিক সহিংসতা ঘটেছে।
উল্লিখিত হামলাগুলোর মধ্যে ছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতা কর্তৃক পিটিয়ে হত্যা, গোরক্ষকদের হামলা, হত্যা এবং হত্যার প্রয়াস, হয়রানি, আক্রমণ ও গণধর্ষণ। এমন দু’টি ঘটনায় ভিকটিমকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। বিবস্ত্র করা হয়েছে এবং পেটানো হয়েছে। দু’টি ঘটনায় ভিকটিমকে ঝোলানো হয় ফাঁসিতে।

জানুয়ারি ২০১১ থেকে জুন ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে জনতার সহিংসতা এবং গণনৈরাজ্যের বিশ্লেষণ করে ‘অবজারভার রিসার্চ অ্যানালাইসিস’ দেখিয়েছে, ভারতে গরুসংশ্লিষ্ট সহিংসতা আগে যেখানে গণপিটুনি বা হাঙ্গামার ৫ শতাংশ ছিল, সেখানে ২০১৭ সালের জুন মাসের শেষে ২০ শতাংশে পৌঁছেছে নাটকীয়ভাবে।
তবে এ দেশের নাগরিকদের বড় অংশ সাম্প্রতিক গণসহিংসতার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এ দেশের বহু এলাকায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ঘটছে এ ইস্যুতে (‘আমার নামে নয়’ শীর্ষক প্রচারণাসহ)। সবাই নিন্দা জানিয়েছেন উন্মুক্ত জনতার হাতে মানুষের মৃত্যুর। তাহলে সমস্যা কোথায়?

মূলধারার মিডিয়ায় ভারতে গণসহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে বহু মতামত এসেছে। এতে ডান ও বামপন্থী নির্বিশেষে সবাই যে অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন, তা হলো- (কোনো বিশেষ মতাদর্শ, দল বা গোষ্ঠীর) নজরদারি এবং গণ-উন্মত্ততার স্থান সমাজে থাকা উচিত নয়। এসব চলার অর্থ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ। এ অবস্থায় উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সমাজ মোকাবেলা করতে পারে না।

আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ থাকা যথার্থ। তবে কয়েক বছরে গণসহিংসতা অনেক বেড়ে যাওয়া এবং ভারতের শাসনক্ষমতায় দক্ষিণপন্থীদের উত্থানের সাথে এর সম্পর্কের বিষয় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। এটা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, গণপিটুনিসমেত এসব নৈরাজ্যের সাম্প্রতিক হিড়িক ইঙ্গিত দিচ্ছে, রাষ্ট্র এই পরিস্থিতি সত্ত্বেও উদাসীন এবং ভারতের বেশির ভাগ মানুষ বাস্তবতা অস্বীকার করে চলেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ঘৃণা ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) মিলে মুসলিমবিরোধী অনুভূতি সংক্রমিত করছে। গণপিটুনি দিয়ে খতম করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়কে জানিয়ে দেয়, ‘আইনকানুন তোমাদের বাঁচাতে পারে না।’ গরুর ব্যবসায়ের ব্যাপারে আইন করার পর এবং গরু নিয়ে কুখ্যাত নজরদারির প্রেক্ষাপটে এহেন প্রবণতা আরো জোরালো হয়ে উঠেছে।
মিডিয়ার কোনো কোনো অংশ এমন বাস্তবতাকে অস্বীকার করছে। তাদের কথা হলো, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় আসার আগেও গণসহিংসতা ও গণহত্যার নৃশংস ইতিহাস আছে ভারতে। মিডিয়ার এই লোকজনের মতে, গণপিটুনি দিয়ে কাউকে মেরে ফেলা মূলত আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। তাদের দৃষ্টিতে ভারতের মূলধারার মিডিয়া রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট এবং তারা দায়ী করতে চায় বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার আর আরএসএসকে। নজর ফেরানো যাক, নিকট অতীতে ভারতে গণসহিংসতা ও গণ-উচ্ছৃঙ্খলতার প্রবণতার প্রতি।

সাম্প্রদায়িক গণপিটুনি : ঘৃণার আরেক রূপ
এ ধরনের ঐধঃব পৎরসব নিয়ে সরকারি পরিসংখ্যানের অবর্তমানে গণমাধ্যমের খবরগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত জোগাতে পারে। এগুলো বিশ্লেষণ করা হলে গণসহিংসতার কিছু বৈশিষ্ট্য অবশ্যই উদঘাটিত হবে। গুগল নিউজে ২০১০ থেকে ২০১৭ নাগাদ ভারতে গণপিটুনির যেসব খবর দেয়া হয়েছে, সেগুলো অনুসন্ধান করেছেন এই নিবন্ধের লেখকদ্বয়। ওহফরধ-ংঢ়বহফ প্রায় অভিন্ন ধরনের অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ করেছে। তারা অবশ্য ভিন্ন ধরনের পরিভাষা প্রয়োগ করেছে। যেমন- গরুর ওপর নজরদারি, গোরক্ষক, গোমাংস, গণপিটুনি, গরু জবাই, গরু চোর, গোমাংস পাচার ও গরুর বেপারি।

আমরা তথ্য-উপাত্তের নিরিখে বিশ্লেষণ করেছি। তাতে সর্বপ্রধান হিসেবে যে প্রবণতা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে তা হলো, জনতা কোনো কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতনের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত শাস্তিদাতার ভূমিকা পালন করেছে। দেখা যায়, সামান্য অপরাধেও গুরুদণ্ড দেয়া হয়েছে। হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে ‘শাস্তি’ দেয়ার ঘটনা ছাড়াও জনতা যাকে ‘নীতিচ্যুত’ মনে করে, তাকে ‘সাজা’ দেয়া হয়েছে। বর্ণবাদী মানসিকতা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র ও পর্যটকদের বিরুদ্ধে গণসহিংসতা ঘটেছে।

এ ছাড়া তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে স্বাধীনভাবে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এগুলোর সাথে সম্পর্কিত ঘটনার সংখ্যা বিপুল, অথচ এসব ঘটনার ব্যাপারে প্রায়ই রিপোর্ট করা হয় না।
প্রথমেই বলতে হয় উইচ-হান্টিং বা ‘দুষ্ট পেত্নি’ নিধন সম্পর্কে। এজাতীয় ঘটনার সংখ্যা বিস্ময়কর। একটি রিপোর্টে জানা যায়, ২০০০ সাল থেকে এক যুগে ভারতের ১২টি রাজ্যে পেত্নি খতম করার নামে দুই হাজার ৯৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ইস্যুটি হলো দলিতদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী সহিংসতার ঐতিহাসিক বিষয়। এ ধরনের বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ প্রায়ই ঘটে থাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার মাধ্যমে। তবে সাধারণত এটি খবর হিসেবে প্রচারিত হয় না। প্রকাশ্যে দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষকে চরম সহিংসতার শিকারে পরিণত করার উদ্দেশ্য হলো, এভাবে অন্যদেরও ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, গোমাংস ইস্যুতে জনতার সহিংসতার যে ক’টি অঘটন সর্বপ্রথম ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল; তার একটি হলো ২০০২ সালে হরিয়ানার পাঁচজন দলিতকে উন্মত্ত জনতা বিচারবহির্ভূত পন্থায় খুন করেছিল। গুজব ছড়ানো হয়, ‘ওরা গরু জবাই করেছে।’
তৃতীয়ত, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও দাঙ্গার সময় পিটিয়ে মেরে ফেলা- অবশ্যই এ বিষয়টিকে স্বতন্ত্রভাবে দেখতে হবে।

অতএব বলা যায়, ভারতে জনতার সহিংসতা ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সুস্পষ্ট ইতিহাস বিদ্যমান। এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রতিফলিত হয়, ভারতীয় সমাজে এমন সব ‘মূল্যবোধ’-এর অবশিষ্টাংশ রয়ে গেছে, যা আধুনিক যুগে অচল। বর্বরতাপূর্ণ বর্ণ প্রথা এর সর্বাধিক জ্বলন্ত নজির। গণসহিংসতার উল্লিখিত তালিকা আর ওহফরধ-ংঢ়বহফ-এর ১০১টি ঘটনার তালিকা যোগ করে দেখলে বলতে হয়, ভারতে সহিংসতার একটি সম্পূর্ণ নতুন ক্যাটাগরি জন্ম নিয়েছে। এটা হলো, গণ-আদালতে গোমাংসবিষয়ক হত্যাকাণ্ড। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যারা নির্যাতনের শিকার তাদের বেশির ভাগই মুসলিম। প্রায় সময় গুজবের ভিত্তিতে এবং একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের দরুন এটা হয়ে থাকে। গণসহিংসতার যত ঘটনা ভারতে বিগত তিন বছরে ঘটেছে, তার মধ্যে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞের অনুপাত বেড়েছে। সবিশেষ উল্লেখ্য, ওহফরধ-ংঢ়বহফ রিপোর্টে জানানো হয়, গরুর গোশত নিয়ে হামলার যত ঘটনা ২০১০ ও ২০১৭ সালের মধ্যে ঘটেছে, এর ৯৭ শতাংশই প্রকাশ পেয়েছে মাত্র গত তিন বছরে। এজাতীয় ৬৩টি হামলার মধ্যে ৬১টিই জানা গেছে গোরক্ষক বাহিনী গঠন এবং গোমাংস ব্যবসার বিধিনিষেধ আরোপের পর। এসব সহিংসতার বেশির ভাগ ঘটেছে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে। অর্থাৎ, ভারতের বর্তমান শাসক মহলের নির্দেশ, অনুমোদন বা ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ নতুন ধরনের গণসহিংসতা ভারতে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে।

শাস্তি ভোগ না করার অপসংস্কৃতি
উন্মত্ত জনতা কর্তৃক নিধনের এই নতুন ধরনের অপরাধের ক্রমবৃদ্ধির হেতু কী? সুপ্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কি এ অসম্পূর্ণ ‘গণতান্ত্রিক প্রকল্প’ বাস্তবায়নের জন্য দায়ী? নাকি এটি একটি পুরোপুরি নতুন ধরনের মানসিকতা, যার উৎস বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে নিহিত? জবাব পেতে হলে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। যা হোক, আমরা এতটুকু বলতে পারি, আরএসএস-বিজেপি শাসনামলে শাস্তি না পাওয়ার যে কুপ্রথা তৈরি হয়েছে, তার পরিণতি হলো সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির আকস্মিক বিস্তার এবং এর সাথে সম্পর্কিত সহিংসতা।

হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থীদের সবচেয়ে গুরুত্ববহ কৌশলগুলোর একটি হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। ২০১৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণায় এর বাস্তবায়ন দেখা গেছে। এরপর তা অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গোমাংস ও গবাদিপশু ব্যবসার বিরুদ্ধে বলেছেন। এটা তার ঘোষিত ‘গোলাপি বিপ্লব’-এর অংশ। একই কৌশলের পরিণামে ধর্মোন্মাদ হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলো ঘৃণাত্মক অপরাধ করেও কোনো শাস্তি পায় না।
বর্তমান আমলে গোমাংস নিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জনতার দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সর্বপ্রথম ঘটনা থেকে সরকার ও প্রশাসনের যে প্রতিক্রিয়া, তাতে দায়মুক্তির কৃষ্টিই প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রথমেই বলা দরকার ঐধঃব পৎরসব-এর যারা শিকার, তাদের বিরুদ্ধে মামলার কথা। এটাই নাকি এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রথম পদক্ষেপ। অতএব, প্রশাসনের দরদ কাদের জন্য, তার গোপন ও প্রকাশ্য ইঙ্গিতের অভাব নেই। এ ধরনের সহিংস ঘটনার ক্ষেত্রে এমন একটি দৃষ্টান্তও নেই যাতে দেখা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জোরালো নিন্দা করেছে।

অপর দিকে, এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্তদের আশকারা দেয়া হয়েছে শক্তির প্রদর্শনী আর উসকানিমূলক বিবৃতির মাধ্যমে। পর্যটনমন্ত্রী মহেশ শর্মা মোহাম্মদ আখলাক হত্যার আসামির শেষকৃত্যে অংশ নিতে গিয়ে বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড গরু জবাই করার প্রতিক্রিয়া। আপনাদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে, সে ঘরে ১৭ বছরের একটি মেয়েও ছিল। কিসি নে উসে উংলি নাহি লাগাঈ (কেউ তো হাতে স্পর্শও করেনি)।’ হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী এম এল খাত্তার উন্মত্ত জনতা কর্তৃক মানুষ হত্যাকে বললেন ‘ভুল বোঝাবুঝি’। তিনি মতান্ধতার প্রমাণ দিলেন এটা দাবি করে, ‘গোমাংস খাওয়া বন্ধ করার পরও তারা মুসলমান থাকবে; তা নয় কি? কোথাও লেখা নেই যে, মুসলমানকে গোমাংস ভক্ষণ করতে হবে। খ্রিষ্টধর্মের কোথাও লেখা নেই, তাদের গরুর মাংস খেতে হবে।’

বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেছে, ‘এই এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে জনতার হাতে হত্যার ঘটনা ঘটেছে আরো বেশি।’ এ কথা বলে তিনি এসব হত্যাকে হালকাভাবে দেখলেন। তার মতে, ‘দেশের কোথাও আশঙ্কার কারণ নেই।’ অথচ তিনিই ২০১৭ সালের এপ্রিলে বলেছিলেন, ‘গোরক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী মোদি এমন ইস্যুতে দুঃসহ নীরবতা পালন করছিলেন। তার অবসান ঘটাতে বাধ্য হয়ে তিনি গোরক্ষকদের উদ্দেশে নিষ্ফল হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। যেদিন তিনি সোস্যাল মিডিয়ায় হুঁশিয়ারি দিলেন, সেদিনই ঝাড়খণ্ডে এক ব্যক্তি তার যানে গোমাংস বহন করেছে সন্দেহ করে তাকে উন্মত্ত লোকজন মেরে ফেলেছে।

এজাতীয় ঘটনাগুলো সংখ্যালঘুদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়ার মতলব হাসিল করেছে; অথচ সরকার এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নামে মাত্র। জনতার এহেন প্রকাশ্য সহিংসতার যে প্রতিক্রিয়া সরকার দেখিয়েছে, তাতে মনে হয়েছে ধর্মের নামে এসব উন্মত্ততার কাজ আইনের আওতার বাইরে। এতে সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্তরা নিজেদের অপরাধকে এখন গৌরবজনক মনে করছে। তারা তাদের ঘটানো হত্যাকাণ্ডকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে তুলে ধরছে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর মাঝে যে সামাজিক বন্ধন, তাকে আসলেই ভেঙে দেয়ার বিপদ এরা সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় আগের চেয়ে আরো প্রকাশ্যে ও জনতার চোখের সামনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটলেও কেউ এতে বাধা দেয়নি। অর্থাৎ, এমন একটি অপরাধকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর এই জনতা সব কিছু দেখেও পরে অস্বীকার করে বলেছে, তারা ‘কিছুই দেখেনি’। একজন তরুণের ওপর হামলা করা হলো। সে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে প্ল্যাটফর্মে পড়ে রইল; কিন্তু কেউ তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি। অপর দিকে, হামলাকারীরা তরুণটির খাদ্যাভ্যাস ও ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে কটূক্তি করেছে।

এটাই বাস্তবতা, যা প্রকৃতপক্ষেই ঘটেছে। এটা কোনো পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়ার বয়ান নয়। উচ্ছৃঙ্খল লোকজন প্রকাশ্যে কাউকে মেরে ফেলাকে স্বাভাবিকীকরণের বিষয়কে মার্ক টোয়েন খুব ভয় করতেন। ভীতিটা এ কারণে যে, এমন একটি ঘটনা একই ধরনের অনেক ঘটনার জন্ম দেবে। এ অবস্থা দেখে মনে পড়ে, তফসিলি সম্প্রদায় ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা হয়েছিল, যা দেখানো হয় ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হিসেবে। এসব ঘটনায় প্রশাসন যথাযথ আইন মোতাবেক মামলা দায়ের করতে চায় না। এ ধরনের অপরাধ ‘আইনশৃঙ্খলার বিষয়’ ঠিকই; তবে এতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও ঘৃণা যে জড়িত, তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ধামাচাপা দিতে আইনশৃঙ্খলা ইস্যু ব্যবহার করা উচিত নয়।

সরকারি প্রশাসন আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যোগসাজশে কিংবা তারা নীরব থাকলে অপরাধকে উসকে দেয়া হয়। ক্ষমতাসীন সরকার যদি কেবল গণপিটুনির নিন্দা জানায় এর কারণ দূর না করে, তাহলে কিন্তু প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মেনে নেয়া হয় মতান্ধতা ও নির্যাতনকে। গোরক্ষার নামে সহিংসতা চালু থাকলে গণতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

সহিংসতার এই নবরূপ চিহ্নিত করা না হলে আমাদের সমাজের পচনও অচিহ্নিত থেকে যাবে। তদুপরি, আমরা তখন রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে ব্যর্থ হব। দুর্ভাগ্যবশত, মার্ক টোয়েন বিপদটির যথার্থ মূল্যায়ন সত্ত্বেও চুপ ছিলেন। আজকের ভারতের মধ্যপন্থীরাও কি একই পথ বেছে নেবেন? ইতিহাস তা বিচার করবে।
sandipanbaksi@gmail.com
aravindhan.nagarajan@gmail.com
ভাষান্তর : মীযানুল করীম

 


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের গণপিটুনিতে নিহত ২ নির্মাণশ্রমিক জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান

সকল